দ্য রাশিয়ান লাইন্সম্যান

তোফিক বাহরামফ নয়, ইতিহাস তাঁকে মনে রেখেছে ‘দ্য রাশিয়ান লাইন্সম্যান’ নামে। এক সিদ্ধান্ত দিয়েই স্মরণীয় হয়ে থাকা এই সহকারী রেফারিকে নিয়ে লিখেছেন রাজীব হাসান কেক তো দূর অস্ত, কোথাও একটা মোমবাতি জ্বলেছে কি না কে জানে! ২৯ জানুয়ারি তাঁর ৮৭তম জন্মদিনটা কেউ মনে রেখেছিলেন কি? শবাধারে কি ফুল নিয়ে গিয়েছিল কেউ?


কেউ কি চিরনিদ্রায় শায়িত তাঁর জন্য এক মিনিট নীরবতা কিংবা প্রার্থনা করেছেন সেদিন? নাকি কবরের ওপর জমেছে বিস্মৃতির ঘাস-লতা, ভুলে যাওয়া ঝরা পাতার দল! তোফিক বাহরামফকে কেনই বা মনে রাখবে ইতিহাস! কী দায় তার!
সত্যি বলতে কি, ফুটবল ইতিহাস তাঁকে তাঁর নাম দিয়ে যতটা না চেনে, তার চেয়েও বেশি চেনে ‘রাশিয়ান লাইন্সম্যান’ হিসেবে। অথচ জাতিগতভাবে তিনি রুশ নন, রাশিয়াতে জন্মও হয়নি তাঁর। ১৯৬৬ সালে তাঁর দেশ আজারবাইজান তখন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। ইংলিশ মিডিয়া অতশত ধার ধারেনি। তাঁকে ‘বিখ্যাত’ করেছে রাশিয়ান লাইন্সম্যান নামে। একসময় এই নামের নিচে চাপা পড়েছে তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম!
তার পরও স্বর্গে বসে বাহরামফ নিশ্চয়ই তৃপ্তির হাসিই হাসেন। তাঁর মতো ইতিহাসে আলোড়ন তুলতে পেরেছেন আর কোনো লাইন্সম্যান? রেফারির আর কোনো সহকারীর মূর্তি আছে? তিনিই তো ইতিহাসের প্রথম রেফারি, যাঁর নামে একটি দেশের জাতীয় স্টেডিয়ামের নামকরণ হয়েছে। আর সেই স্টেডিয়ামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন মিশেল প্লাতিনি, সেপ ব্ল্যাটারের মতো ফুটবল ব্যক্তিত্বরা।
এসেছিলেন জিওফ হার্স্টও। সেদিন বাহরামফের মূর্তিতে অর্ঘ্যও নিবেদন করেছিলেন ১৯৬৬ বিশ্বকাপের নায়ক। তুলে দিয়েছিলেন চারটি লাল টকটকে গোলাপ। প্রায় চার দশক পর যেন না-বলা ধন্যবাদটুকু এভাবেই দিতে চেয়েছেন ইংল্যান্ডকে একমাত্র বিশ্বকাপ এনে দেওয়া হার্স্ট।
১৯৬৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ৪-২ ব্যবধানে হারিয়েছিল জার্মানিকে। হার্স্ট করেছিলেন হ্যাটট্রিক। শুধু স্কোরলাইন দেখলে মনে হবে পরিষ্কার ব্যবধানেই জার্মানদের হারিয়েছিল ইংলিশরা, এ নিয়ে বিতর্কের কী আছে! গ্রন্থকীটেরা এও বলতে পারেন, আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজয়টা মেনে নিতে না পারার মানসিকতাই জার্মানদের তাতিয়ে রেখেছে।
কিন্তু আসল ছবিটা একেবারেই অন্য রকম। ওয়েম্বলির সেই ফাইনালে ৮৮ মিনিট পর্যন্ত ১-২ গোলে পিছিয়ে থাকা জার্মানরা দারুণভাবে ম্যাচে ফিরেছিল ৯০ মিনিট ফুরোবার খানিক আগে ভলফগ্যাং ওয়েবারের গোলে। নির্ধারিত সময়ে ২-২। খেলা গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। খানিক বাদে বোঝা গেল, ফুটবল দেবতা আসলে ইচ্ছে করেই ম্যাচটা নিয়ে গেছেন ১২০ মিনিটে!
