ইটের পরে ইট by অমিত বসু

ইট নিরেট, নড়েচড়ে না। ধরে ছুড়লে কিন্তু অনর্থ। তুলনায় পাথর পরাক্রমী। নিজে সহজে ভাঙে না, ভাঙতে পারে বেশি। ইট-পাথরের তুল্যমূল্য বিচার নির্মাণেও। পাথর না হলে শাহজাহানের তাজমহল হতো না। ইট ছাড়া কি তাঁর লালকেল্লা মাথা তুলত? ভাঙাগড়ার জনক ওরা।


ওদের বাদ দিয়ে সভ্যতা বা অসভ্যতা কোনোটাই হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও'নিলের মাথায় ছিল কথাটা। নতুন সংগঠনের নাম ভাবতে ইট-পাথরই মগজে আঘাত করছিল। সহ্য করতে না পেরে ইট নামটাই নিলেন। ইংরেজিতে ব্রিক। শেষে 'কে'টা শুধু বাদ। সদস্য দেশের নামের সঙ্গে মিলেও গেল বেশ। বি'তে ব্রাজিল, 'আর'-এ রাশিয়া, 'আই' মানে ইন্ডিয়া, 'সি' হচ্ছে চায়না বা চীন। নামের জন্ম ২০০১-এ। ও'নিলের গবেষণায় বলা হলো, বিশ্বকে বাঁচাতে গেলে এই চারটি দেশের ওপর নির্ভর করতেই হবে। ২০৫০ নাগাদ ব্রিক দেশগুলোর যৌথ অর্থনীতি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশের অর্থনীতিকে ছাপিয়ে যাবে। পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ ভূ-ভাগ এদের দখলে। জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ তাদের। যেভাবে তারা এগোচ্ছে, বিশ্ব-অর্থনীতি গ্রাস করতে সময় নেবে না।
'ব্রিক'-এর প্রথম শীর্ষ সম্মেলন ২০০৯-এর ১৬ জুন। ২০১১তে দক্ষিণ আফ্রিকা যুক্ত হওয়াতে সাউথ আফ্রিকার 'এস'টা ব্রিকের পাশে বসে হয় ব্রিক্স। এ বছরের শীর্ষ সম্মেলনে সাড়া ফেলেছে তারা। আমেরিকা তটস্থ। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আপস প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। বলেছেন, ব্রিক্স 'জি-এইট'-এর সঙ্গে মিলেমিশে চলুক না, পৃথক হয়ে থাকার কী দরকার! রাশিয়া তো এর সদস্য আছেই। ব্রাজিল, চীন, ভারত, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকাকে ডাকা হচ্ছে। তারা শুনছে না কেন? এশিয়া কী চায় বলুক, জি-এইটে সমাধান হয়ে যাবে।
উন্নয়নের অভিমুখ ইউরোপ থেকে এশিয়ার দিকে সরে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন ওবামা। রাশিয়ার এক পা ইউরোপে, অন্য পা এশিয়ায়। ঝুঁকে এশিয়ার দিকেই। রাশিয়াকে ধরলে ব্রিক্সের তিনটি দেশ- রাশিয়া, চীন, ভারত এশিয়ারই। এই জোট শক্তিশালী হলে ইউরোপের শঙ্কার কারণ। ১৯৭৫-এ মার্কিন পরামর্শে ফ্রান্সের নেতৃত্বে 'জি-৬'-এর জন্ম। ১৯৭৬-এ কানাডা, ১৯৯৭তে রাশিয়া যোগ দেওয়ার পর হয় 'জি-৮'। এর প্রধান সদস্য ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানির বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেও ভালো নয়। এশিয়ার জাপান সদস্য হওয়াতেও লাভ হয়নি। তাদের অর্থনীতি সাম্প্রতিকতার ধাক্কায় অনেকটা দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর রাশিয়া আগের জোরে ফিরে আসতে পারেনি। ইউরোপকে ক্র্যাচ করে এগোনো কঠিন। তার চেয়ে চীন-ভারতে আস্থা বেশি। জি-৮-এর সদস্যরা নিয়মিত বৈঠক করে। তবু জটিল অঙ্ক অমীমাংসিত থেকে যায়। উৎপাদন নিম্নমুখী, বেকারত্ব ঊর্ধ্বমুখী। আন্তর্জাতিক বাজারেও চীনের রমরমা। সফটওয়্যারে ভারত জাঁকিয়ে বসেছে। হার্ডওয়্যারে চীন। আমেরিকার অর্থনীতি চীনের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বরাবরই আমেরিকার হাত ধরে ছিল। মন্দার বাজারে তারাও দিশেহারা। অনিশ্চয়তার অন্ধকারে রাস্তা ঠাহর করতে পারছে না। জাপান, কোরিয়া থেকে মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর বিরস বদনে চেয়ে আছে চীনের দিকে। তারাও বুঝছে, আমেরিকার ওপর ভরসা করাটা আর ঠিক হবে না। বরং ব্রিক্সকে নিয়ে যে নতুন শক্তিবলয় তৈরি হচ্ছে, তার থেকে পাওয়ার ধার করা ভালো। তাদের নজর সার্কের দিকেও। ব্রিক্সের টিমে চীন-ভারত থাকায় সার্কও তাদের সঙ্গে থাকবে। সেই বড় বাজারের ভাগ পেলে কিছুটা স্বস্তি মিলবে।
