বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়-৩৯ বছরের স্বপ্নপূরণ by সাইফুর রহমান

প্রাচ্যের ভেনিস বরিশাল। ধান-নদী-খালের দেশ বরিশাল। শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থান বরিশাল। দীর্ঘদিন ধরে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ বরিশালে ছিল না। এবার বরিশালে উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ আন্দোলন।


বাংলার আদি কবি মীননাথ, মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্ত, গীতি কবি কামিনী রায়, বারো ভূঁইয়ার অন্যতম রাজা রামচন্দ্র রায়, সত্য-দেশমুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত অশ্বিনীকুমার দত্ত, চারণকবি মুকুন্দ দাশ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, রূপসী বাংলা কবি জীবনানন্দ দাশ, দার্শনিক আরজ আলী মাতব্বর, কবি আহসান হাবীব, কবি সুফিয়া কামালসহ বহু জ্ঞানতাপসের পদভারে ধন্য বরিশালে ১৯৬০ সালে সর্বপ্রথম একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বরিশালের বেলস পার্কের (বর্তমান বঙ্গবন্ধু উদ্যান) এক জনসভায় বরিশালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে তখন ব্রজমোহন কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মর্যাদা দেওয়া হয়। বর্তমানে ব্রজমোহন কলেজে ২০টি বিষয়ের ১৮টিতে স্নাতক এবং ১৯টিতে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করার সুযোগ পাচ্ছে। তবে বরিশালবাসীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রায় ৩৯ বছর অপেক্ষা করতে হয়।
তিয়াত্তর-পরবর্তী সময়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সামনে এগোতে থাকে, তখন ঘটে ক্ষমতার পটপরিবর্তন। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের কারণে তা বাস্তবায়িত হতে পারেনি। ১৯৭৯ সালের ২৩ নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বরিশালের সার্কিট হাউসে এক কেবিনেট সভায় বরিশালে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন।
এরপর ১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করলে বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন আবারও মুখ থুবড়ে পড়ে। ১৯৮৯ সালে খুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ফুঁসে ওঠে। শুরু হয় আন্দোলন। একই সঙ্গে ঢাকায় বরিশাল সমিতি প্রেসক্লাব চত্বরে এবং বরিশালে অশ্বিনীকুমার হল চত্বরে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করে ছাত্রসহ সর্বস্তরের মানুষ। আন্দোলন করার অপরাধে তখন ৩০-৩৫ জন গ্রেপ্তার হয়।
নব্বইয়ের দশকে এই আন্দোলন আরও জোরদার হতে থাকে। ১৯৯১ সালে প্রথম বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে তারা কোনো উদ্যোগ নেয়নি। পরবর্তী সময়ে আশ্বাস আর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে কেটে যায় আরও ২০ বছর।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বরিশাল ও পটুয়াখালীতে দুটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। তখনো বরিশালবাসী বরিশালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালে পটুয়াখালীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হলেও বরিশালে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হয়নি।
২০০১ সালে পুনরায় বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে ২২ হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত করে ব্রজমোহন কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার উদ্যোগ নেয়। একই সঙ্গে প্রকল্প পরিচালকও নিয়োগ করা হয়। এ সময় দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণ মানুষ এই উদ্যোগের বিরোধিতা করে এবং ব্রজমোহন কলেজের স্বকীয়তা নষ্ট না করে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে।
একপর্যায়ে বিএনপি সরকার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় এবং ২০০৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বরিশাল নগরের অদূরে ডেফুলিয়ায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। অবশ্য পরে সংসদে আইন পাস করা হয় জিয়াউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় নামে। শুরু হয় আরেক ষড়যন্ত্র। পরবর্তী সময়ে আর ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর বরিশালে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় পুনরায় বরিশালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বরিশালে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দলেরই নির্বাচনী ইশতেহারে স্থান পায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প। মহাজোট ক্ষমতায় এসে প্রথম জিয়াউর রহমানের নামে করা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আইন বাতিল করে। একই সঙ্গে ৩০ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখ একনেকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পায়। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ, ৩ মার্চ প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়ার পর একই বছর ২৮ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বরিশালে এসে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য স্থান পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি নগরের কীর্তনখোলা নদীর পূর্ব তীরে কর্ণকাঠী এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে—এমন মন্তব্য করেন। ১৬ জুন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুমোদন পায়।
এত কিছুর পরও বরিশালবাসীর মনের শঙ্কা দূর হয়নি। একপর্যায়ে ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বরিশালবাসীর মনে আশঙ্কা থেকে দাবি ওঠে দ্রুত শিক্ষার্থী ভর্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার।
২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরিশালের কর্ণকাঠী এলাকায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এবং গত ২৪ জানুয়ারি প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। দীর্ঘ ৩৯ বছরে বরিশালবাসীর শঙ্কা দূর করে স্বপ্ন পূরণ হয়।
কলা, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, বিজনেস স্টাডিজে চার অনুষদের ছয় বিষয়ে ৪০০ শিক্ষার্থী নিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করেছে। প্রথম ব্যাচে ভর্তির জন্য প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে বাছাই করে সেরা শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়।
বরিশাল নগরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কীর্তনখোলা নদীর পূর্ব পাড়ে কর্ণকাঠী এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৫০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। ইতিমধ্যে ৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। দুটি একাডেমিক ও দুটি প্রশাসনিক ভবন এবং তিনটি ছাত্রাবাস নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মনে শঙ্কা দূর করতে নিজস্ব স্থাপনা নির্মাণের আগেই বরিশাল জিলা স্কুল ক্যাম্পাসের তিনটি ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পতাকা ও লোগো তৈরি করা হয়েছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে বরিশালবাসীর যে স্বপ্নপূরণের সূচনা হলো, ভবিষ্যতে এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতাও প্রয়োজন হবে। তাহলে ভবিষ্যতে আলোকিত মানুষ যেমন গড়ে উঠবে, তেমনি বৃহত্তর বরিশাল তথা বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতে পুনর্জাগরণ ঘটবে।
সাইফুর রহমান: সংবাদ ও সংস্কৃতিকর্মী, বরিশাল।

No comments

Powered by Blogger.