প্রকৌশল শিক্ষা-সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তন জরুরি by এমএম শহীদুল ইসলাম

বাংলাদেশের প্রকৗশলীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে শিক্ষা নিচ্ছেন, তা আমাদের দেশের উন্নয়নে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। একটি যুগোপযোগী শিক্ষা পদ্ধতি প্রণয়নের স্বার্থে উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষা পদ্ধতি ও পাঠদান সম্পর্কে অবগত হতে হবে।


সনাতন শিক্ষা পদ্ধতি বর্তমান যুগের জন্য উপযোগী নয়


পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে সনাতন শিক্ষার পরিবর্তে ঙঁঃপড়সব ইধংবফ ঊফঁপধঃরড়হ (ঙইঊ) চালু হয়েছে দুই দশকের বেশি সময় ধরে। সনাতন শিক্ষা পদ্ধতি একবিংশ শতাব্দীর জন্য উপযুক্ত প্রকৌশলী তৈরি করতে পারছে না এবং প্রকৌশলীরা কর্মজীবনে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন না করার কারণে শিক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। শিক্ষা শুধু পাঠ্যপুস্তক থেকে পড়ানো বা শিক্ষকের শ্রেণীকক্ষে জ্ঞানদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষানবিশরা অর্জন করতে চায় প্রকৌশল বিষয়ের সমস্যার সমাধান, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ করার ক্ষমতা এবং তথ্যাদি সংগ্রহ ও রূপান্তর করার ক্ষমতা। ছাত্ররা মুখস্থনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা চায় না, চায় প্রয়োগনির্ভর শিক্ষা। ওবিই শিক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠতম দিকনির্দেশক বলে বিবেচিত হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রকৌশলশিক্ষায় অধ্যয়নরত ছাত্ররা ওবিইকে সানন্দে গ্রহণ করেছে এবং ওবিই থেকে যথেষ্ট সুফল পাচ্ছে। অনেক তর্কবিতর্কের পর মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, চীন, শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা কয়েক বছর আগে প্রকৌশলশিক্ষায় ওবিইকে গ্রহণ করেছে। ওবিই সম্পর্কে আমাদের দেশে শিক্ষাবিদ, ইউজিসি বা সরকার কোনো চিন্তাভাবনা করছে কি-না আমার জানা নেই।
ওবিই পদ্ধতিতে প্রতিটি প্রোগ্রামের জন্য নিজস্ব কিছু উদ্দেশ্য ও আউটকামগুলো নির্দিষ্ট করে উল্লেখ থাকে। প্রকৌশলীদের কর্মজীবনে যেসব কার্যভার নিতে হয়, সেগুলোর ভিত্তিতে আউটকামগুলো নির্ণয় করা হয়। ছাত্রদের তাদের শিক্ষাজীবন সমাপ্তির মধ্যে অথবা কর্মজীবনে কয়েক বছরের মধ্যে সেগুলো অর্জন বা পূরণ করতে হয়। কেবল জ্ঞান অর্জনের জন্য ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে না। তাদের সমাজসচেতন হতে হবে, নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে হবে। ছাত্ররা উলি্লখিত উদ্দেশ্যগুলো অর্জনে এবং আউটকামগুলো পূরণে কতখানি সফল হচ্ছে, তা বিভিন্ন পদ্ধতিতে পরিমাপ করা হয়। এ পদ্ধতিতে ছাত্ররা পছন্দের প্রোগ্রাম থেকে কী শিক্ষতে চায় এবং চাকরি ক্ষেত্রে কী ধরনের চাহিদা আছে, তা বুঝে কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়। এমনকি প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়া ছাত্রদের মেধা, মান ও চাওয়ার ওপর নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রোগ্রামের সিলেবাস পরিবর্তন ও সংশোধন করতে হয়। একই প্রোগ্রামের সিলেবাস বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন হতে