দুর্নীতি বাড়ছে নিষ্ক্রিয় দুদক by হকিকত জাহান হকি

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি নিষ্ক্রিয় সংস্থায় পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দুর্নীতি দমনে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না দুদক। তাদের অভিযোগ, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং দুদকে সাহসী নেতৃত্বের অভাবেই সংস্থাটির আজ এ পরিণতি। সেনা সমর্থিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতির অভিযোগে সমাজের রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে দুদক অভিযান চালিয়েছিল। যদিও দুদকের সে সময়কার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বর্তমানে আর সেরকম কিছু লক্ষ্য করা যায় না। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান না থাকার কারণে সমাজে দুর্নীতি বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এরই মধ্যে দু'একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।


প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে।সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, মহাজোট সরকারের প্রধান দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দুর্নীতি দমনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হলেও বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে সংস্থাটিকে শক্তিশালী এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়; কিন্তু বর্তমানে দুদক আইন সংশোধনের নামে এ প্রতিষ্ঠানকে আরও অকার্যকর করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনী ইশতেহারে রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা এবং পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়। প্রতিটি দফতরে গণঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক সনদ উপস্থাপন এবং সরকারি কাজ ব্যাপকভাবে কম্পিউটারাইজড করে দুর্নীতির পথ বন্ধ করারও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়; কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকার তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছে। এ কারণে দুর্নীতি ডালপালা বিস্তার করার সুযোগ পাচ্ছে। দুদক
চেয়ারম্যান গোলাম রহমান দায়িত্ব গ্রহণের অল্প ক'দিন পর সাংবাদিকদের সামনে আলোচিত এ প্রতিষ্ঠানকে 'দন্তহীন ব্যাঘ্র' হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ২০০৯ সালের ২৪ জুন দায়িত্ব গ্রহণের পর আড়াই বছর কেটে গেলেও দন্তহীন এ ব্যাঘ্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুদক নামের এ বাঘটির গর্জন ছিল। এখন আর তা নেই। কাজকর্ম চলছে ঢিমেতালে। দুর্নীতি দমন অভিযান নেই বললেই চলে।
দুদকের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানটি মূলত ছোট ছোট দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান, মামলা, তদন্ত ও চার্জশিটের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। বিগত দিনের তুলনায় মামলার সংখ্যা কমেছে। চার্জশিটের সংখ্যা বাড়লেও বিচারিক প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য নেই বললেই চলে। বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব গ্রহণের পর বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হচ্ছে বেশি। অথচ সরকারের মন্ত্রী, আমলা ও প্রভাবশালীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযান-অনুসন্ধান করা হচ্ছে না। এ কারণে সমালোচনাও কম হচ্ছে না। কিন্তু দুদক ও সরকার নীরব।
মহাজোট সরকারের প্রায় তিন বছর হতে চলেছে। দুদককে শক্তিশালী না করায় এবং দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদার না হওয়ায় সমাজে হতাশা বাড়ছে। দুদক আইন সংশোধনের নামে চলে গেছে আড়াই বছর। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান সমকালকে বলেন, দুদককে শক্তিশালী করা ও উন্নয়নের বাধা দুর্নীতি দমন করা এ সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হলেও ক্ষমতায় আসার পর এ ক্ষেত্রে কোনো কাজ করা হয়নি। সরকারের এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা না হলে আগামী নির্বাচনে জনগণের সামনে এ বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে।
দুদক নিষ্ক্রিয়_ এ দাবি মানতে নারাজ দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) এম বদিউজ্জামান। দুদকের বর্তমান কার্যক্রম নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে সমকালকে তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে দুদক সক্রিয়। স্বাধীনভাবেই কাজ করছে এ প্রতিষ্ঠান। কোনো দল বা মতের কাউকে ছাড় দিয়ে কাজ করছে না। দুদকের বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি যা-ই বলুন না কেন এর বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন দুর্নীতিবাজরা দুদকের কথা শুনে আর ভয় পায় না। দুর্নীতিবাজরা অবাধে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে। কখন কার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসবে সে অপেক্ষায় থাকে দুদক কর্তৃপক্ষ। অথচ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দুর্নীতি, প্রতারণা, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানের আইনগত সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগানো হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ), বিআরটিএ, পরিবেশ অধিদফতর, শিক্ষা অধিদফতর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর, সমাজসেবা