নিরাপদ খাদ্য আইনএ by এম এম শওকত আলী

বহু বছর ধরেই খাদ্য আমদানিনির্ভর দেশগুলোর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে খাদ্য নিরাপত্তার অর্থ সবাই যাতে সহজেই খাদ্য গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। প্রকৃত অর্থ তা নয়।
১৯৯৬ সালে এফএওর উদ্যোগে বিশ্ব খাদ্য সামিট অনুষ্ঠিত হয়। এ সামিটে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী সবার জন্য খাদ্য গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করাই খাদ্য নিরাপত্তা নয়। যে খাদ্য গ্রহণ করবে তা নিরাপদ হতে হবে। এ দৃষ্টিকোণে বিচার করলে বলা যায়, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা খাদ্য নিরাপত্তারই অংশবিশেষ। এ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। তবে বিষয়টি নিঃসন্দেহে জটিল। এ জটিলতা দূর করার লক্ষ্যে সরকার সম্প্রতি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি একক কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এ নতুন উদ্যোগের কারণ মূলত দুটি। এক. বিদ্যমান নিরাপদ খাদ্য আইন ১৯৫৯ সালে প্রবর্তন করা হয়। একাধিক মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে এ আইনের অধীনে আইনটি প্রয়োগ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে সমন্বয়ের কাজটি কঠিন। এ ছাড়া পাঁচ দশকের বেশি পুরনো আইনটি বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে অচল। এক দশক ধরেই নিরাপদ খাদ্য নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। অতীতে ফল বা মাছের বিশুদ্ধতা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। এখন মিডিয়ায় এ বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। জানা গেছে, ফল পাকানো বা বেশি দিন সংরক্ষণ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এ বিতর্ক মাছ সম্পর্কেও। মাছে ফরমালিন ব্যাপক হারে মেশানো হচ্ছে। উদ্দেশ্য মাছের পচন রোধ করা।
খাদ্য বিশেষজ্ঞরা এ বিষয় নিয়ে সোচ্চার হলে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ফরমালিনমুক্ত বাজার ঘোষণা করা হয়েছে। এ ঘোষণার পর প্রকৃতপক্ষে এটা করা সম্ভব হয়েছে কি না, তা কেউ খতিয়ে দেখেনি। ধরে নেওয়া হচ্ছে, ঘোষণাটি ফলপ্রসূ হয়েছে। মাছ ছাড়াও ফল নিয়ে এ বিতর্ক জোরদার হয়েছে। বলা হচ্ছে, আমের মৌসুমে সহজে আম পাকানোর জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। কিছুদিন আগে মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, আম গাছে থাকা অবস্থায় রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহৃত হয়। ঢাকার কিছু জায়গায় ব্যানার টানিয়ে ফরমালিনমুক্ত আম বিক্রি করা হয়। আসলে যে আম বিক্রি করা হয়, তা নিরাপদ কি না জানার উপায় নেই। মাছের জন্য অবশ্য একটি সরকারি গবেষণা সংস্থা ফরমালিন মাছে আছে কি না তা বের করার উপায় উদ্ভাবন করেছে। ফরমালিন কিট নামে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি এখন বিক্রিও হয়। কিন্তু সহজেই বোঝা যায়, এর ব্যাপক ব্যবহার এখনো হয়নি।
নতুন আইনের দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা যায়, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য মিডিয়াসহ সুশীল সমাজ এক দশক ধরেই সোচ্চার ছিল। এখনো তাই। তবে এ দুই কারণের জন্যই যে এটা হয়েছে বা হবে, এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রধান সংবাদ ছিল সরকার খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠা করতে গড়িমসি করছে। বুলেট আকারে চারটি কথা ছাপাও হয়েছিল। এক. চার বছর আগে হাইকোর্ট ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণে আদালত প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেয়। দুই. এর বিপরীতে সরকার কেবল গেজেট প্রকাশ করে। তিন. প্রকাশিত গেজেটে কোনো বিস্তারিত রূপরেখা নেই। চার. কেবল ঢাকা সিটি করপোরেশন ও বিএসটিআইয়ের ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধের