হাতির ঝিল প্রকল্পে বেআইনিভাবে প্লটপ্রাপ্তদের সম্পর্কে হাইকোর্ট-সবাই চোর

যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া যাঁরা হাতির ঝিল এলাকায় প্লট পেয়েছেন তাঁরা সবাই চোর- মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। হাতির ঝিল প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ বিষয়ে শুনানির সময় যায়যায়দিন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক শফিক রেহমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী জিয়াউল হক জিয়ার ছেলেকে সামনে দাঁড় করিয়ে এ মন্তব্য করেন আদালত।


এদিকে কারওয়ান বাজার হাতির ঝিল-বেগুনবাড়ী প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে কোনো রকম অনিয়ম হয়েছে কি না, তা তদন্তের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে তাঁর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ কমিটিকে ১৫ জুলাই আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
ওই তদন্ত কমিটিতে অন্য যে চারজনকে রাখতে বলা হয়েছে তাঁরা হলেন আইন, স্বরাষ্ট্র, গণপূর্ত ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব।
একই সঙ্গে সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, জিয়াউল হক জিয়া ও যায়যায়দিনের সাবেক সম্পাদক শফিক রেহমানের বিষয়ে তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ তিনজনের বিষয়ে ১৫ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। এ প্রকল্পে ২০০২ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কে, কী পরিমাণ প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন এর তালিকা ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে আদালতে দাখিল করার জন্য পূর্তসচিবকে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে বন্যাদুর্গতদের জন্য স্পেক্ট্রাম রেডিওর মাধ্যমে লন্ডনে যে সাহায্য তোলা হয়েছে সে বিষয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তদন্তের অবস্থা এবং ওই ঘটনা সম্পর্কে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী জিয়াউল হক জিয়ার ছেলে জয়কে সোয়া দুই ঘণ্টা হাইকোর্টে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এ ঘটনায় আদালতে উত্তপ্ত শুনানি হয়েছে। প্রবীণ আইনজীবী টি এইচ খান বলেছেন, নাগরিকদের ডেকে এনে দাঁড় করিয়ে রেখে অসম্মান করা হচ্ছে। এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে পিক অ্যান্ড চুজ নীতির ভিত্তিতে আদেশ দেওয়া হচ্ছে। জবাবে আদালত বলেন, কোথাও কোনো অনিয়ম হলে সেটা দেখা আদালতের দায়িত্ব।
বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চে গতকাল এ শুনানি হয়। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় নিয়মবহির্ভূতভাবে প্লট পাওয়ার অভিযোগে হাইকোর্ট দুই সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও শফিক রেহমানকে তলব করেছিলেন। গতকাল তাঁদের উপস্থিতিতে শুনানি শেষে আদালত কয়েকটি আদেশ দেন।
হাইকোর্টে শফিক রেহমান
গতকাল সকাল ১১টা ১৫ মিনিটের দিকে দুই বিচারপতি এজলাসে এসে আসন গ্রহণ করেন। এর পরই আদালতে হাজির হন যায়যায়দিন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক শফিক রেহমান। ১৫ মিনিট পর প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে আদালত বিবাদীদের দাঁড়াতে বলেন। কাঠগড়ার কাছাকাছি এসে দাঁড়ান শফিক রেহমান, কামরুল ইসলাম, জিয়াউল হক ও তাঁর ছেলে জয়। অসুস্থতার কারণে আদালত জিয়াউল হক জিয়াকে বসার অনুমতি দেন। শুরুতে শফিক রেহমানের আইনজীবী আসাদুজ্জামানের কাছে আদালত জানতে চান আদেশের জবাব কোথায়? জবাবে আসাদুজ্জামান বলেন, শফিক রেহমানকে আসতে বলা হয়েছে। কোনো রুল