জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির জেরঃ বেড়ে যাচ্ছে পণ্য পরিবহনের ট্রাক ভাড়া by আবুল হাসনাত

প্রায় দুই মাসের ব্যবধানে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করায় যাত্রী ও পণ্য পরিবহনব্যয় আরেক দফা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আর পরিবহনব্যয় বেড়ে গেলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দামও বেড়ে যাবে। গত ১০ নভেম্বর মধ্যরাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। নতুন দর অনুযায়ী প্রতি লিটার অকটেন ৮৯, পেট্রল ৮৬, ডিজেল ও কেরোসিন ৫৬ এবং ফার্নেস তেলের দাম ৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর অকটেন, পেট্রল, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা এবং ফার্নেস তেলের দাম প্রতি লিটারে আট টাকা বাড়ানো হয়। তার আগে গত ৫ মে জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি দুই টাকা করে বাড়ানো হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানে খাদ্যসামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহন করা হয় ট্রাকে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে ট্রাকের ভাড়া বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে পণ্য পরিবহনব্যয়ে। সাধারণত, ট্রাকে জ্বালানি তেল হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করা হয়।
মেহেরপুর থেকে ফুলকপি নিয়ে আসা ট্রাকচালক হাশেম আলীর সঙ্গে কথা হয় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে। তিনি জানান, আগের ভাড়াতেই শুক্রবার রাতে মেহেরপুর ছেড়ে এসেছেন। তবে তিনি এ-ও বলেন, ‘শুনছি, আজকে (শনিবার) রাতে যারা মালামাল লোড করবে, তারা বেশি ভাড়া নেবে।’
কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির কোষাধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত ট্রাকচালকেরা বেশি ভাড়া নেননি। তবে আজ (শনিবার) থেকে বেশি ভাড়ায় পণ্য আনা-নেওয়া করবেন। এর চাপটা ক্রেতার ওপরই পড়বে।’
ট্রাকমালিকেরা অবশ্য বলছেন, সরকারের ঘোষণার পর থেকেই ট্রাকের ভাড়া বেড়ে গেছে। তবে বিভিন্ন স্থানে পণ্যের সরবরাহ কম থাকায় গত দুই দিন আগের ভাড়াতেই পণ্য পরিবহন করছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে মিল রেখে পরিবহনব্যয়ও বাড়ানো হয়েছে।
ট্রাকমালিকদের সমিতি সূত্রে জানা যায়, ঢাকা থেকে দিনাজপুরের দূরত্ব প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। এই পথে ডিজেল লাগে ৯০ থেকে ১০০ লিটার। সে হিসাবে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। কিন্তু ট্রাকগুলো এখনই ভাড়া বাবদ দেড় থেকে দুই হাজার টাকা করে বেশি নিচ্ছে। এত দিন দিনাজপুর থেকে এক ট্রাক খাদ্যপণ্য আনতে গড়ে ১২ হাজার টাকা দিতে হতো।
একইভাবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পণ্য পরিবহনে ডিজেল লাগে ৬০ লিটার। সে হিসাবে ভাড়া বাড়ার কথা ৩০০ টাকা। কিন্তু এখন নেওয়া হচ্ছে অন্তত এক হাজার টাকা বেশি। এত দিন গড় ভাড়া ছিল ১০ হাজার টাকা।
তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা অনেকেই জানিয়েছেন, ট্রাকমালিকেরা যে ভাড়ার কথা বলছেন, বাস্তবে তার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করা হয়।
মৌলভীবাজারের একজন মসলা আমদানিকারক বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে রসুন ঢাকার শ্যামবাজারে আনতে এত দিন ব্যয় হতো ১৪ হাজার টাকা। অথচ আজ (শনিবার) একই পরিমাণ রসুন ট্রাকে তুলতে হচ্ছে ১৮ হাজার টাকায়। এই রসুন তো বেশি দামে বিক্রি না করে উপায় নেই।’
ট্রাকের ভাড়া বাড়ার ক্ষেত্রে এ রকম বিশৃঙ্খলার বিষয়টি অবশ্য স্বীকার করেন রুস্তম আলী। তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয়ভাবে ট্রাকের ভাড়া তদারক করা যায় না বলে একেকজন একেক ভাড়া নিয়ে থাকেন। কেন্দ্রীয় তদারকব্যবস্থা থাকা উচিত।’ বাসের মতো ট্রাকের ভাড়াও সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করার পক্ষে মত দেন তিনি।
পাইকারি চিনি ও ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কয়েক দিন আগেও মেঘনাঘাট থেকে ট্রাকে করে ১৬ টন চিনি কিংবা ভোজ্যতেল রাজধানীর মৌলভীবাজারে আনতে ট্রাক ভাড়া লাগত সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে এখন টনপ্রতি ৫০ টাকা করে বেশি ভাড়া হাঁকছেন ট্রাকমালিক ও চালকেরা।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হাশেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ায় বিভিন্ন পথে প্রতি গাড়িতে এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত করে ভাড়া বাড়বে। ঘন ঘন জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার দ্রব্যমূল্য কমানোর আশা করে কীভাবে?’
পাইকারি চিনি ও ভোজ্যতেলের এই ব্যবসায়ীর দাবি, বর্তমান জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে প্রতি টন চিনির দাম ৫০ থেকে ৭০ ও ভোজ্যতেলের দাম ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
কিছু ক্ষেত্রে পরিবহন ভাড়া বাড়লেও ক্রেতা না থাকায় তার প্রভাব এখনো কাঁচাবাজারে পড়েনি। তাই আগের দামেই বেশির ভাগ সবজি বিক্রি হচ্ছে। তবে দুই-তিন দিনের মধ্যেই তেলের দাম বাড়ার প্রভাব বাজারে পড়তে পারে বলে মনে করছেন আড়তদারেরা।
চালের বাজার এখনো স্থিতিশীল আছে। তবে বাবুবাজারের একজন চাল ব্যবসায়ী বলেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে পরিবহনব্যয় বাড়বে। মিলমালিকেরাও হয়তো চালের দাম বাড়িয়ে দেবেন। তখন আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হবে।’
পরিবহনব্যয়ের কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ার প্রসঙ্গে রুস্তম আলী বলেন, ‘আমরা যে ভাড়ায় মাল আনি তাতে প্রতি কেজি চালে খরচ বাড়ে পাঁচ থেকে ১০ পয়সা। কিন্তু তারা দাম বাড়ায় এক থেকে দুই টাকা। আমরা কী করব?’

No comments

Powered by Blogger.