জন্য পরিদর্শন টিম রয়েছে। এ ছাড়া আরো কয়েকটি বিষয় প্রকাশিত সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। গেজেটের প্রজ্ঞাপন সম্পর্কে আইনমন্ত্রী জানেন না, তবে আইন প্রতিমন্ত্রী এ বিষয়টি জানেন। প্রতিমন্ত্রী এসব আদালত শিগগিরই কাজ শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে কয়েকটি জেলার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট গেজেটে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপন পেয়েছেন। আইনসচিবের এ বিষয়ে সোজা মন্তব্য। মন্ত্রণালয়ের যা দায়িত্ব তা করা হয়েছে। এখন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট দায়িত্ব প্রদান করবেন। যে যাঁর বক্তব্য দিয়েছেন। এখন কবে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা কাজ শুরু করবেন, সেটাই হলো মুখ্য প্রশ্ন।
স্মরণ করা যেতে পারে, মোবাইল কোর্ট আইন অনুযায়ী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ভেজাল খাদ্য বা অন্য কোনো ব্যবহারযোগ্য পণ্যের প্রস্তুত বা বিপণন রোধে শাস্তি দিতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। তাঁরা এ কাজ করছেনও, তবে এর পরও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবীর অভিমত হলো, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের এ-সংক্রান্ত কার্যক্রম ঢাকার মধ্যে সীমিত। এ কারণে ভেজাল খাদ্যের বিপণন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। তবে প্রকাশিত সংবাদে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এ তথ্য আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে পাওয়া গেছে মর্মে প্রতিবেদক বলেছেন। তথ্যটি হলো, আইন মন্ত্রণালয় শিগগিরই ম্যাজিস্ট্রেটদের নিরাপদ খাদ্য আইন প্রয়োগের জন্য ক্ষমতা প্রদানের বিষয়টি সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ কামনা করবে। এ কোর্টের অভিমত ইতিবাচক হলে আইন মন্ত্রণালয় গেজেটে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করবে।
এ বিষয়ে আরো জানা যায়, ১০ আগস্ট ২০১০ হাইকোর্ট ভেজাল খাদ্য রোধে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ প্রয়োগ করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন। এ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা মতে আসামি দোষী প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অভিযোগ করা হয়েছে, সরকার এ বিষয়ে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এ বিষয়ে জটিলতা হলো বিভিন্ন মাত্রায় শাস্তি। সাধারণ ধারণা হলো, মোবাইল কোর্ট লঘু শাস্তি প্রদান করেন। কঠিন শাস্তি প্রদানের জন্য অন্য ধারণা হলো, এ ধরনের শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে সব ধরনের অপরাধ দমন করা সম্ভব। এ ধরনের ধারণা বর্তমান বিশ্বের বহু সভ্য দেশে পাল্টে গেছে। জানা যায়, মৃত্যুদণ্ড বহু দেশের আইন থেকে রহিত করা হয়েছে। অন্যদিকে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ একটি বিতর্কিত আইন। কারণ এ বিষয়ে অনেকেই মনে করেন, এটি একটি কালো আইন। এ আইনকে বিলুপ্ত করার জন্য অনেকেই একমত; কিন্তু আইনটি কোনো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল রহিত করেনি। কারণ বিনা বিচারে কোনো ব্যক্তিকে আটক রাখার জন্য সব দলই কমবেশি এ আইনকে ব্যবহার করেছে। আইনে কঠিন শাস্তির বিধান নিয়েও আইনবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। তাঁদের মতে, এ ধরনের আইনের ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অত্যাচারের সৃষ্টি করেন। আলোচ্য অর্থাৎ খাদ্য নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি নীতিনির্ধারকরা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার চিন্তাভাবনা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
