সাদাকালো-পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে 'আদিবাসী' বিতর্কের সমাধান সম্ভব by আহমদ রফিক

আবার পার্বত্য চট্টগ্রাম। বাহাত্তর-পরবর্তী সময়ে অনেক অশান্তি, অনেক মৃত্যু, অনেক রক্ত ঝরার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটা বিচক্ষণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। পাহাড়ি অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি পরিষদের প্রধান সন্তু লারমার সঙ্গে চুক্তি_পাহাড়ে আপাতত শান্তি, সেসব ঘটনা সবাই জানেন।


পাহাড়িদের ছোট্ট একটি উগ্রপন্থী দল চুক্তি না মানলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানকার মানুষ শান্তি চায় এবং তারা ওই চুক্তির পক্ষে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে চুক্তির ধারাগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি বলে কিছু কাঁটা সেখানে রয়ে গেছে, মাঝেমধ্যে রক্ত ঝরছে, সামান্য হলেও ঝরছে। আর রাষ্ট্রপতি জিয়া সেখানে বাঙালি বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা নিয়ে যে সংঘাতের পথ তৈরি করে দিয়ে গেছেন, তার দায় বাঙালি-পাহাড়ি উভয়কেই বহন করতে হচ্ছে। রক্তও ঝরছে। এ সমস্যা সহজে মেটার নয়। তা ছাড়া রয়েছে সেনাবাহিনী পুরোপুরি সরিয়ে আনার বিষয়টি।
তবে একটি প্রশ্নের কিছুতেই জবাব মিলছে না, যে চুক্তি প্রধানমন্ত্রীর একান্ত গরজে স্বাক্ষরিত হলো, গুলি-বারুদের ঝাঁঝে শান্তির আবহ তৈরি হলো_সেই আকাঙ্ক্ষিত চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের অনীহা কেন? জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা নানা উপলক্ষে চুক্তি বাস্তবায়নের আহ্বান জানাচ্ছেন, জানাচ্ছেন অন্য পাহাড়ি নেতারাও; তবু কোনো সাড়া মিলছে না। আমাদের জানতে ইচ্ছে করছে, এ ক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়, কোন্ গিঁটে সমঝোতা বন্দি? কেন বন্দি?
এ অবস্থায় নতুন এক সমস্যা, সেটা আরো কঠিন। বলতে হয় গোদের উপর বিষফোঁড়া? একে তো বাহাত্তরের সংবিধানে আদিবাসীদের কথা অনুলি্লখিত ছিল, সেটার যদিও বা সংশোধন বা সমাধান হতে যাচ্ছিল, এখন মস্তবড়ো সমস্যা ওই 'আদিবাসী' শব্দটি নিয়ে। তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে। কিন্তু বিভিন্ন জাতিসত্তার আদিবাসী সমাজ তা মানতে নারাজ। সম্ভবত 'ক্ষুদ্র' শব্দটি তাদের জাতিগত মর্যাদাবোধে আঘাত করছে। অন্যদিকে সরকার এ বিষয়ে মনে হয় অনড়।
এ সমস্যা সহজে মেটার নয়। বিষয়টি নৃতাত্তি্বক-জনতাত্তি্বক বিচার-ব্যাখ্যা দাবি করে, যা জাতীয় গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে যথেষ্ট জটিল। আমার ধারণা, 'আদিবাসী'র শাব্দিক সমস্যা পূর্বোক্ত চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করবে। এবং শান্তিচুক্তিবিরোধী বাঙালি-পাহাড়িগোষ্ঠী খুশিতে হাততালি দেবে এই ভাবনায় যে_যাক, নতুন সমস্যা চুক্তি বায়স্তবায়নের পথটা বন্ধ করে দেবে।
এমন একটা বদ্ধাবস্থার আভাস পাওয়া যাচ্ছে কয়েক সপ্তাহ ধরে পাহাড়ি নেতাদের বিবৃতি ও প্রতিক্রিয়ায় এবং সেই সঙ্গে সরকারি চিন্তাভাবনায়। 'আদিবাসী' শব্দটি এখন দুই পক্ষের মাঝখানে একটা বিরাট ব্যবহারিক পাহাড়ি বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। যা অতিক্রম করা খুব কঠিন। 'আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস' উপলক্ষে ব্যক্ত মতামতে তেমন শঙ্কার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এ দিবস উপলক্ষে আদিবাসী নেতাদের বক্তব্য দলমত ও জাতিসত্তা-নির্বিশেষে যথেষ্ট দৃঢ় ও অনড়। বিভিন্ন সমাবেশে তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি উচ্চারিত হয়েছে। এ দাবির যৌক্তিকতা কেউ অস্বীকর করবে না, আগেও করা হয়নি। কিন্তু এখন যুক্তিকে হার মানাতে চলেছে শাব্দিক আবেগ, যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে নৃতাত্তি্বক-জাতিতাত্তি্বক সমস্যা। আবার এর সঙ্গে নতুন করে সমস্যার একাধিক ডালপালা গজাতে শুরু করেছে, যা সমস্যার সমাধান আরো জটিল করে তুলবে।
