অসন্তোষের বছর ২০১১ by এ এম এম শওকত আলী

১৯৯১-পরবর্তী সব বছরই কমবেশি অসন্তোষের বছর ছিল। তবে ১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জনগণের অসন্তোষ মূলত রাজনৈতিক কারণের জন্যই অধিকতর অনুভূত হয়েছে। ওই সাল থেকে বৃহৎ দুই দলের সৃষ্ট সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনেকাংশে ঘনীভূত হয় ২০০৭ সালে। এরই ধারাবহিকতায় জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি সৃষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমর্থনে সেনাবাহিনীও এগিয়ে আসে এবং বলা যায়, 'কার্যকর' ভূমিকা পালন করে।


এর মধ্যে অন্যতম ছিল প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ। এ ধরনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পরই ওই সময়ের প্রধান বিরোধী দলও গৃহীত পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তা স্থায়ী রূপ লাভ করেনি। কারণ কারো অজানা নয়। তবে সব উৎকণ্ঠার অবসান হয় ২০০৮ সালের শেষের দিকে একটি নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনের পর। এরই মধ্যে মহাজোট সরকারের আড়াই বছর অতিবাহিত হয়েছে। এখনো যে ক্ষমতাসীন দলের শাসনকার্যের জন্য জনগণ নিরঙ্কুশ সন্তোষ প্রকাশ করছে, তা নয়। বর্তমানের প্রধান বিরোধী দল গত বছর থেকেই অবিরাম চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে। তারা চিরাচরিত একই প্রথার একাধিক কৌশল এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য বেছে নিয়েছে। যেমন সংসদ বর্জন। রাজপথে আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত হরতাল। তাদের এ ধরনের গতানুগতিক অসন্তোষের কারণ বহুবিধ। এক. রাজনৈতিক, দুই. অর্থনৈতিক এবং তিন. বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নতির জন্য ক্ষমতাসীন দলের নতুন প্রচেষ্টা, যার কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণের সঙ্গে জড়িত।
প্রাথমিক পর্যায়ে গতানুগতিক প্রথার সংসদ বর্জন। বিরোধী দলের মতে, এর প্রধান কারণ এক. সংসদে বসার আসন বরাদ্দের বিষয়ে অসমতা এবং দুই. সংসদে কথা বলার অধিকার হরণ করা। এর পরই শুরু হয় হরতালের রাজনীতি ও রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতাচ্যুত করা। বহু চেষ্টা করেও লক্ষ্য অর্জনে কোনো সফলতা আসেনি। তবে বিরোধী দলের কথায় মনে হয়, রমজানের পর তারা রাজপথের আন্দোলনের চেষ্টা আরো জোরদার করবে।
অর্থনৈতিক কারণের মধ্যে বিরোধী দল কয়েকটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে। এক. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং দুই. বিদ্যুৎ সরবরাহের অপ্রতুলতা। এ দুটি বিষয় তাদের রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। এর সঙ্গে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন বিষয়। এর মধ্যে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও সাম্প্রতিককালের শেয়ারবাজারের ঘন ঘন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি; যার ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে সর্বশেষ ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত সড়ক দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যুসহ কয়েকটি প্রধান আন্তজেলা সড়কের বেহাল অবস্থা; যার ফলে সংশ্লিষ্ট বাস মালিক সমিতি বাস চলাচল বন্ধ করেছে। রেলপথে চলাচলের অনিশ্চয়তাও আরেকটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত।
বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়ে চিরাচরিত প্রথায় ক্ষমতাসীন দলের 'ভারতপ্রীতি'র জন্য বিরোধী দল তীব্র সমালোচনা করেছে। যোগ হয়েছে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সব চুক্তির বিষয় প্রকাশ করার দাবি। এর সঙ্গে যুক্ত বিষয়টি হলো, ট্রানজিট চুক্তি। প্রধান বিরোধী দল বরাবরই ট্রানজিট চুক্তির প্রবল বিরোধিতা করেছে। বর্তমানে ট্রানজিট ফি নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রাধান্য পেয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন বাংলাদেশ সফর প্রসঙ্গ। এটা কবে হবে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। কারণ ভারতে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস ও তার জোটভুক্ত সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ও তা নিরসনের জন্য সুশীল সমাজ কর্তৃক প্রণীত জনলোকপাল বিল গ্রহণের আন্দোলন এখন তুঙ্গে। দুর্নীতির বিষয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ উক্তিটি প্রাসঙ্গিক। তাঁর মতে, জাদুর কাঠি দিয়েও দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, দুর্নীতির বিষয়ও বাংলাদেশে প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ অনেকটা ভিন্নতর। প্রধান বিরোধী দলের নেতার দুই ছেলেকে দুর্নীতির দায়ে দুদক অভিযুক্ত করেছে। এ বিষয়টিও প্রধান বিরোধী দল প্রতিহিংসামূলক রাজনীতির প্রতিফলন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিচারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসঙ্গ। এর মধ্যে একজন অভিযুক্ত ব্যতীত অন্য সবাই জামায়াত দলভুক্ত।
বর্তমান অসন্তোষের বছরের একটি ভিন্নধারা হলো, ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেই অসন্তোষ। সড়ক অব্যবস্থাপনার জন্য প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং অসন্তুষ্ট। এ সমস্যা আশু নিরসনের জন্য তিনি কয়েক দিন আগে যথাযথ নির্দেশও দিয়েছেন। তবে তাঁর অসন্তোষ দলের একাংশের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দুই মন্ত্রীর পরস্পরবিরোধী বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক অধিকতর ঘনীভূত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সংসদে ক্ষমতাসীন দলভুক্ত কয়েকজন সংসদ সদস্য ছাড়াও জোটভুক্ত দুই দলের সংসদ সদস্যরাও সড়ক ব্যবস্থাপনার বেহাল অবস্থা নিয়ে প্রকাশ্যে মন্ত্রীদের পদত্যাগ দাবি করেন। এ দাবি ভিন্নতর হলেও বিরোধী দলও সার্বিক ব্যর্থতার জন্য ক্ষমতাসীন দলের পদত্যাগ দাবি করেছে।
সংসদে যে সড়ক অব্যবস্থাপনার বিষয়ে দলীয় সংসদ সদস্যরাও সমালোচনামুখর হবেন, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অধিবেশনের আগেই কিছু পূর্বাভাস পাওয়া যায়। আইন ও সংসদবিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান এ বিষয়ে পূর্ব ইঙ্গিত দেন। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে দলীয় সংসদ সদস্যরাই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবেন। সম্পূর্ণ বিষয়টি ছিল অভিনব এবং সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। মহাজোটভুক্ত অন্য দুই শরিক দলের দুই সংসদ সদস্যও এ বিষয়ে অধিবেশনের আগেই সড়ক প্রসঙ্গ নিয়ে সরকারের সমালোচনা করবেন_সে বিষয়টিও প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেন। তাঁদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের অন্য সংসদ সদস্যরাও যোগ দেন।
