সময়ের কথা-কে লইবে মোর কার্য... by অজয় দাশগুপ্ত

সরকার যদি বিদ্যুতের রেশনিংয়ের প্রস্তাব করে, তাহলে ধনবান পরিবারগুলোর ক'জন রাজি হবে বলা মুশকিল। তাদের প্রায় সবাই একবাক্যে বলে উঠবে যে, এটা মহা অন্যায় এবং তা কোনোভাবেই মানা যায় না। যে কোনো মূল্যে তা প্রতিরোধের সংকল্পও ব্যক্ত হতে পারে।


কিন্তু বিনামূল্যের বই নিতে তাদের কেউ কি আপত্তি করবে? তারা কি বলবে যে, এভাবে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদের সঙ্গে আমাদের এক কাতারে ফেলার কোনো অর্থ হয় না? তারা এটা কোনোভাবেই বলবে না যে, তাদের সন্তানের দু'চার দিনের হাতখরচা দিয়েই বছরের বই কিনে ফেলা যায়


সমকালে ১৭ জুলাই 'আলোর সঙ্গে কিছু অন্ধকার বণ্টন' শিরোনামে লেখা প্রকাশের পর প্রকৌশলী এ কে সরকার লিখেছেন, খাদ্যদ্রব্য এবং আরও কয়েক ধরনের পণ্যের রেশন চালু ছিল এ দেশে। এখনও খাদ্যদ্রবের দাম বেড়ে গেলে রেশন চালুর কথা বলা হয়। দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ছে। তার পরও বলা যায়, যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের রেশনিং করার কথা ভাবা যেতেই পারে। অন্ধকারের সমবণ্টন দরকার নেই। কিন্তু একেবারে যারা বিদ্যুৎ পায় না, তাদের কাছে কিছুটা পেঁৗছানো যেতেই পারে এবং এ প্রযুক্তি বাংলাদেশের আয়ত্তে রয়েছে।
কেউ খাবে, কেউ খাবে না_ এ স্লোগান দেশে জনপ্রিয়। বামপন্থিরা এখনও মিছিলের শুরুতে 'জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো'র মতো স্লোগানও দিয়ে থাকে। তবে এটাও ঠিক যে, বিদ্যুতের সমবণ্টন নিয়ম চালু করা যাবে না। উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিংবা পানি ও গ্যাস ধনী ও গরিব সব পরিবারে সমানভাবে ভাগ করে দিতে গেলে সমাজ কাঠামো ভেঙে পড়ে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সরকার এ ক্ষেত্রে এ ধরনের কিছু করতে পারে :বেশি ব্যবহারকারী পরিবারগুলোর কাছ থেকে কিছুটা বিদ্যুৎ নিয়ে গ্রামের যেসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়ছে, তাদের সন্ধ্যা থেকে ৪-৫ ঘণ্টা সরবরাহ নিশ্চিত করা। এ কে সরকার আরও লিখেছেন, সৌরশক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপরও জোর দিতে হবে। কারণ বাংলাদেশে ফসিল ফুয়েল (গ্যাস, ডিজেল, কয়লা ইত্যাদি) কাজে লাগিয়ে ১০০ শতাংশ পরিবারের জন্য দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এটি করতে গেলে ব্যয় পড়বে অকল্পনীয়। সরকার এখন বলতে পারে, যারা বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে চায়, তাদের অবশ্যই সোলার সেল চালু করতে হবে। তব এ জন্যও সরকারকে সহায়তা দিতে হবে_ সোলার বিদ্যুৎ প্রযুক্তি সহজলভ্য ও ব্যয়সাশ্রয়ী করা চাই। নইলে এটি থেকে যাবে ধনীদের একচেটিয়া বিষয়। আর দরিদ্ররা বলবে, আমাদের চাঁদ ও সূর্যের ওপরই ভরসা।
শান্তিনগর থেকে হাবিবুর রহমান লিখেছেন : 'আলোর সঙ্গে কিছু অন্ধকার বণ্টন' যাদের পড়া উচিত, তারা কি পড়ার সময় পান? বণ্টন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কি নিজেদের চুরির পথ বন্ধ করতে চাইবে? প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকরা বিদ্যুৎ ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্ক। সিরাজগঞ্জ শহরে এটা চালু রয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ কর্তৃপক্ষ কি জানে না যে, রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের স্বর্ণালঙ্কারের দোকানগুলোয় কী পরিমাণ বিদ্যুৎ দিনে ব্যবহৃত হয়? বড় বড় শপিং সেন্টারের আলোকসজ্জা দেখে কি আমরা ভাবতে পারি যে, বাংলাদেশ গভীর বিদ্যুৎ সংকটে নিমজ্জিত? আলো ঝলমল করার জন্য পেট্রোল পাম্পগুলোয় কত বাল্ব জ্বালানো হয়? এ অপচয় নিয়ন্ত্রণে আনা গেলে অনেক ছোট ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদনের জন্য বিদ্যুতের জোগান দেওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশে শুধু নয়, যে কোনো দেশেই সমবণ্টনের নীতি অচল। কয়েকটি দেশে সমাজতন্ত্রের নামে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। কিন্তু তা সফল হয়নি। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সম্পদের অধিকতর সুষম বণ্টনের ধারণা জনপ্রিয় হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতেও তার স্থান হয়েছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বেশি দূর এগোনো যায়নি। ধনবানরা এ ধারণাকে অপ্রিয় করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালায়। তাদের প্রচারযন্ত্র শক্তিশালী। সরকারও তাদের প্রাধান্য দেয়। বড় বড় রাজনৈতিক দল ভোটের জন্য গরিব মানুষকে নানা প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু প্রার্থী করার সময় প্রধান একটি বিবেচনা থাকে, কত টাকা পকেট থেকে বের করার ক্ষমতা আছে। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোভাবও একই ধরনের। যারা বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এবং দিনে এক-দুই ঘণ্টা লোডশেডিংও মানতে চায় না, তাদের সন্ধ্যা থেকে ৬ ঘণ্টা পিক আওয়ারে এয়ারকন্ডিশন যন্ত্রের পরিবর্তে ফ্যান চালাতে যে সরকার বলবে তার কপালে দুঃখ আছে। আর প্রবাদ বলে, 'আপনি আচরি ধর্ম...'। সরকার যখন আমজনতাকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে বলে, তখন প্রথমেই পথ দেখাতে হয় বিদ্যুৎ দফতরের মন্ত্রী ও শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের। তাদের বাসা ও অফিসের জন্য প্রি-পেইড যন্ত্র চালু করা হলে সংবাদপত্র ও বেতার-টেলিভশন সে খবর প্রচারে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করবে না, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
কয়েক দিন আগে ঢাকায় 'ওয়াটার, ওয়েভস ও ওয়েদার' শীর্ষক একটি সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় আসা যুক্তরাষ্ট্রের সিরাকিউস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের শিক্ষক ফারহানা সুলতানার সঙ্গে ওয়াসার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পর্কে কথা হয়। বস্তি এলাকায় তিনি কাজ করেছেন এবং সেখানে বাসস্থানের মতোই ভয়াবহ সমস্যা হচ্ছে পানি। মহিলাদের সমস্যা আরও বেশি। তাদের রান্না করতে হয়। নিজের ও শিশু সন্তানদের স্নান ও পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। রাজধানী কিংবা অন্যান্য শহরে নদী-পুকুরের পানি ব্যবহারের সুবিধা নেই। তাই ওয়াসার পানিই ভরসা। কিন্তু এ পানি পেতে হলে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। বস্তিবাসীরা তার জোগান দেবে কী ভাবে? টাকা থাকলে কি কেউ বস্তিতে থাকে?
রাজধানীতে বস্তিবাসীর সংখ্যা কত, তার মোটামুটি হিসাব জানা যেত আদমশুমারির কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন হলে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা এ ক্ষেত্রে চরম অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে বলেই ধারণা করা হয়। তাদের কর্মীরা প্রতিটি ঘরে যায়নি। বেশ কিছু ঘর বাদ পড়েছে গণনা থেকে। আবার যেসব ঘরে গেছে, সেখানে কেবল মাথা গুনেই চলে এসেছে। ফরমে ২০-২২টি প্রশ্ন ছিল। তার সবগুলোর উত্তর জানার চেষ্টা করেনি। আমার নিজের বাসায় যে কর্মী গেছেন, তিনি শুধু কতজন লোক বাসায় থাকে, সেটা জেনেই চলে এসেছেন। নারী-পুরুষের প্রকৃত সংখ্যা জানার আগ্রহও ছিল না। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের পাশাপাশি শাসক দলের দায়ও কম নেই। আদমশুমারির কাজ করার জন্য হাজার হাজার কর্মী অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ধরনের 'সাময়িক কর্মসংস্থানের' ক্ষেত্রে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা 'নিজের লোককে' কয়েক দিনের জন্য কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। তাদের মধ্যে দক্ষ ও অদক্ষ লোক থাকে, ফাঁকিবাজও থাকে। আবার প্রশাসনের যারা দায়িত্বে, তাদের মধ্যেও থাকে অযোগ্য লোক। তারা সবাই মিলেই লোক গণনার কাজে জট লাগিয়েছে। রাজধানীতে বস্তি