অধিদফতরসহ বিভিন্ন দফতর, অধিদফতরে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক এসব দুর্নীতি বন্ধের কার্যক্রমও মুখ থুবড়ে পড়েছে। একই সঙ্গে ফাঁদ পেতে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ ধরার কার্যক্রম বন্ধের পথে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে কমিশনার এম বদিউজ্জামান বলেন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জরুরি অবস্থায় বিশেষ ক্ষমতাবলে পরিচালিত হতো দুদকের কার্যক্রম। জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সময় জারি করা অধ্যাদেশও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ। এ পরিবেশে যেভাবে কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার কথা সেভাবেই হচ্ছে। তিনি বলেন, দুদকের কার্যক্রম আগের মতো জোরদার করতে হলে জরুরি অবস্থা জারি করতে হবে। বিগত সময়ে জরুরি অবস্থা চলাকালে আইনের বাইরেও অনেক কাজ করা হয়েছে, যা এখন ভুল প্রমাণিত হচ্ছে।
মন্ত্রী, এমপি, আমলাসহ অন্যান্য প্রভাবশালী দুর্র্নীতি করছেন কি-না এবং তারা দুর্নীতি করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ-অনুসন্ধান করা হচ্ছে না কেন_ এসব প্রশ্নের জবাবে কমিশনার সমকালকে বলেন, 'তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তো আসতে হবে। অভিযোগ না পেলে অনুসন্ধান করব কীভাবে?' দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারপক্ষের লোকজনকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে কি-না_ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সরকারকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না বলে তিনি দাবি করেন।
যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের দুর্নীতির অভিযোগ বেশি অনুসন্ধান করা এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দুদকের নিরপেক্ষতা নিয়েও মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে কমিশনার বলেন, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তাই অনুসন্ধান করা হচ্ছে। মামলা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, মহাজোট সরকারের প্রায় তিন বছর পর নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতির দুটি অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে। এ ছাড়া বগুড়া ও শেরপুর জেলার দুই এমপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে দুটি মামলা করা হয়েছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আর কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের কোনো অভিযোগ পায়নি দুদক। এদিকে বিরোধীদলীয় নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ দলের শীর্ষস্থানীয় অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করা হয়েছে গত আড়াই বছরে।
দুদক সূত্র জানায়, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে দুর্নীতির অভিযোগে ৭০১টি ও ২০০৮ সালে ৯৭৯টি মামলা করা হয়। ২০০৭ সালে ১৭০টি ও ২০০৮ সালে ৩৯৭টি চার্জশিট পেশ করা হয় আদালতে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে দুর্নীতির অভিযোগে ২৩৪টি ও ২০১০ সালে ২৭৩টি মামলা করা হয়। ২০০৯ সালে ৪৭৫টি ও ২০১০ সালে ৫৩৬টি চার্জশিট পেশ করা হয় আদালতে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মামলা করা হয়েছে ২৭৭টি এবং চার্জশিট পেশ করা হয়েছে ৪৭৭টি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট চলছে। অথচ এসবের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, দুদকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সাহসী নেতৃত্ব প্রয়োজন। দুর্বল নেতৃত্ব দিয়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শক্তিশালী করা সম্ভব হবে না। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশে যত ধরনের অপকর্ম হচ্ছে তার মূলে রয়েছে দুর্নীতি। শক্তিশালী অভিযান ছাড়া অবাধ দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব নয়। আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকও একই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দুদককে শক্তিশালী করা জরুরি। একই সঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদার করতে হবে। তিনি বলেন, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী দুর্নীতির শিকার হয় বেশি। ঢালাও দুর্নীতির কারণে দরিদ্র জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে না।
দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। সৌদি আরব যাওয়ার আগে তিনি সমকালকে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দুর্নীতি দমন অভিযান জোরদারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, গণসচেতনতা, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমের সমর্থন, কমিশনের কার্যক্ষমতা ও বিচার বিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কমিশন মনে করে, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর সংশোধনকল্পে আনীত বিল কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সংসদে গৃহীত হলে তা হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে কেবল আইন প্রণয়নই দুর্নীতি দমনের জন্য যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং বিচার বিভাগের দুর্নীতি মামলা নিষ্পত্তিতে দৃঢ় ও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ।

No comments

Powered by Blogger.