বিশ্ববিদ্যালয়-নিয়োগক্ষমতাশূন্য উপাচার্য চাই by তুহিন ওয়াদুদ

বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। স্বায়ত্তশাসন যতখানি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চা তথা মুক্তবুদ্ধির অবাধ ক্ষেত্র বাধাগ্রস্ত না হয়, ততখানি স্বায়ত্তশাসনই আমাদের প্রত্যাশা। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো নিয়োগক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ক্ষমতার বাইরে রাখলে স্বায়ত্তশাসন সামান্য একটু বাধাগ্রস্ত হলেও আশা করি জ্ঞানচর্চায় কোনো ক্ষতি হবে না।


বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ-প্রক্রিয়া থেকে যদি উপাচার্যমুক্ত রাখা যায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক অনিবার্য নেতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। বর্তমান প্রেক্ষাপটে একজন উপাচার্য চাইলেও নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। কারণ, তাঁদের নিয়োগ নিরপেক্ষ নয়। একজন অধ্যাপক যখন বিশেষ কোনো দলের বিশেষ আনুগত্যকে পুঁজি করে উপাচার্য হন, তখন সেই দলে অনেকের ফোনবার্তায়ও চাকরি দিতে হয়। কখনো কখনো হয়তো সরকারি দলের অজুহাতে নিকটজনদেরও চাকরির ব্যবস্থা হয়। একজন উপাচার্যের হাতে নিয়োগক্ষমতা থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দলের শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে দলীয় লোকজনদের চাকরিতে অনুপ্রবেশ(!) ঘটানো হয়। আবার যাঁরা উপাচার্যের বিশেষ সহযোগিতায় নিয়োগ পান, তাঁরা অধিকাংশই নিরপেক্ষ থাকেন না, তাঁদের কাছে নীতিপক্ষ বলে কিছু নেই, তাঁরা হয়ে ওঠেন উপাচার্যপক্ষ। নিয়োগ-পদোন্নতি—সবকিছু উপাচার্যের হাতে থাকার কারণে শিক্ষক থেকে সকল স্তরের চাকরিজীবীরা উপাচার্যের ওপর নির্ভর করে চলেন। অনেক শিক্ষক হয় তাঁর পদোন্নতির জন্য কিংবা নিকটজনদের চাকরির চেষ্টা থেকে নীতিনৈতিকতা হারিয়ে ফেলেন। উপাচার্য মহোদয় তাঁদের সামনে সম্ভাবনা ঝুলিয়ে স্বপক্ষের সংখ্যা বাড়িয়ে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, অনেক সময় উপাচার্যের নিকটজনেরা মেধাবী হলেও তাঁদের মেধার মূল্যায়ন প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়। যেমন একজন উপাচার্যের কয়েকজন আত্মীয় হয়তো তাঁদের মেধার পরিচয় দিয়ে চাকরিতে আসতে পারতেন, কিন্তু উপাচার্যের নিকটজন হওয়ার কারণে তাঁদের সেই যোগ্যতা চাপা পড়ে যাচ্ছে আত্মীয় পরিচয়ের আড়ালে। নিকটজনেরা চাকরিপ্রার্থী হলেও অনেক সময় দেখা যায়, সেই বোর্ডে উপাচার্য নিয়োগ বোর্ডপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। উপাচার্য বোর্ডের কেউ না হলে যে আত্মীয় পরিচয় গৌণ হবে, তাও নয়। যেভাবেই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যখন এসব কাজ করতে বাধ্য হন অথবা করতে পছন্দ করেন, তখন কিন্তু তিনি সমাজে একজন নীতিবর্জিত মানুষ হিসেবে পরিচিত হন।
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে আলোর স্ফূরণ ঘটানোর স্থান। তার প্রধান কর্তাব্যক্তি হবেন নক্ষত্রতুল্য। তাঁকে দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারী তথা দেশবাসী শিখবেন। তা না হয়ে দেখা যায়, যাঁরা তাঁর কাছ থেকে শেখার কথা, তাঁদের প্রত্যেকেই উপাচার্যদের সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হন! উপাচার্যরা যদি এই নিয়োগ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত না থাকেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তেমন বিশেষ কোনো ক্ষতি সাধন হয় না। যে দায়িত্ব থাকলে কলুষিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়, সেই দায়িত্ব অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের থাকার প্রয়োজন নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগক্ষমতা উপাচার্যদের হাতে থাকার কারণে দেশের একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতি নীতিমালা একেক রকম। