শেকড়ের ডাক-জনতার হাড্ডিচূর্ণ দিয়ে এমপিদের গাড়িবিলাস by ফরহাদ মাহমুদ

এবারের ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের যতটা কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত আর কখনো তাদের তা করতে হয়নি। সড়কগুলোর চরম বেহাল অবস্থার কারণে অনেক রাস্তায় যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। অনেক রাস্তায় কোনো রকমে যানবাহন চললেও যাত্রীদের হাড়-হাড্ডি চূর্ণ হওয়ার মতো অবস্থা বিদ্যমান।


তার পরও অনেকে বাসের টিকিটও জোটাতে পারেননি। সড়কের বেহাল অবস্থা দেখে অনেকে ছুটে গিয়েছিলেন রেলস্টেশনে। আগের রাতে লাইনে দাঁড়িয়েও পরদিন বেলা ২টায় 'টিকিট নাই' সাইনবোর্ড দেখে মুখটাকে বাংলা পাঁচ বানিয়ে ঘরে ফিরতে হয়েছে তাঁদের। দক্ষিণাঞ্চলের বহু মানুষ হয়তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিটনেসহীন লঞ্চের ছাদে উঠতে বাধ্য হবেন। তার পরও অনেকের ধারণা, এবারের ঈদে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ নিকটজনদের কাছে যেতে পারবেন না। জনদুর্ভোগ যখন এই পর্যায়ে, তখন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর আমাদের শুধু আশ্চর্যই করেনি, লজ্জাও দিয়েছে। গত শনিবারের (২০ আগস্ট) কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবরটিতে বলা হয়েছে, সরকারি ও বিরোধী দলের মোট ১৮০ জন এমপির শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিলাসবহুল গাড়ি আমদানিতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে ৫৫৫ কোটি টাকা।
একটি উপমা দিতে সংকোচ বোধ করছি, আবার না দিয়েও পারছি না। কারণ এ ক্ষেত্রে এর চেয়ে জুতসই উপমা খুঁজেও পাচ্ছি না। তাই মান্যবর এমপিদের কাছে আগেভাগেই সবিনয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত একটি কথা রয়েছে, তা হলো_'চোরে চোরে মাসতুতো ভাই।' বলা হয়ে থাকে, অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অনেক বিরোধ থাকলেও চুরির ক্ষেত্রে নাকি বিরোধ থাকে না। আমাদের এমপিদের অবস্থাও অনেকটা তেমনই। সরকারি দল আর বিরোধী দলের সদস্যরা পারতপক্ষে পরস্পরের ছায়া মাড়ান না, বক্তৃতা-বিবৃতিতে একে অপরের 'চৌদ্দপুরুষের পিণ্ডি উদ্ধার' বলতে যা বোঝায়, তা-ই করে থাকেন। অথচ সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা যেন সেই 'মাসতুতো ভাই'। তখন তাঁদের গলায় গলায় ভাব আর দেখে কে?
এমপিরা তো সবাই জনপ্রতিনিধি। তার মানে, তাঁরা আমাদেরও প্রতিনিধি। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির অব্যাহত সংকট, রাস্তার বেহাল দশায় যখন জনজীবন চরম সংকটে, তখন এমপিদের গাড়িবিলাসের খবরটি অপ্রত্যাশিত। কারণ বিগত নির্বাচনে জনগণ তাঁদের নির্বাচিত করেছিলেন এই আশায় যে তাঁরা জনগণের স্বার্থ দেখবেন, দেশের স্বার্থ দেখবেন। এই কি তাঁদের জনস্বার্থ দেখার নমুনা? ভাঙা রাস্তায় চলতে গিয়ে প্রতিদিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষের অসংখ্য যানবাহন। দুর্ঘটনায় হতাহত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অথচ সড়ক সংস্কারের কাজে এক বছরের জন্য যে বাজেট থাকে, তার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতি করেছেন মাত্র ১৮০ জন এমপি বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করে। কেউ কেউ সে রকম দুটি বা তিনটি গাড়িও আমদানি করেছেন। এ কী হরিলুট! অর্থনৈতিকভাবে ভারত আমাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। সেখানকার এমপিদের অনেকেরই ব্যক্তিগত গাড়ি নেই, অনেকে দেশপ্রেম থেকে সে দেশে তৈরি গাড়িতেই চড়েন। হাতে গোনা কয়েকজন এমপি পাওয়া যেতে পারে, যাঁরা বিদেশি বিলাসবহুল গাড়িতে চড়েন। কিন্তু বিনা শুল্কে তাঁদের কাউকেই গাড়ি আমদানি করতে দেওয়া হয় না। তাতে কি ভারতের এমপির মান-মর্যাদায় কোথাও পেছনে পড়ে গেছেন? অথবা তাঁরা কি লাগাতার সংসদ বর্জনের এমন কোনো রেকর্ড গড়েছেন? আর এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও আমাদের জাতীয় সংসদ কি খুব একটা কার্যকর হতে পেরেছে? দেশি-বিদেশি প্রচারমাধ্যমে তো বরাবরই বলা হচ্ছে, বিরোধী দলের অব্যাহত অনুপস্থিতি সংসদকে প্রায় অকার্যকর করে দিয়েছে। এমনকি জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতেও বিরোধী দলকে আমরা সংসদ অধিবেশনে দেখতে পাচ্ছি না। কেন? নিজের স্বার্থ আদায়ের জন্য যদি তাঁরা সংসদকে ব্যবহার করতে পারেন, তাহলে দেশ ও জনগণের স্বার্থ আদায়ের জন্য তাঁরা কেন সংসদে যেতে পারবেন না? তখন বলবেন, সংসদে যাওয়ার পরিবেশ নেই। তাহলে কোটি টাকার শুল্কমুক্ত গাড়ি নেওয়ার সময় কিংবা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার সময় পরিবেশ ঠিক থাকে কী করে? কেবল জনগণের অধিকার আদায়ের নামে কিছু হরতাল দিলেই কি আমরা ধরে নেব যে বিরোধী দল সত্যিকার অর্থেই জনগণের কথা ভাবে? তখন হরতালের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক নয় কি? আর সরকারি দলের জনপ্রতিনিধিরাই বা কী করছেন? সংসদে 'হ্যাঁ' বলা অথবা হাত তোলা এবং নিজেদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা_এই তো? শাবাশ!