ইস্যু হয়নি। এ সময় হাইকোর্ট বলেন, তাঁকে অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে। তাঁর চেহারা দেখতে ডাকা হয়নি। এ পর্যায়ে আদালত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আলতাফ হোসেনের বক্তব্য জানতে চান। সরকারি এ কর্মকর্তা বলেন, খুবই গুরুতর অভিযোগ এসেছে। জনগণের সম্পত্তি এভাবে বরাদ্দ দেওয়া যায় না। এটা রিকশাওয়ালাদের সম্পত্তি। পানির দরে এ সম্পত্তি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, 'শফিক রেহমানের তত্ত্বাবধানে লন্ডনে স্পেক্ট্রাম নামের একটি রেডিও ছিল। ওই রেডিওর মাধ্যমে বাংলাদেশে বন্যাদুর্গতদের জন্য টাকা ওঠানো হয়েছিল। কিন্তু ওই টাকা বন্যাদুর্গতদের কাছে আসেনি। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ঘটনার তদন্ত করছে। ওই তদন্ত এখন কী পর্যায়ে আছে, তা আমার জানা নেই।' তিনি বলেন, 'যাঁদের আমরা অনুসরণ করি, তরুণ প্রজন্ম অনুসরণ করে তাঁদের যদি এ অবস্থা হয় তা খুবই দুঃখজনক।' এ সময় হাইকোর্ট বলেন, তদন্তে যদি নির্দোষ হন, তাহলে ক্লিয়ার হবেন, না হয় তাঁকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া মোকাবিলা করতে হবে। এ পর্যায়ে আদালত ওই তদন্তের অবস্থা এবং ওই ঘটনা সম্পর্কে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে নির্দেশ দেন।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, শিল্প প্লট বরাদ্দে কোনো ধরনের আইন অনুসরণ করা হয়নি। এ সময় হাইকোর্ট বলেন, ক্ষমতাবানদের এসব প্লট দেওয়া হয়েছে। যাদের ওজন আছে তাদের পানির দামে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরপর আদালত শফিক রেহমানের আইনজীবীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। প্রশ্নের জবাবে আইনজীবী বলেন, যায়যায়দিন পাবলিকেশনস লিমিটেডের নামে ২০০৩ সালে এক একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। শফিক রেহমান ওই কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কম্পানিতে তাঁর স্ত্রী ও ছেলের নামে শেয়ার রয়েছে। আসাদুজ্জামান বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শফিক রেহমান ওই কম্পানি থেকে উচ্ছেদ হন। তিনি যায়যায়দিন পত্রিকায় প্লাস টু এবং মাইনাস থ্রি সম্পর্কে একটি লেখা লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, খালেদা-হাসিনা প্লাস হবেন, ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দীন-মইন মাইনাস হবেন। এ লেখার জন্য তাঁকে যায়যায়দিন এইচআরসি নামের একটি কম্পানিকে লিখে দিতে বাধ্য করা হয়। এ জন্য তিনি কোনো অর্থ পাননি। একপর্যায়ে রাজউকের আইনজীবী কে এম সাইফুদ্দিন ও আসাদুজ্জামান ওই এলাকায় অন্য যাঁরা প্লট পেয়েছেন তাঁদের তালিকা তলব করতে বলেন।
সবাই চোর
এ সময় হাইকোর্ট বলেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া যাঁরা সেখানে প্লট পেয়েছেন তাঁরা সবাই চোর। আদালত বলেন, জমি বরাদ্দের সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে রাজউক যেটা করে (বিজ্ঞাপন দিয়ে দরখাস্ত আহ্বান করে)। এ ক্ষেত্রেও আপনাকে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। সেটা পত্রিকায় দেন আর টিভিতেই দেন। এটা (বিজ্ঞাপন) ছাড়া যারা জমি নেবে, সবাই চোর। কারণ এটা তো জনগণের সম্পত্তি, তাদের না জানিয়ে এটা দেওয়া যায় না।
আসাদুজ্জামানের বক্তব্য শেষে আদালত আবারও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আলতাফ হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আদালত বলেন, কামরুল ইসলামের সম্পত্তির ব্যাপারে আপনারা কী জানতে পেরেছেন? ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ সময় একটি তালিকা পড়ে শোনান। যাতে বলা হয়েছে. ঢাকায় কামরুল ইসলাম ও তাঁর পরিবারের ১১টি এবং ঢাকার বাইরে তিনটি বাড়ি অথবা প্লট রয়েছে।