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালার সঙ্গে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালার মিল নেই। এডহক নিয়োগের বৈধতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্সে উল্লেখ আছে। সে বৈধতার সুযোগে যাচ্ছেতাই নিয়োগের সুযোগ থেকে যায়। এমনও দেখা গেছে, এডহক নিয়োগ দিয়ে ছয় মাস পরপর মেয়াদ শুধু বাড়ানো হচ্ছে। এতে করে ওই শিক্ষক উপাচার্যের কবলে থাকবেন। আর তা ছাড়া অধিকাংশ এডহক নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তির ভেতরের মানুষটি হয় মেরুদণ্ডহীন। নিজের মেরুদণ্ড খুলে রেখে জাতির মেরুদণ্ড নির্মাণের কাজ তাঁদের দিয়ে সম্ভব নয়। কখনো কখনো অযোগ্য ব্যক্তিদের এডহকভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় এবং অভ্যন্তরীণ প্রার্থী হিসেবে যোগ্যতা শিথিল করা হয়। সিন্ডিকেটে এসবের অনুমোদন হয়। সিন্ডিকেট তো আর আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তাই এ রকম নিয়োগগুলো আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
নিয়োগ-প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ কাজটি করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ—এ কথা বলে যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন যে সেখানে দুর্নীতি হবে না, সে কথার নিশ্চয়তা কে দেবে? সহজ উত্তর হচ্ছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে দিয়ে দুর্নীতি করালে যত সহজে সমাজের মধ্যে ব্যাধিটি ছড়িয়ে পড়বে, তত দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ দিলে ছড়াবে না। মঞ্জুরি কমিশন নিয়োগের কাজটি স্বচ্ছতার সঙ্গে করবে বলে বিশ্বাস করি। বর্তমানে উপাচার্যের বিরুদ্ধে উচ্চপর্যায়ের কেউ প্রতিবাদ করলে, তার কাউকে চাকরির বিনিময়ে ম্যানেজ করা সম্ভব হয়। নিয়োগের কর্তৃত্ব না থাকলে সেটা যখন সম্ভব হবে না, তখন একজন উপাচার্য ভালো ভালো কাজের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকবেন।
তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে বিশ্বদ্যািলয়ের শিক্ষকদের রাজনীতিবিষয়ক সম্পর্ক থাকা সমীচীন নয়। উপাচার্যদের স্বার্থে অনেক সময় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রয়োজন হয়। কারণ, তাঁরা যখন নির্বিচারে অন্যায় করতে চান এবং প্রতিপক্ষ দলের বিরোধিতা পছন্দ করেন না, তখন তাঁদের প্রয়োজন হয় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোর। নিয়োগের মতো বড় একটি বিষয় থেকে মুক্ত থাকলে ছাত্রসংগঠনগুলোকে ব্যবহারের আর কোনো প্রয়োজন হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় একজন উপাচার্যকে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয়। সেই সময় একজন উপাচার্য প্রশাসনিক এবং অ্যাকাডেমিক কোনো কাজে ব্যয় করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে।
আমরা উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার পরও ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ ত্যাগ করতে পারিনি। তাই আমাদের এ অবস্থা। রাজনীতির নোংরামি থেকে বের হয়ে আসতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বহুস্তরবিশিষ্ট নিয়োগ-প্রক্রিয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে আলাদা শেল গঠন করা প্রয়োজন।
নিয়োগ-কর্তৃত্ব থাকার কারণে সৃষ্ট সমস্যা উত্তরণের জন্য যদি কর্তৃত্ব তুলে দিয়ে সমস্যা সমাধান করা যায়, তাতে করে উপাচার্যরাও বোধ করি অনেক সম্মানের সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
ড. তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.