পারে। প্রোগ্রামে গতিশীলতা আনার জন্য কারিকুলাম নিয়মিত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে হয়। প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য ও আউটকামগুলো বিবেচনায় নিয়ে কোর্সগুলো প্রস্তুত করতে হয়। সনাতন শিক্ষা পদ্ধতি ছাত্রদের উৎসাহিত করে শিক্ষক কী পড়ালেন, তা মনে রাখা এবং বিবৃত করার মধ্যে। পক্ষান্তরে, ওবিই ছাত্রদের চ্যালেঞ্জিং কাজ সম্পাদন করার ক্ষমতা সৃষ্টি করে। ছাত্ররা সক্ষম হয়_ প্রজেক্ট লেখা ও সুষ্ঠুভাবে সমাপ্ত করা, বিষয়বস্তুর পর্যবেক্ষণ ও পর্যালেচনা, কোনো বিষয়ের ওপর উপস্থাপনা, চিন্তা করার ক্ষমতা, গবেষণা ও প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি। কোনো প্রজেক্ট এককভাবে না করে কয়েক ছাত্রকে নিয়ে গ্রুপ করে সম্পাদন করতে হয়। এভাবে প্রজেক্ট করলে একত্রে কাজ করা ও সমস্যা সমাধানের মানসিকতা সৃষ্টি হয়। থিওরি কোর্সে শিক্ষক বেশকিছু অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে থাকেন। শিক্ষক তার কোর্সের ছাত্রদের নিয়ে কয়েকটি গ্রুপ করেন এবং প্রতিটি গ্রুপে অন্তত তিন-চারজন ছাত্র থাকে। গ্রুপের ছাত্ররা পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে অ্যাসাইনমেন্ট সমাধান করে, তবে অনেক ক্ষেত্রে গ্রুপের প্রত্যেকে আলাদাভাবে অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষকের কাছে জমা দেয়। এতে লেখার দক্ষতা বাড়ে। বর্তমানে প্রকৌশল সম্পর্কিত কাজগুলো জটিল হওয়ায় একজনের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। বর্তমান যুগ একার পরিবর্তে দলগতভাবে কাজ করার যুগ।
আগেই উল্লেখ করেছি, শিক্ষা শুধু পাঠ্যপুস্তক থেকে পড়ানো বা শিক্ষকের শ্রেণীকক্ষে জ্ঞানদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। শিক্ষা সাধারণত কিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল যেমন_ (ক) ছাত্র-শিক্ষক, (খ) ছাত্র-ছাত্র, (গ) ছাত্র-গবেষণা, (ঘ) ছাত্র-ল্যাব, (ঙ) ছাত্র-লাইব্রেরি, (চ) ছাত্র-অভিজ্ঞতা, (ছ) ছাত্র-সমাজ ও (জ) ছাত্র-পারিপাশর্ি্বকতা। ওবিই এসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমলে নিয়েছে। এই অল্প পরিসরে এসব নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করা সম্ভব নয়। অপপৎবফরঃধঃরড়হ ইড়ধৎফ ড়ভ ঊফঁপধঃরড়হ ধহফ ঞবপযহড়ষড়মু (অইঊঞ), টঝঅ প্রকৌশল প্রোগ্রামের জন্য ১৩টি অ্যাট্রিবিউট (িি.িধনবঃ.ড়ৎম) উল্লেখ করেছে। এই ১৩টি অ্যাট্রিবিউট বিবেচনায় নিয়ে কোর্সগুলো প্রণয়ন করতে হয়। অ্যাট্রিবিউটগুলো সম্পর্কে পাঠকদের ধারণা না দিলে সনাতন পদ্ধতি ও ওবিই পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য বোঝা যাবে না। অ্যাট্রিবিউটগুলোর মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেগুলো হচ্ছে_ (ক) ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্সে জ্ঞান, (খ) প্রকৌশল বিষয় সম্পর্কিত সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ, (গ) প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ, (ঘ) আধুনিক সিমুলেশন টুলস ব্যবহার, (ঙ) এককভাবে এবং সমষ্টিগতভাবে কাজ করা, (চ) নীতিশাস্ত্র জ্ঞান, (ছ) ইঞ্জিনিয়ারিং সলিউশনের ওপর পরিবেশের প্রভাবের ব্যাপারে সচেতনতা, (জ) জীবনব্যাপী লার্নিং ইত্যাদি। এটা সত্য, ১৩টি অ্যাট্রিবিউট বিবেচনায় নিয়ে কারিকুলাম প্রণয়ন করা সহজসাধ্য