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এমপিদের বিনা শুল্কে গাড়ি আনার বিধানটি বাতিল করা হয়েছিল। কারণ এই সুবিধায় অনেকে একাধিক গাড়ি এনে বিক্রি বা হস্তান্তর নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও সেগুলো বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছিলেন। সেসব গাড়ির খোঁজখবর নিতে শুরু করলে তখন কয়েক কোটি টাকা দামের গাড়িও রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেও বলেছিল, তারা এ বিধানটি আবার চালু করবে না। অর্থাৎ নতুন করে বিনা শুল্কে গাড়ি আমদানি করার সুযোগ আর দেওয়া হবে না। আমরাও খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে যে রাষ্ট্রের ক্ষতি এবং কিছু অনাচার থেকে বাঁচা গেল। কিন্তু সহসাই জাতিকে হতাশ করে মহাজোট সরকার তাদের অবস্থান বদলাতে বাধ্য হলো। আর এ ক্ষেত্রে এমপিরা নিজেদের মধ্যকার বিভেদ-বিরোধ ভুলে গিয়ে রীতিমতো কোমর বেঁধে নেমেছিলেন। সমস্বরে চিৎকার করে বলেছিলেন, বিনা শুল্কে গাড়ি আমদানির সুযোগ দিতে হবে। সরকারি ও বিরোধী দলের এমপিদের এমন অনড় দাবির কাছে সরকার নতিস্বীকার করল। প্রথমে বলা হলো, বিলাসবহুল নয়, ২০০০ সিসি পর্যন্ত সাধারণ গাড়ি বিনা শুল্কে আমদানি করতে দেওয়া হবে। কিন্তু এমপিরা তাতে সন্তুষ্ট হলেন না। তাঁদের দাবি এবং চাপ_কোনোটাই কমেনি। শেষ পর্যন্ত সরকার পুরোপুরিই নতিস্বীকার করল। সরকারি ও বিরোধী দলের অনেক এমপিই ৪,৪৬১ সিসির অত্যন্ত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করেছেন, যার একেকটির বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা। কেউ কেউ এ রকম দুটি বা তিনটি গাড়িও আমদানি করেছেন। আমাদের বিশ্বাস, এ খবরটি পড়ার পর দেশের বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন বহু মানুষই লজ্জায় ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। আমাদের এমপিরা কি লজ্জিত হয়েছিলেন? নাকি তাঁরা যোগাযোগমন্ত্রীর মতো সহাস্যে নানা রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেবেন?
এমপিরা যাদের জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ যাদের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন, সেই 'নুন আনতে পান্তা ফুরোয়' যে সাধারণ মানুষের বর্তমান অবস্থা তাঁরা সঠিকভাবে জানেন কি? দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির কারণে তাঁদের অনেকেই দুবেলা দুমুঠো ডাল-ভাত জোগাড় করতে পারছেন না। বন্যায় দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে, এক মুঠো খাবার সাহায্যও পায়নি, অনেকেই অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী তাদের দেখতে গিয়েও বেকায়দা অবস্থায় পড়েছিলেন। এদিকে সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী জিনিসপত্রের দাম কমাতে না পেরে জনগণকে কম খাওয়ার উপদেশ দিচ্ছেন। যোগাযোগমন্ত্রী একবার বৃষ্টিকে দুষছেন, আবার বলছেন, 'টাকার অভাবে' সড়কগুলো সংস্কার করা যায়নি। দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশে বৃষ্টি-বন্যা কবে ছিল না? তার পরও তো এত দিন সড়কগুলো মোটামুটি চলাচলের উপযোগীই ছিল। এখন তা-ও নেই কেন? এসব প্রশ্ন করলেই সংবাদমাধ্যমের দোষ হয়ে যায়। সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের অভিন্ন শত্রুতে পরিণত হতে হয় মিডিয়াকে।
এ অবস্থায় আমাদের কী-ই বা করার আছে, আর কী-ই বা বলার আছে! আমরা কেবল বর্তমান সরকার ও সরকারি দলের নেতা-নেত্রীদের অনুরোধ করছি, দয়া করে বিগত নির্বাচনে জনগণকে দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো আবার মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখুন, তার কতটুকু আপনারা রক্ষা করেছেন? সামান্য আত্মসমালোচনা করুন এবং নিজেদের আড়াই বছরের কাজকর্ম মূল্যায়ন করুন। তাহলে এভাবে ছায়াকে শত্রু ভেবে যা-তা বলার প্রয়োজন হবে না। আর বিরোধী দলের প্রতি অনুরোধ, মুখে এক আর কাজে আরেক_এই দ্বিমুখী নীতি ত্যাগ করুন, সংসদে যান এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করুন। কেবল নিজের স্বার্থ নয়, দেশের স্বার্থ দেখাটাও আপনাদের দায়িত্ব। জনগণ এখন আর অত বোকা নয়। তারা অনেক কিছুই বুঝতে পারে। ভালো কাজ করলে তারা ভালো মূল্যায়নই করে।
লেখক : সাংবাদিক
fmahmud53@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.