ধারণাটা ভুল নয়। সার্কের দিকে আমেরিকার নজর তীক্ষ্ন। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আফগানিস্তানও এখন সার্কের সদস্য। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের জোয়ার আসছে। ২০১৫তে সাধারণ নির্বাচনে সুচির নেতৃত্বে নতুন গণতান্ত্রিক সরকারের আত্মপ্রকাশ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। অতএব তাদের সার্ক সদস্য হওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। চীন সদস্য হওয়ার জন্য এক পা বাড়িয়ে আছে। আপাতত তারা পর্যবেক্ষক। পর্যবেক্ষকের তালিকায় আমেরিকাও আছে। চীন যেখানে থাকবে সেখানে আমেরিকা থাকবে না, তাই কখনো হয়? জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াও পর্যবেক্ষক দেশ। ইন্দোনেশিয়া, ইরান, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাও পর্যবেক্ষক। এরা সবাই কিন্তু সদস্য হতে মরিয়া। তুলনায় রাশিয়া একটু পিছিয়ে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিছুটা দুর্বল। ভ্লাদিমির পুতিনের নির্বাচন ঘিরে বিতর্ক রাশিয়াকে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলেছে।
২০১৪তে বাংলাদেশ-ভারত সাধারণ নির্বাচনে যাবে। ফলাফলের নিরিখে সার্কের সমীকরণও পাল্টাতে পারে। তখনই ঠিক হবে সার্কের বেশি ঘনিষ্ঠ কে হবে- চীন না আমেরিকা। ব্রিক্স কিন্তু চীনকে অনেকটাই এগিয়ে রেখেছে। সার্কে ব্রিক্সের প্রভাব অনিবার্য হয়ে উঠেছে। তারা আমেরিকাকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে হটাতে তৎপর। ব্রিক্স একটি প্রস্তাবে আমেরিকার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তারা ঠিক করেছে বিশ্বব্যাংকের সমান্তরাল একটি ব্যাংক তৈরি করবে। যার নাম হবে ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক। উন্নয়নশীল দেশকে ঋণ দেবে সহজ শর্তে। যাতে দেনার দায়ে বিকিয়ে যেতে না হয়। বিশেষ নজর দেবে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দিকে। সোমালিয়ার মতো দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেবে। বণ্টন ব্যবস্থার দিকে লক্ষ রাখবে, যাতে অধিকাংশ মানুষকে নিচে ফেলে কিছু মানুষ চড়চড়িয়ে চূড়োয় উঠতে না পারে। যদি এ রকম হয়, চাপ দিয়ে সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। কোনোভাবেই পুঁজিবাদ বরদাশত করা যাবে না।
চীন অর্থনৈতিকভাবে যে জায়গায় আছে অক্লেশে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। ধারালো অর্থনৈতিক অস্ত্র যে চীনের হাতে মজুদ এবং তা দিয়ে আমেরিকার শিরশ্ছেদ করাটা কঠিন নয়, তা ওবামার অজানা নয়। সে কারণেই ভারতকে কাছে টানছেন। এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির গুরুত্ব দিচ্ছেন। দুনিয়ায় অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব করছে বিশ্বব্যাংক। সেটা হারালে আর কী রইল? তাই ওবামা সবিনয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন ব্রিক্সকে। বলেছেন, বিশ্বব্যাংক তো আছে। বিকল্প ব্যাংকের দরকার কী? যদি নিয়মকানুনের পরিবর্তন দরকার হয়, করা যেতে পারে। ব্রিক্সের সব রকম স্বার্থরক্ষা করতে বিশ্বব্যাংক প্রস্তুত।
লেখক : কলকাতার সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.