উত্তপ্ত শুনানি
কামরুল ইসলামের আইনজীবী টি এইচ খান শুনানিতে অংশ নিয়ে বিচারপতিকে উদ্দেশ করে বলেন, 'বসে থেকেই আমি কিছু বলতে পারব কি না- এটা আপনার দয়ার ওপর নির্ভর করছে।' আদালত প্রবীণ এ আইনজীবীকে বসেই বলার অনুমতি দেন। এ সময় টি এইচ খান বলেন, 'অনেক কথা আইনের বইতে লেখা থাকে না। তবুও আমরা তা অনুসরণ করি। এটাই সভ্যতা, ভদ্রতা। আপনারা আদালতে এলে আমরা দাঁড়িয়ে যাই। এটা কোনো বইতে লেখা নেই। তবুও আমরা এটা করি। এ আদালতকক্ষ অত্যন্ত পবিত্র জায়গা। আপনি নোটিশ দিয়েছেন। আপনার নোটিশ না পেয়ে পত্রিকা দেখেই তাঁরা (হাজির হওয়া ব্যক্তিরা) আদালতে হাজির হয়েছেন। তাঁরা অপরাধী নন। আপনি তাঁদের দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, তাঁদের অসম্মান করছেন।' এ সময় হাইকোর্ট বলেন, 'আমরা তো আইনজীবীদের চেয়ার তাঁদের দখল করতে দিতে পারি না। জবাবে টি এইচ খান বলেন, তাঁরা পেছনে বসবেন। পেছনেও বেঞ্চ আছে। আদালত অবমাননার আসামি হলে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেন। কিন্তু এভাবে নোটিশ দিয়ে ডেকে এনে আপনি দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেন না। হাইকোর্ট বলেন, অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত সবাই নিষ্পাপ। কিন্তু নিম্ন আদালতেও বিচার চলাকালে আসামিদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। টি এইচ খান বলেন, ওই আদালত এবং এখানকার প্রসিডিংস এক নয়। এ সময় আদালত তাঁকে মূল মামলা নিয়ে বলতে বলেন। টি এইচ খান বলেন, 'যে জায়গাটা আমি লিজ পেয়েছি, তা হাতির ঝিল প্রকল্পের নয়। শিল্প এলাকার এ প্লট আমি ৯০ বছরের জন্য লিজ পেয়েছি। বাকি '১০১' জন যেভাবে পেয়েছেন আমিও একইভাবে পেয়েছি। আমাকে একা কেন ডাকা হবে। সবাইকে ডাকতে হবে।' এ সময় হাইকোর্ট বলেন, 'আমরা কাউকেই ছাড়ব না। প্রত্যেককেই ডাকা হবে। আমরা তালিকা চাইব।' টি এইচ খান বলেন, আপনি পিক অ্যান্ড চুজ নীতির ভিত্তিতে চলতে পারেন না। আপনি যা যা করছেন তা এখতিয়ারবহির্ভূত। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের বাইরে গিয়ে আর্বিটারি (স্বেচ্ছাচার) আদেশ দিচ্ছেন। এ সময় হাইকোর্ট বলেন, এটা কোনো আর্বিটারি আদেশ নয়। জবাবে টি এইচ খান বলেন, আমার মতে আর্বিটারি। আপনি নোট নেন। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানিতে অংশ নিয়ে বলেন, সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। বিচারপতিরা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন। ওই শপথ রক্ষায় বেআইনি কোনো ঘটনা ঘটলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া বিচারপতিদের আইনি দায়িত্ব। আদালত বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক মজিবুর রহমান ও সরওয়ার জাহানের বক্তব্যও শোনেন। পরে আদেশ দেওয়া হয়। আদেশের পর টি এইচ খান সাংবাদিকদের বলেন, সুয়োমটো আদেশ দেওয়ার কোনো এখতিয়ার হাইকোর্টের নেই। সংবিধান এটা অনুমোদন করে না। আর সম্পদের যে হিসাব চাওয়া হয়েছে ওই আদেশের কপি এখনো পাইনি। ওই আদেশ অপ্রাসঙ্গিক এবং এখতিয়ারবহির্ভূত।
আদেশের পর টি এইচ খান সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণেই তাঁদের তলব করা হয়েছে। অনেকের মধ্যে 'জিয়া ফোবিয়া' কাজ করছে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, জনস্বার্থ রক্ষা করা আদালতের দায়িত্ব। ওই দায়িত্বই আদালত পালন করেছেন। শফিক রেহমান বলেন, 'আমাদের সব সঞ্চয় আমরা যায়যায়দিনে বিনিয়োগ করেছিলাম। সেখান থেকে আমরা এক টাকাও নেইনি। অন্য যে অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে তাও সম্পূর্ণ মিথ্যা।'

No comments

Powered by Blogger.