অতিরিক্ত সময়ের ১১তম মিনিট। অ্যালান বলের মাপা ক্রস খুঁজে নিল সুযোগসন্ধানী হার্স্টকে। কাছাকাছি দূরত্বে থেকে ইংলিশ স্ট্রাইকারের জোরাল শট। ক্রসবারের নিচের দিকে সজোরে ধাক্কা খেয়ে বল সবেগে নামল নিচের দিকে। মাটিতে একটা ড্রপ খেয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। ইংলিশরা গোল উদ্যাপন শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে, কারণ তাদের দাবি, বল গোললাইন অতিক্রম করেছে। কিন্তু জার্মানদের দাবি একেবারেই উল্টো, বল গোললাইনে পড়েছে, অতিক্রম করেনি। বলের ওপর চকের গুঁড়ো তখনো লেগে আছে!
সিদ্ধান্ত দিতে লাইন্সম্যান বাহরামফের সঙ্গে আকারে-ইঙ্গিতে আলাপ চালালেন রেফারি গটফ্রায়েড ডাইনস্ট। আকার-ইঙ্গিতে কথা চালাতে হলো, কারণ সুইস রেফারি আর সোভিয়েত লাইন্সম্যান কেউ কারও ভাষা বোঝেন না! তবে লাইন্সম্যানের রায় বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না, গোলের বাঁশি বাজিয়ে দিলেন ডাইনস্ট। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন বিতর্কের আগুনেও ফুঁ দিয়ে দিলেন তিনি! যে বিতর্ক এখনো চলছে—গোলটা কি হয়েছিল, নাকি হয়নি!
জার্মানদের যুক্তি ছিল, বলটা গোললাইনের ভেতরের দিকে পড়লে সেটা জালের দিকেই যাওয়ার কথা ছিল, বেরিয়ে আসত না গোলমুখ থেকে। কিন্তু ইংলিশদের পাল্টা যুক্তি, উল্টো-ঘূর্ণনের কারণে বলটা মাটিতে পড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। ইংলিশ ফুটবলারদের মধ্যে গোলের সবচেয়ে কাছাকাছি ছিলেন রজার হান্ট। তাঁরও দাবি, বলটা গোললাইনের ভেতরে পড়েছে বলেই তিনি আর ফিরতি বলে শট নিতে যাননি। এর বদলে শুরু করে দিয়েছিলেন উদ্যাপন।
আসলেই কী হয়েছিল এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। শুধু বিতর্ক? খোদ অক্সফোর্ডের মতো বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটিতে হয়েছে গবেষণাও! ১৯৯৬ সালের সেই গবেষণায় অবশ্য বলা হয়েছে, গোল হওয়া থেকে ৬ সেন্টিমিটার দূরেই ছিল বলটা। সে যাই হোক। ১২০তম মিনিটে নিজের তৃতীয় গোলটি করে জয় সুনিশ্চিত করেছেন হার্স্ট। তার পরও জার্মানরা এই পরাজয়ের পেছনে বড় করে দেখে তাঁদের চোখে না-হওয়া গোলটাকেই।
ইংলিশরাও কিন্তু ওই ১০১তম মিনিটের গোলটিকে অনেক বড় করে দেখে। বাহরামফও তাদের কাছে নায়ক। এ কারণে ২০০৬ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ খেলতে ইংল্যান্ড দলের সঙ্গী হয়ে আজারবাইজানে এসেছিল অনেক ইংলিশ সমর্থক। বাহরামফের কবরে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছিল তারা। ২০০৪ সালের অক্টোবরের ওই সফরেই আজারবাইজান জাতীয় স্টেডিয়ামটির নামকরণ হয় বাহরামফের নামে। উন্মোচিত হয় তাঁর মূর্তি। যে মূর্তিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছিলেন হার্স্ট।

No comments

Powered by Blogger.