মেট্রোরেল প্রকল্প-কাজ শুরুর আগেই ব্যয় বেড়েছে ৭০ কোটি ডলার

শুরুর হওয়ার আগেই প্রস্তাবিত মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় বেড়ে গেছে ৭০ কোটি মার্কিন ডলার বা সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। আগামী মাসে জাপানি সাহায্য সংস্থা জাইকার সঙ্গে এ ব্যাপারে ঋণচুক্তি করা হবে। জাইকা প্রকল্পে ১৮০ কোটি ডলার দেবে। বাকি খরচ সরকার বহন করবে।


মেট্রোরেলের যে অংশটুকু বিজয় সরণি দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তা সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে পথ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ পথের বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি ও পরিবেশবাদীদের আপত্তি আছে। আর বিজয় সরণির পাশ দিয়ে পথ নেওয়ায় আপত্তি ছিল বিমানবাহিনীর।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, দেশ-জাতীর বৃহত্তর স্বার্থ উপেক্ষা করে একটি বিশেষ বাহিনীর অযৌক্তিক দাবিতে অনাহূত জায়গা দিয়ে মেট্রোরেল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এতে যে প্রকল্প ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে, সেটা তাঁরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন। তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্প ভেস্তে যাক, সেটা আমরা চাই না। সরকারের শুভবুদ্ধি উদয়ের সুযোগ এখনো আছে।’
গতকাল সোমবার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে জাইকার প্রতিনিধিদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের বৈঠক হয়। মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব এম এ এন সিদ্দিক সাংবাদিকদের জানান, মেট্রোরেলের ডিপোর (ইঞ্জিন-কোচ রাখা, যাত্রাবিরতি, মেট্রোরেল পরিচালনার স্থান) জন্য নতুন করে ভূমি অধিগ্রহণের কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে গেছে।
তবে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মেট্রোরেলের পথ পরিবর্তনের কারণে সময়ক্ষেপণ ও ডিপোর জন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হওয়ায় ব্যয় বেড়েছে। কাজ শুরু করতে দেরি হলে ব্যয় আরও বাড়তে পারে।
২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময় মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শুরু করার পরিকল্পনা জানিয়েছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ড (ডিটিসিবি)।
গত বছর যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বলেছিল, মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় হবে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। গতকাল বৈঠক শেষে যোগাযোগসচিব বললেন, প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৭০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে প্রায় ১৮০ কোটি মার্কিন ডলার সহজ শর্তে ঋণ হিসেবে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জাইকা। বাকিটা সরকার দেবে। জাইকার ঋণের জন্য সুদ দিতে হবে দশমিক শূন্য ১ শতাংশ হারে। সূত্র জানায়, জাইকা যে ঋণ দেবে তা আগে থেকেই ঠিক করা। বাড়তি এ খরচ নির্বাহ করতে হবে সরকারের রাজস্ব খাত থেকে।
উত্তরা থেকে মেট্রোরেল পল্লবী, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, শাহবাগ, টিএসসি, দোয়েল চত্বর, প্রেসক্লাব হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত যাবে। প্রথমে দোয়েল চত্বর থেকে বঙ্গবাজার, গুলিস্তান হয়ে সায়েদাবাদ যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী উড়ালসড়কের কারণে পথ পরিবর্তন করা হয়। এরপর বিমানবাহিনীর আপত্তির কারণে বিজয় সরণির পথ পরিবর্তন করতে হয়। এভাবে প্রায় এক বছর কেটে যায়।
ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ডের একটি সূত্র জানায়, কালক্ষেপণের কারণে নির্মাণসামগ্রী ও পরামর্শকদের বেতন বেড়ে গেছে। এ জন্য ব্যয়ও বেড়েছে।