কাজ নয়। এ কাজে কেবল শিক্ষকতায় অভিজ্ঞতা থাকলেই চলবে না, ওবিই শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অবশ্যই থাকতে হবে। একটা বড় প্রশ্ন থেকে যায়_ কারিকুলাম প্রণয়নের পর কোর্স পড়ানোর জন্য কী ধরনের টিচিং পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। আগেই বলেছি, ওবিই শিক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ করলে শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে কোর্সের জন্য নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক থেকে সনাতন পদ্ধতিতে পড়াতে পারবেন না। সনাতন পদ্ধতিতে পড়ালে কোনো কোর্স থেকে প্রত্যাশিত লার্নিং এবং প্রোগ্রামের আউটকামগুলো অর্জন করা সম্ভব হবে না। কোনো প্রোগ্রামের আউটকামগুলো যেমন_ (ক) কিছু মৌলিক বিষয়ে ছাত্ররা দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে কি-না তা যাচাই করা, (খ) ছাত্ররা প্রকৌশল সমস্যাগুলো সমাধান করার ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে কি-না তা পরিমাপ করা। অষধনধসধ অ্গ টহরাবৎংরঃু কোর্স পড়ানোর জন্য ঝঊঅঅজক নামক পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। পড়ানোর কৌশল এমন হতে হবে যে, ছাত্ররা অর্জন করবে : (ক) বিষয়ে জ্ঞান, (খ) কোনো সমস্যার বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ করার ক্ষমতা, (গ) ডিজাইন করার ক্ষমতা ইত্যাদি। শিক্ষককে শুধু থিওরি পড়ালে চলবে না, তাকে প্রবলেম কী ভাবে সমাধান করতে হয়, তা ছাত্রদের শেখাতে হবে। ফলদায়ক শিক্ষাদান করার জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলো হচ্ছে : (ক) ভিডিও প্রেজেন্টেশন, (থ) ছাত্রদের মৌখিক উপস্থাপনা, (গ) প্রশ্ন-উত্তর পর্ব, (ঘ) স্টাডি সেশন, (ঙ) সিমিউলেশন টিউটরিং ইত্যাদি। কোর্সের প্রত্যাশাগুলো অর্জিত হয়েছে কি-না তা নিরূপণ করা হয় : (ক) হোম অ্যাসাইনমেন্ট, (খ) কুইজ, (গ) টার্ম ও ফাইনাল পরীক্ষা, (ঙ) প্রজেক্ট ইত্যাদির মাধ্যমে।
বাংলাদেশের প্রকৗশলীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে শিক্ষা নিচ্ছেন, তা আমাদের দেশের উন্নয়নে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। একটি যুগোপযোগী শিক্ষা পদ্ধতি প্রণয়নের স্বার্থে উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষা পদ্ধতি ও পাঠদান সম্পর্কে অবগত হতে হবে। সনাতন শিক্ষা পদ্ধতি বর্তমান যুগের জন্য উপযোগী নয়। আমাদের দেশের প্রকৌশল ডিগ্রির স্বীকৃতির জন্য আমাদের ওয়াশিংটন অ্যাকর্ডের (ডঅ) স্বাক্ষরদাতা হতে হবে। ডঅ-এর স্বাক্ষরদাতা হতে হলে ওবিই পদ্ধতি অবশ্যই চালু করতে হবে। ডঅ-এর সদস্য হওয়ার অর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ দেশের প্রকৌশল ডিগ্রির মানের স্বীকৃতি পাওয়া এবং প্রকৌশলীদের বিদেশের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। আমরা পেছনে পড়ে থাকতে পারি না। শিক্ষা পদ্ধতিতে সংস্কার না করলে নতুন প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। একদিন আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। তাই আশা করি আমাদের সরকার ও শিক্ষাবিদরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।

এমএম শহীদুল হাসান : অধ্যাপক, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
shassan@eee.buet.ac.bd
 

No comments

Powered by Blogger.