১৯৫৯ সালের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান ছিল তিন বছরের কারাদণ্ড ও তিন লাখ টাকা জরিমানা। অন্য সূত্রমতে, পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা তিন মাসের কারাদণ্ড। ১৯৫৯-এর আইনে মাত্র আটটি পণ্য বা খাদ্যসামগ্রী ভেজালের জন্য শাস্তি দেওয়ার বিধান ছিল। বর্তমান আইনে ২০০ খাদ্যপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মিডিয়ায় প্রস্তাবিত আইন সম্পর্কে এরই মধ্যে যেসব বিশ্লেষণ প্রকাশ করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল এ আইনে বিচার কে করবে? বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট না নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। তবে যেহেতু আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণ করবে, এ জন্য ধরে নেওয়া যায় যে গৃহীত পরামর্শের আলোকেই দুই ধরনের ম্যাজিস্ট্রেটদের এখতিয়ার নির্ধারিত হবে। এ বিষয়ে এখনই কিছু নিশ্চিত করে বলা যাবে না।
নতুন নিরাপদ খাদ্য আইন সম্পর্কে এক সম্পাদকীয় মন্তব্যের শিরোনাম ছিল- আইনটিতে দোষীদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে (Food Safety Law with Some Teeth)। উপশিরোনাম ছিল কঠোরভাবে প্রয়োগ না করলে এ আইন ফলপ্রসূ হবে না। এসব মন্তব্য সব ধরনের কঠোর আইনের জন্যও প্রযোজ্য। পরিতাপের বিষয় হলো, বাস্তবতা ভিন্নতর। ১৯৫৯ সালের আইন একেবারেই অচল ছিল না। এ আইন প্রয়োগের জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার প্রয়োজন ছিল, তার দিকে কখনো দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। ধরে নেওয়া হয়েছে যে আইন ও আদালতের ব্যবস্থা করলেই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। নতুন আইনের মাধ্যমে আইন প্রয়োগের ক্ষমতা একটি একক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হবে। যুক্তি দেখানো হয়েছে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অভাবে অতীতে আইন প্রয়োগ করা যায়নি। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৬-০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার বিষয়ে একটি সমীক্ষা সম্পন্ন করে। তিনজন দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ দ্বারা প্রণীত এ সমীক্ষার সুপারিশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পেশ করা হলেও এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এ বিষয়ে কোনো সরকারই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অন্যদিকে নতুন আইন প্রয়োগের বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী একটি মন্তব্য করেছেন, যা প্রণিধানযোগ্য। একক প্রতিষ্ঠান চালু হলেও সংশ্লিষ্ট অন্য মন্ত্রণালয় বা সংস্থা ও দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। নতুন প্রতিষ্ঠানটি সবার সহযোগিতা নিয়েই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করবে। অর্থাৎ আগের মতো একাধিক সংস্থাকে সমন্বিতভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ বিষয়টি নিশ্চিত করা অত সহজ নয়। ভেজাল খাদ্য একটি বিশেষ অপরাধ। অন্যান্য অপরাধ দমনে যেমন পুলিশ, প্রসিকিউটর ও আদালত জড়িত- এ ক্ষেত্রেও তারাই কাজ করবে। তবে এ প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে আইনের অধীনে ক্ষমতাপ্রাপ্ত পরিদর্শক ও নির্ধারিত গবেষণাগার বা ল্যাবরেটরি। খোলাবাজার থেকে নমুনা নিয়ে নির্ধারিত ল্যাবরেটরিতে মান পরীক্ষার জন্য পরিদর্শক ব্যবস্থা নেবেন। পরীক্ষাগার যদি নমুনায় ভেজাল আছে মর্মে প্রতিবেদন দেয়, তাহলেই আদালত উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে রায় ঘোষণা করবেন।
জানা গেছে, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা বিষয়ক একক প্রতিষ্ঠান খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ হবে। এ উদ্যোগকে ফলপ্রসূ করতে হলে উপযুক্তসংখ্যক দক্ষ জনবলেরও প্রয়োজন হবে। এ বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে সময়সাপেক্ষ।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.