ও বস্তিবাসীর প্রকৃত সংখ্যা তারা জানতে দেয়নি। বস্তিতে পানি সরবরাহ প্রসঙ্গে বলছিলাম। সরকার তথা ওয়াসা তাদের সবাইকে বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করবে_ এটি ভাবা যায় না। কিন্তু সরকার এটাও বলতে পারে না যে, ৩০-৩৫ লাখ বস্তিবাসী তাদের পানির সমস্যা কী ভাবে সমাধান করবে, সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। এটি ঠিক যেসব দেশের সব মহানগর ক্রমে দরিদ্রদের তাড়িয়ে দেয় কেন্দ্র থেকে দূরে এবং আরও দূরে। একসময় সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে বস্তি ছিল। তাদের উচ্ছেদ করে গড়ে উঠছে 'মনোরম হাতির ঝিল' প্রকল্প। ধানমণ্ডি-গুলশান-বনানীতেও বস্তি ছিল। আগারগাঁওয়ে বিএনপি বস্তিতে এখন অনেক হাইফাই সরকারি অফিস। তার পরও সব বস্তি একেবারে উচ্ছেদ করা তো দূরে, টঙ্গী বা কেরানীগঞ্জে ঠেলে দেওয়া যায় না, যাবেও না। কারণ তাহলে আমাদের প্রধান রফতানি পণ্যের উৎস পোশাকশিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের ঘরে কাজের লোকের জোগান আসবে না। অফিসে মিলবে না দারোয়ান-পিয়ন। যতই দৃষ্টিকটু লাগুক, বস্তি তাই থাকতেই হবে। কিন্তু এ জন্য নূ্যনতম সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে_ এমন মানসিকতা এখন পর্যন্ত সরকার কিংবা ধনবান গোষ্ঠীর মধ্যে গড়ে ওঠেনি।
সরকারের পাশাপাশি ধনবান শ্রেণীর কথা বললাম এ কারণেই, সমাজে তাদের কিছু বাড়তি দায় থাকেই। উদাহরণ হিসেবে শিক্ষার কথা বলতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ কয়েকটি উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ বলে থাকি। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের অতি সামান্য অংশই আসে ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া বেতন ও বিভিন্ন চার্জ থেকে। বেশিরভাগ অর্থের জোগান দেয় সরকার। এসব প্রতিষ্ঠানে কম করে হলেও ২৫-৩০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী থাকে, যাদের পরিবার মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত। অন্যদের মতো তারাও মেধার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এখানে ভর্তি হতে পেরেছে। আবার সরকারের দেওয়া সুবিধাও ভোগ করছে সমানভাবে। স্কুলে এখন সরকারি অর্থে সব ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে বই দেওয়া হয়। এ এক জায়গানটিক ওয়ার্ক। অতীতে কোনো সরকার এটি ভাবেনি। সরকারের জন্য আদর্শ কাজের নজির হয়ে থাকবে এ উদ্যোগ। আমাদের প্রশাসন ও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ চাইলে যে কত অসাধ্য সাধন করতে পারে, তারও উদাহরণ এ বিনামূল্যে বই সরবরাহ। এ ক্ষেত্রেও ধনী, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র_ সব পরিবার বিনামূল্যে এ সুবিধা পাচ্ছে। সরকার যদি বিদ্যুতের রেশনিংয়ের প্রস্তাব করে, তাহলে ধনবান পরিবারগুলোর ক'জন রাজি হবে বলা মুশকিল। তাদের প্রায় সবাই একবাক্যে বলে উঠবে যে, এটা মহা অন্যায় এবং তা কোনোভাবেই মানা যায় না। যে কোনো মূল্যে তা প্রতিরোধের সংকল্পও ব্যক্ত হতে পারে। কিন্তু বিনামূল্যের বই নিতে তাদের কেউ কি আপত্তি করবে? তারা কি বলবে যে, এভাবে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদের সঙ্গে আমাদের এক কাতারে ফেলার কোনো অর্থ হয় না? তারা এটা কোনোভাবেই বলবে না যে, তাদের সন্তানের দু'চার দিনের হাতখরচা দিয়েই বছরের বই কিনে ফেলা যায়। অথচ এসব পরিবার যদি বইয়ের অর্থ কিংবা অন্যান্য উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার ব্যয়ের বড় অংশ মিটিয়ে দিত, তাহলে সরকারের পক্ষে কিন্তু শিক্ষার প্রসার ও গুণগত মান বাড়াতে আরও কিছু উদ্যোগ গ্রহণ সম্ভব হতো।
আমাদের অর্থনীতি একটু একটু করে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে শুরু করেছে। সমাজে ধনবান ও মধ্যবিত্ত লোকের সংখ্যা বাড়ছে। তার কিছু প্রতিফলন তো থাকা চাই, না কী?

অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.