নজরুলের ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী-কবির অভিষেক by করুণাময় গোস্বামী

১৮৮২ সালের জুলাই মাস। রমেশচন্দ্র দত্তের মেয়ের বিবাহসভায় এসেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কণ্ঠে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে তাঁকে সংবর্ধিত করা হলো। তরুণ রবীন্দ্রনাথও গেছেন সেই বিবাহসভায় আমন্ত্রিত হয়ে। তখন তিনি সন্ধ্যাসংগীতের কবি। বয়স ২১। আগের বছর 'বাল্মীকি প্রতিভা' ও 'ভগ্নহৃদয়' প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র 'সন্ধ্যাসংগীত' কাব্যগ্রন্থের অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন এবং নিজের গলা থেকে ফুলের মালাখানি খুলে তরুণ রবীন্দ্রের গলায় পরিয়ে দিলেন।


এ ঘটনার ৪১ বছর পর ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে হুগলী জেলে অনশন করে যাচ্ছেন নজরুল। বয়স তখন তাঁর ২৪। দেশবাসী উদ্বিগ্ন, দীর্ঘ অনশনে কবির কী জানি কী হয়। রবীন্দ্রনাথ অনশন ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে টেলিগ্রাম করলেন নজরুলকে : Give up hunger-strike. Our literature claims you. এরও আগে ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট নজরুলের সারথ্যে অর্ধসাপ্তাহিক 'ধূমকেতু প্রকাশিত হলে তার জন্য রবীন্দ্রনাথ এক আশীর্বাণী পাঠান এবং তা এই পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভের ওপর মুদ্রিত হয়। এটি হয়ে ওঠে নজরুল অনুরাগী সবার সদাকণ্ঠস্থ একটি কাব্যকণিকা : আয় চলে যায়, রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগি্নসেতু/দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন।/অলক্ষণের তিলকরেখা/রাতের ভালে হোক না লেখা/জাগিয়ে দে রে চমক মেরে/আছে যারা অর্ধচেতন।
এর ছয় মাস পর ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে উৎসর্গ করেন তাঁর গীতিনাট্য 'বসন্ত'। নজরুল তখন আলীপুর জেলে বন্দি। নজরুলের আকৈশোর সুহৃদ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে ডেকে রবীন্দ্রনাথ বলেন : জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্যঃপ্রকাশিত 'বসন্ত' গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। সেখানা নিজের হাতে তাকে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমি যখন নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে পারছি না, ভেবে দেখলাম তোমার হাত দিয়ে পাঠানোই সবচেয়ে ভালো, আমার হয়েই তুমি বইখানা ওকে দিয়ো। রবীন্দ্রানুরাগীদের অনেকেই খুশি হননি এই উৎসর্গকর্মে। তাঁদের উদ্দেশে এর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় যেমন জানিয়েছেন : নজরুলকে আমি 'বসন্ত' গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গপত্রে তাঁকে 'কবি' বলে অভিহিত করেছি। জানি তোমাদের মধ্যে কেউ এটা অনুমোদন করতে পারোনি। আমার বিশ্বাস, তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ। আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ আর রসের সন্ধান করোনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র। মার মার কাট কাট ও অসির ঝনঝনার মধ্যে রূপ ও রসের প্রলেপটুকু হারিয়ে গেছে_উপস্থিত একজন মন্তব্য করলেন। কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এও তোমাদের আবদার বটে। সমগ্র জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তাকে প্রকাশ করবে বৈকি। আমি যদি আজ তরুণ হতাম, তাহলে আমার কলমেও এই সুর বাজত।
কিন্তু তার রূপ হতো ভিন্ন। আরেকজনের মন্তব্য শোনা গেল। দুজনের প্রকাশ তো দুরকম হবেই, কিন্তু তাই বলে আমারটা নজরুলের চেয়ে ভালো হতো, এমন কথাই বা জোর করে বলবে কী করে? যা-ই বলুন, ও অসির ঝনঝনা জাতির মনের আবেগে ভাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নজরুলি কাব্যের জনপ্রিয়তাও মিলিয়ে যাবে_মন্তব্য এল ফরাস থেকে। জনপ্রিয়তা কাব্যবিচারের স্থায়ী নিরিখ নয়, কিন্তু যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে, তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য। রবীন্দ্রনাথ 'বসন্ত' নাটিকার একটি কপিতে নিজের নাম লিখে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে দিয়ে বলেছিলেন : তাকে বলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমস্ত অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি।