আদিবাসী নেতাদের সুস্পষ্ট দাবি, 'আদিবাসী' হিসেবে তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পাহাড়ে তাদের জীবনযাপনের সার্বিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাদের ভাষা ও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি চর্চার অধিকার। এবারের 'আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের' থিম 'স্বকীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধারণে রচনা করি নিজেদের ভবিষ্যৎ' তাদের আরো উদ্দীপ্ত করেছে এবং প্রতিবাদী হতে প্রেরণা জুগিয়েছে। রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি থেকে শেরপুর, নাটোর, হবিগঞ্জ হয়ে সর্বত্র অর্থাৎ আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায়_কী পাহাড়ে কী সমতলে তাদের যথাযথ সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে বিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেছেন : 'আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ বছর আইন পড়িয়েছি। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এ দেশে বসবাসকারী ভাষাগত সংখ্যালঘুরা সবাই আদিবাসী।' কিন্তু তিনি তাঁর বক্তব্যের পক্ষে তথ্য-যুক্তি সহকারে তাত্তি্বক ব্যাখ্যা দেননি। দিলে ভালো হতো। কারণ 'আদিবাসী' শব্দটি নিয়ে বিতর্কের মুখে এর তাত্তি্বক সংজ্ঞা দেওয়া দরকার ছিল।
অন্য এক অনুষ্ঠানে জনাব মিজানুর রহমান বলেছেন : 'আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে রাষ্ট্র নিরাপত্তাভীতিতে ভুগছে। এ ভীতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নয়। রাষ্ট্রের একটি বিশেষ মহল থেকে এ ভীতির সঞ্চার করা হয়েছে।' তিনি মহলের নাম উল্লেখ করেননি। তবে আমরাও মনে করি, স্বীকৃতি পাহাড়িদের বিচ্ছিন্নতার পথে ঠেলে দেবে না, বরং তাদের পূর্বপুরুষদের বাসস্থানে মৃত্তিকা-ঘনিষ্ঠ হতে সাহায্য করবে এবং তা বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতে। বাংলাদেশের সংবিধানকে এ কাজটুকু করতেই হবে। বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে আরেকটি যুক্তি হচ্ছে, তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির পরিপ্রেক্ষিতেই স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করে শান্তিচুক্তিতে সই করে বসবাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের পক্ষে দরকার সর্বাত্মক সহযোগিতা।
কিন্তু বাঙালি বসতি ও ভূমি জরিপ ইত্যাদি বিষয় কেবল সমস্যা তৈরি করে চলছে। কিন্তু সরকার একটি স্বচ্ছ মূলনীতির ভিত্তিতে এসব সমস্যার সমাধানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসছে না। আমাদের রাজনীতিকরা ভুলে গেছেন যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ভিত্তিতে। আর সে প্রচেষ্টায় আদিবাসীদেরও ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। বর্তমান শান্তিচুক্তি তো আদিবাসীদের নিরাপত্তা ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতি চর্চার বিশেষ কিছু অধিকারের ভিত্তিতেই। এর বেশি কিছু নয়। তাহলে বিচ্ছিন্নতার ভয় কেন? আর ওরাও জানে, কাজটা অসম্ভবই প্রায়।
আর সরকারকে নির্মোহ বিচারে বুঝতে হবে যে আদিবাসীরা এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে_কিছু ঘটনা তার প্রমাণ। অপহরণ, হামলা বা নির্যাতন রাষ্ট্রপক্ষে উপনিবেশবাদী বা আধিপত্যবাদী চেতনারই পরিচয় দেয়। তা ছাড়া রয়েছে তাদের ভূমি সমস্যা, কৃষি সমস্যার মতো বিষয়াদি। কোনো বিষয়েই সরকারপক্ষ থেকে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে দেখা দিচ্ছে সংশয় ও আস্থাহীনতা।
বাংলাদেশ এখনো যেহেতু সংবিধান মোতাবেক বাঙালির জাতীয়তাবাদী ভাষিক রাষ্ট্র বিপুল বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে, তাই আদিবাসীদের ওপর বাঙালিয়ানার দাপট সহজেই ঘটে থাকে এবং রাষ্ট্রযন্ত্র এর প্রতিকারে ততটা দৃঢ়তা দেখায় না। বিভিন্ন ঘটনা তার প্রমাণ। স্বভাবতই আদিবাসীদের পক্ষে নিরাপত্তাহীনতা ও অসহায়তা।
এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর ওপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করছি না। কিন্তু করা দরকার। দরকার পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টির প্রয়োজনে। আমরা তো মানবাধিকার নিয়ে অনেক কথা বলে থাকি_সরকারি, বেসরকারি সব পর্যায়েই। আর আদিবাসীদের অধিকারগুলো তো মানবাধিকারেরই অন্তর্ভুক্ত, এ সত্য আমাদের বুঝতে হবে।
'আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস' উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন যা বলেছেন তা-ও অনুধাবনযোগ্য। বিশ্বে পাঁচ হাজার জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত আদিবাসী জনসংখ্যা ৩৭ কোটির মতো। সংখ্যাটা নেহাত ছোট নয়। আদিবাসীদের সমস্যা সম্পর্কে জাতিসংঘ যথেষ্ট অবহিত। সে জন্য মহাসচিব সমস্যার সমাধানে সবাইকে যুক্তিবাদী ও বাস্তববাদী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
জনসংখ্যায় ছোট ও অপ্রচলিত ভাষাভাষী গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে জাতিসংঘ যদি 'আদিবাসী' হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে, তাহলে তা মেনে নিতে আমাদের আপত্তির কী কারণ থাকতে পারে? তা ছাড়া লক্ষ করার বিষয় যে 'আদিবাসী' শব্দটি নিয়ে বিতর্ক একেবারে হালের। প্রশ্ন : কে বা কারা কী উদ্দেশ্যে বিতর্কের বিষয়টাকে হঠাৎ করে রাজনীতির মাঠে ছুড়ে দিয়েছে। আড়াই বছর আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে তো শব্দটা বহালতবিয়তে অবস্থান করেছে। এখন এমন কী ঘটল যে একে অস্বীকার করতে হবে?
বিতর্কে না গিয়ে তবু বলি, যে সদিচ্ছা ও শুভবুদ্ধি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন, এখন সে সদিচ্ছার প্রকাশ না ঘটানোর পক্ষে কোনো কারণ বা যুক্তি নেই। তাই বৃথা বিতর্কে কান না দিয়ে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ পূর্বস্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে একটা বড়সড় সমস্যার সমাধান সম্ভব হতে পারে। তাতে রাষ্ট্রের লাভ বই লোকসান হবে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি অহেতুক ভয় আমাদের মনে বাসা বেঁধেছে যে এদের সুবিধা দিলে অন্যত্র অসন্তোষ মাথাচাড়া দিতে পারে। যে 'অন্যত্র' বহুজাতিক-বহুভাষিক ভারতে থাকতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে তা নেই।
সবশেষে আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে আপাত-অপ্রাসঙ্গিক হলেও মূলত প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলতে হয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত দু-কলাম সাইজের একটি ছোট খবরের সুবাদে। খবরের শিরোনাম_'প্রকৃতির দয়ায় বেঁচে আছে ওরা'। খবর খাগড়াছড়ির দীঘিনালার কয়েকটি দুর্গম পার্বত্য গ্রামের আদিবাসীদের জীবনযাত্রা নিয়ে। ওরা বেঁচে আছে। তবে ওই বেঁচে থাকাকে আধুনিক সমাজের মানদণ্ডে বেঁেচ থাকা বলা চলে না।
একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিয়মতান্ত্রিক দায়িত্ব জাতি-ধর্ম, শ্রেণী-নির্বিশেষে তার প্রতিটি নাগরিকের অন্ন-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থানসহ তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু এসব মৌলিক অধিকারের কোনোটাই উলি্লখিত প্রান্তিক আদিবাসীদের জন্য কার্যকর নয়। তাদের জীবনযাপনের সমস্যাদির খবর রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে পেঁৗছায় না। জনপ্রতিনিধিরা এদের খবর রাখেন না। কচিত কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকের হঠাৎ খেয়ালে যদি এমন কিছু খবর কাগজে ছাপা হয়, তাহলে তা হয়তো বা কোনো মননশীল পাঠকের চিত্ত স্পর্শ করবে, রাজনীতিমনা পাঠক রাষ্ট্রযন্ত্রকে আপন মনে দু-কথা শুনিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা লাভ করবেন। কিন্তু এই দুস্থ জীবনযাত্রার ছবি আঁকা অক্ষরগুলো সাধারণত রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্মতৎপর বৃত্তে পেঁৗছাবে না। ওরা যে আঁধারে সে আঁধারেই থেকে যাবে। 'আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস' তাই আনুষ্ঠানিকতার দায় মেটায়। আমার মনে হয়, এদিকটা নিয়েও সরকারের ভাবা উচিত, যেমন আমরা বলি তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের দায় মেটানোর কথা। একই কথা এখানেও খাটে।
লেখক : রবীন্দ্র গবেষক, কবি, প্রাবন্ধিক, ভাষাসংগ্রামী

No comments

Powered by Blogger.