স্মরণ করা যেতে পারে, প্রাথমিকভাবে সড়কের অব্যবস্থাপনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রীর যে বাদানুবাদ হয়, তার অব্যবহিত পরেই প্রধানমন্ত্রী আহূত সভায় যোগাযোগমন্ত্রীকে কিছুটা হলেও দায়মুক্ত করার চেষ্টা প্রধানমন্ত্রীই করেন। তবে শেষ পর্যন্ত সংসদে এ চেষ্টা টেকেনি। সমালোচনামুখর কয়েকজন দলীয় সংসদ সদস্য যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। তবে তা হয়নি। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন ভিন্নতরভাবে সমালোচনামুখর। তিনি মন্তব্য করেছেন, একই দলের মন্ত্রীদের প্রকাশ্যে একে অপরকে দোষারোপ করা সঠিক নয়। সমস্যাটি নিজেরাই আলোচনা করে সুরাহা করা উচিত ছিল। তবে তাঁর এক সাম্প্রতিক বক্তব্যে দৃশ্যমান হয়েছে, তিনিও একই দোষে দুষ্ট। প্রসঙ্গটি ছিল অর্পিত সম্পত্তি আইন। তিনি সরাসরি ক্ষমতাসীন সরকারকে হুঁশিয়ার করেছেন এই বলে যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আজীবন ক্ষমতাসীন দলের ভোটব্যাংক হয়ে থাকবে না। অর্থাৎ আইনটি যথাযথভাবে সংসদে গৃহীত না হলে অসন্তোষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কেও গ্রাস করবে। এ ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে অসন্তোষ রয়েছে।
সড়ক অব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত অন্য একটি প্রধান বিষয় সংসদে জোরেশোরে উচ্চারিত হয়নি। এ ক্ষেত্রে জনমনে তীব্র অসন্তোষ রয়েছে। কারণ হলো, সড়ক দুর্ঘটনাহেতু প্রায় প্রতিদিন মৃত্যুর ঘটনা। অবিরাম মৃত্যুর ঘটনার জন্য সুশীল সমাজসহ মিডিয়াও সরব। স্বজনদের মৃত্যুজনিত কারণে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য ব্যথিত স্বজনরাও সরকারের ওপর দারুণ অসন্তুষ্ট। এত বড় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন সংসদের আলোচনায় প্রাধান্য পায়নি, তা বোধগম্য নয়। সংশ্লিষ্টরা হয়তো মনে করছেন, সময় অতিবাহিত হলেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। অর্থাৎ অসন্তোষ প্রশমিত হবে বা হ্রাস পাবে। কিন্তু বর্তমানেই যে নিয়ন্ত্রণ আয়ত্তের বাইরে, তবে কি ভবিষ্যতে অসন্তোষ কমে যাবে_এ নিশ্চয়তা দেওয়া যায়? এ প্রসঙ্গে আরো বলা যায়, পরীক্ষাবিহীন প্রক্রিয়ায় ১০ বা ২০ হাজার লাইসেন্স দিয়ে এবং গরু-ছাগল চেনার ক্ষমতা নিয়ে যে মন্ত্রী এ প্রস্তাবের সপক্ষে 'জোরালো' যুক্তি প্রদর্শন করেছেন, তিনি কেন সংসদে অধিকতর সমালোচনার বিষয় হলেন না? তাঁর বক্তব্য চমকপ্রদভাবে ব্যতিক্রমধর্মী হতে পারে, কিন্তু যে প্রক্রিয়া তিনি অবলম্বন করেছেন, তা সুস্পষ্টভাবে প্রচলিত ও সংশ্লিষ্ট আইনের লংঘন।
প্রচলিত আইন প্রয়োগের কারণেও রয়েছে অসন্তোষ। এর প্রতিফলন দেখা গেছে সম্প্রতি গাবতলীতে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভুয়া লাইসেন্সধারীদের শাস্তি প্রদানের চেষ্টা করেও সফল হননি। যে সাজা তিনি দিয়েছিলেন, প্রতিবাদের মুখে বাধ্য হয়ে তা হ্রাস করে ৫০০ টাকা জরিমানা ধার্য করেছেন। গাবতলীতে কিছুক্ষণের জন্য যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলেন প্রতিবাদমুখর মোটর শ্রমিকরা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা যে আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর কিছু না হোক, অন্তত প্রস্তাবিত আরো ২৪ হাজার লাইসেন্স পরীক্ষাবিহীন প্রক্রিয়ায় যেন আর না দেওয়া হয়, তা চিরতরে বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একটি নির্দেশ জনসমক্ষে প্রকাশ করলে ভবিষ্যতের অসন্তোষ হ্রাস করা সম্ভব ছিল। এখন পর্যন্ত তা হয়নি। আদৌ হবে কি না তা জানা নেই।
লেখক : তত্ত্বাবধয়াক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.