জেলখানার ইউরোপীয় ওয়ার্ডার বিস্মিত হয়েছিলেন যে টেগোর ওই প্রিজনারকে বই ডেডিকেট করেছেন। বাংলার বাণীমন্দিরে তরুণ রবীন্দ্রনাথকে অভিষিক্ত করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তখনো কবি বা সংগীত রচয়িতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি ব্যাপক হয়নি, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরগৃহের গণ্ডির বাইরে তখনো তিনি তেমন পরিচিত হয়ে ওঠেননি। রবীন্দ্রকে বঙ্কিমের এই মাল্যদান ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত মূল্যবান, তাতে সন্দেহ নেই। বাংলার বাণীমন্দিরে নজরুল ইসলামকে অভিষিক্ত করেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁকে 'বসন্ত' গীতিনাটিকা উৎসর্গ করে, 'কবি' হিসেবে অভিহিত করে এবং তার বার্তায় বঙ্গ সাহিত্যের দাবি উত্থাপন করে। নানা কারণে বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক রবীন্দ্রনাথকে বাংলা সাহিত্যের ভাবী নায়ক পুরুষরূপে যে অভিনন্দন জানানো তার চেয়েও অনেক বেশি তাৎপর্যময় ছিল, অন্তত আমার ধারণা তা-ই, রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক নজরুলকে অভিনন্দন জানানোর ব্যাপারটি। নানাভাবে এই ঘটনাটিকে বিচার করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের পরিবারের, বন্ধুত্বের ও ব্রাহ্মসমাজের সম্পর্কের বাইরে কাউকে বই উৎসর্গ করার ব্যাপারে উৎসাহ দেখাননি। কিন্তু এই সব সম্পর্কের বাইরে যে তরুণ নজরুলের অবস্থান, তাঁকে তিনি উৎসাহের সঙ্গে এবং আপত্তির মুখে বই উৎসর্গ করেছেন। উৎসর্গপত্রে নজরুলকে তিনি 'কবি' হিসেবে অভিহিত করেছেন। রবীন্দ্রানুরাগীদের অনেকেই তখনো কবি হিসেবে নজরুলকে স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন না। 'যুগের হুজুগ' কেটে গেলে এই 'মার মার কাট কাট' কাব্যের কী হবে, সে বিষয়ে অনেকের সংশয় থাকলেও এর মূল্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সংশয় ছিল না। যুগমানসকে প্রতিফলিত করেছে যে নজরুলের বিদ্রোহী কাব্যপ্রয়াস, তাকে তিনি সাধারণ কাব্য রচনার ওপরে স্থান দিয়েছেন, তাকে তিনি বলেছেন মহাকাব্য। তার বার্তায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : নজরুল যেন অনশন ত্যাগ করেন, এ হচ্ছে তাঁর কাছে বাংলা সাহিত্যের দাবি। মাত্র বছরতিনেক হলো যে পল্টন-ফেরত তরুণ সাহিত্য সাধনা শুরু করেছেন, যিনি কতিপয় কবিতা, গান ও সম্পাদকীয় নিবন্ধ রচনা করেছেন, কথাসাহিত্যে যাঁর প্রয়াসগুলো তখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তাঁকে এ কথা বলা, রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যে_তোমার ওপর বাংলা সাহিত্যের দাবি, তুমি অনশন ত্যাগ করো, তোমার কিছু হলে বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে, সেটা খুবই বড় ঘটনা। 'ধূমকেতু'র জন্য পাঠানো আশীর্বাণীতে সেই ঘোরতর দুর্দিনে জনগণকে জাগিয়ে তোলার প্রয়াসে নজরুলের প্রতি গভীর আস্থা স্থাপন করেও রবীন্দ্রনাথ তরুণ বিদ্রোহীকে অভিনন্দিত করলেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষে যতটা সহজ ছিল রবীন্দ্রনাথকে স্বাগত জানানো, রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ততটা সহজ ছিল না নজরুলকে স্বাগত জানানোর ব্যাপারটি। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র, ঐতিহ্যবাহী জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সদস্য, যে বাড়ি তত দিনে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক মানচিত্রে একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। এহেন রবীন্দ্রনাথকে স্বাগত জানানো বা তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনার ব্যাপারটি বঙ্কিমের পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু নজরুল উঠে এসেছেন এক দীন-দরিদ্র পল্লীগৃহ থেকে। কোনো সামাজিক পটভূমিতে তিনি দাঁড়িয়ে নেই। তদুপরি কবি হিসেবেও তিনি নবাগত। এরই মধ্যে 'বিদ্রোহী' বা 'ভাঙার গান' রচনা করে, কিছু সম্পাদকীয় স্তম্ভ রচনা করে বা অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা বের করে তিনি বিখ্যাত হয়েছেন বটে, তবে এই পরিপ্রেক্ষিতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে যেভাবে গ্রহণ করলেন, তাতে তাঁর প্রতিভার প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা এবং তাঁর বিদ্রোহের সারবস্তু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সমর্থন ব্যক্ত হয়। এর কিঞ্চিৎ পূর্বে বা কিঞ্চিৎ পরে যাঁরা নজরুল ইসলামের সৃজনশীল প্রয়াসগুলোর মূল্যায়ন করেন, তাঁদের কারো বক্তব্যেই এ ধরনের গভীরতা আমরা প্রত্যক্ষ করি না। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের মুখ থেকে বা কলম থেকে এসেছে বলেও তো কথা! এর ভেতর দিয়ে নজরুলের সৃজনশীলতার মূল্যায়নের প্রথম একটি নান্দনিক ভিত্তি দাঁড় করানো যায়। উচ্ছ্বাসের বায়ুতে ভেসে বেড়াচ্ছিল যে বিদ্রোহী কবির জনপ্রিয়তা, তা যেন এবার সুস্থিতির শিকড় খুঁজে পায়। বিশ্বকবির গভীর সমর্থন ও সহমর্মিতা প্রকাশের ভেতর দিয়ে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল মঞ্চ তরুণ বিদ্রোহী নজরুলের ঐতিহাসিক অভিষেক ঘটে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.