সূত্র জানায়, প্রথমে পরিকল্পনা ছিল মেট্রোরেলের ডিপো হবে উত্তরায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) তৃতীয় পর্বের ভূমিতে। কিন্তু রাজউক জমি দিতে রাজি না হওয়ায় এটি উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে একটু দূরে সরিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সচিবের ব্রিফিং: আগামী মার্চের মধ্যে মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি করার কথা জানিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এম এ এন সিদ্দিক বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা (ডিপিপি) প্রস্তুত হয়েছে। এখন এটা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে অনুমোদনের জন্য। ডিপিপি অনুমোদিত হলেই জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি করা হবে।
বিজয় সরণি না সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে যাবে মেট্রোরেল—জানতে চাইলে সচিব বলেন, সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে যাবে। বিষয়টি মীমাংসা হয়েছে। তিনি জানান, প্রকল্পের জন্য উত্তরায় ৫৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। ব্যয় বৃদ্ধির এটাও একটা কারণ। তিনি বলেন, আগে প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৮০ কোটি মার্কিন ডলার। পথ ও অন্যান্য বিষয় চূড়ান্ত করে ডিপিপিতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৭০ কোটি ডলার। চূড়ান্ত নির্মাণকাজ শুরু হলে ব্যয় কম-বেশি হতে পারে বলে জানান তিনি।
ডিটিসিবির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক সালেহউদ্দিন বলেন, ঋণচুক্তির পর প্রকল্পের বিস্তারিত নকশা প্রণয়নে পরামর্শক নিয়োগ করা হবে। আশা করা হচ্ছে, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে বিস্তারিত নকশা হয়ে যাবে। আগামী বছরের মাঝামাঝিতে নির্মাণকাজ শুরু করা যাবে।
অবশ্য জাইকার একটি সূত্র জানায়, জাইকার অর্থবছর শুরু হয় এপ্রিল মাসে। সংস্থাটির ২০১১-১২ আর্থিক বছরের পরিকল্পনায় মেট্রোরেলের অর্থায়ন অন্তর্ভুক্ত করার জন্য গত বছর সেপ্টেম্বরের মধ্যে পথ ঠিক করার সময় বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু সরকার এ সময়ের মধ্যে পথ ঠিক করতে পারেনি। এখন মার্চের মধ্যে না পারলে আগামী অর্থবছরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে মেট্রোরেলের পথ অনুমোদন করার বিষয়ে সালেহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, এতে সংসদ ভবন বা অন্য বড় কোনো ভবনের ক্ষতি হবে না। নির্বিঘ্নেই মেট্রোরেল চলাচল করতে পারবে।’
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন এ পথের বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখনো মনে করি, সার্বিক বিবেচনায় বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেলের পথ সবচেয়ে উপযুক্ত।’ তিনি বলেন, ‘বিজয় সরণির পরিবর্তে জাতীয় সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে নেওয়ার নকশাটা কে বা কারা করছে, কোন বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে এটা উপযুক্ত পথ, আমরা তাঁর বা তাঁদের নাম-পরিচয় জানতে চাই।’
জাইকার সমীক্ষায় বলা হয়েছে, মেট্রোরেল নির্মাণের পর এর মাধ্যমে ঘণ্টায় গড়ে ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। ২০ কিলোমিটার পথে ১৬টি স্টেশন থাকবে।
জাইকা সূত্র জানিয়েছে, ঠিক করা পথে মেট্রোরেল হলে সংসদ এলাকার ৫৫ মিটার ভেতরে ঢুকতে হবে। সে ক্ষেত্রে লম্বালম্বি এ ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। আর সংসদ ভবনের জমি বাঁচাতে গেলে খামারবাড়ীর ১২ তলা তিনটি ভবন, ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল ভাঙা পড়তে পারে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, মাটি থেকে প্রস্তাবিত মেট্রোরেল পর্যন্ত ফাঁকা জায়গা থাকবে সাড়ে ১২ মিটার। সব মিলিয়ে মেট্রোরেলের উচ্চতা হবে প্রায় ১৯ মিটার।

No comments

Powered by Blogger.