সদরে অন্দরে'দীপ নিভে যায়' by মোস্তফা হোসেইন

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বসে আছে ছেলে। হঠাৎ চিৎকার। মাকে ডাকছে। বুয়েটে তার ইয়ারমেট এক ছাত্রী শাম্মা নাসরীন প্রেসক্লাবের সামনে বাসের ধাক্কায় গুরুতর আহত। বন্ধুরা স্ট্যাটাস দিয়েছে, রক্ত প্রয়োজন।
সহপাঠী হিসেবে ছেলের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা স্বাভাবিক। কিন্তু রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল শ্রোতা মা-বাবা দুজনেরই। সম্পূর্ণ অচেনা, এমনকি যার নামও কোনো দিন শুনিনি, সেই মেয়েটি আমার মেয়ে হয়ে যায়। খুব সম্ভব 'ও নেগেটিভ' ছিল রক্তের গ্রুপ। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজনকে ফোন করে অনুরোধ করে সাড়া পাওয়া যায়। মেয়েটির নিকটজনদের কাছ থেকে জানা গেল হয়তো একটি পা-ই কেটে ফেলতে হবে তার। 'ওহ!' একটা শব্দ বেরিয়ে এসেছিল মন থেকে। চোখে ভাসতে থাকে সনির গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার কথা। শাম্মারই মতো সেও ছিল বুয়েটের ছাত্রী। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনি কী নির্মমভাবে নিহত হয়েছিল তারই মতো কিছু মেধাবী শিক্ষার্থীরই হাতে। শাম্মা নাসরীনও কি তাহলে সনির পথ অনুসরণ করবে? হিসাব কষতে হয় বুয়েটের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার। দাগ কেটে যাওয়া ঘটনা ছিল সনি নিহত হওয়ার ঘটনাটি। তারিখ ছিল ২০০২ সালের ৮ জুন। প্রিয় ক্যাম্পাসে জীবনের বিশাল স্বপ্ন নিয়ে ঘুরছিল সনি। মা-বাবা নিশ্চয়ই মেয়ের স্বপ্নের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু পাষণ্ডদের তাণ্ডব তছনছ করে দিয়েছিল সনির পরিবারের সব স্বপ্ন। খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত মোকাম্মেল হায়াত মুকি সনিরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হল শাখার অধিবাসী ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতা টগরের গ্রুপ। তৎকালে ক্ষমতাসীন দল বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের সদস্য ওরা। টেন্ডার নিয়ে দুই গ্রুপের মারামারি এক পর্যায়ে বন্দুকযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল। সেই যুদ্ধের বলি হয় সনি।
সনির মৃত্যুর মাস জুন। ২০০২ সাল। আর ২০১৩ সালের জুনে এসে ঘটল আরেকটি ঘটনা। সনির মৃত্যুদিবস ৮ জুনের দুই দিন আগে বুয়েটের আরেক ছাত্র আরিফ রায়হান দীপের দীপ নিভে গেল। তাও বুয়েট ক্যাম্পাসেরই ঘটনা। এবার টেন্ডারবাজি কিংবা নিজ দলীয় সদস্যদের হাতে নয়। দীপের দীপ নিভে যায়, সাম্প্রদায়িক শক্তির আঘাতে। সেখানেও আঙুল যায় বুয়েটেরই আরেক ছাত্রের দিকে। মেজবাহউদ্দিন নামের এক শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দীপের খুনের অভিযোগে। সনির খুনিরা লিপ্ত ছিল অছাত্রসুলভ কাজে আর দীপের কথিত খুনির পরিচয় যেটুকু প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায়, সে ছিল মৌলবাদী গোষ্ঠীর ক্রীড়নক। যাকে সনির খুনিদের চেয়েও নেতিবাচক হিসেবে গণ্য করতে হয়।
প্রশ্নটা এখানেই। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুয়েট, যেখানে দেশের সেরা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সমাবেশ। সেখানেও অপশক্তিগুলো জায়গা পায় কিভাবে?
দীপ নিহত হওয়ার পর ফেসবুকে কিছু তরুণ তার সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছে। মন্তব্যকারীদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে বিশদ জানা না থাকায় কিছু বলার সুযোগ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে যে তারা দীপকে মনে করে, তা বোঝা যায়। আর যে অভিযোগে দীপকে হত্যা করা হয়েছে বলে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে, সেটিও যদি আমরা আলোচনায় আনি, তাহলেও বেশ কিছু প্রশ্ন এসে যায়। ধরা যাক, হেফাজতের সহযোগী হিসেবে আখ্যায়িত ইমাম সাহেবের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে দীপ। কিংবা হেফাজতের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেছে সে। অথবা দীপ জীবদ্দশায় এমন কাজ করেছে, যাতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার পরও এভাবে তাকে হত্যা করা কি ইসলাম, রাষ্ট্র কিংবা সমাজ সমর্থন করে? হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়। তারা নিজেদের শান্তিপ্রিয় বলে মনে করে। জানি না দীপের মৃত্যুর পর তাদের ভাবনা কী? অন্তত কোনো বিবৃতি চোখে পড়েনি এ পর্যন্ত।
হলফ করে বলা যায়, কোনো পাষণ্ডও সমর্থন করতে পারে না এমন নৃশংসতা। শাম্মার আহত হওয়ার সংবাদ শুনে যেমন প্রাণ কেঁদে উঠেছিল, তার চেয়েও বেশি আঘাত পেয়েছে প্রতিটি দর্শক যখন দীপের বিদায় দৃশ্য দেখানো হচ্ছিল টেলিভিশনের সংবাদে। সহপাঠীদের চোখের পানি কঠোর মনের কাউকেও ঝাঁকুনি না দিয়ে পারেনি। কথা হচ্ছে, বুয়েটের মতো বিদ্যায়তনে এ ধরনের ঘটনা ঘটে কেন? বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থীদের হাতেও (সংখ্যায় যত কমই হোক না কেন) দা, কুড়াল, চাপাতি, বন্দুক, বুলেটের মতো অস্ত্র যায় কিভাবে? তাদের তো সংস্কৃতিমনস্ক হওয়ার কথা। অন্তত সব কিছুতেই উত্তম হওয়ার কথা।
বাইরে থেকে যেটুকু বুঝি, শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিবেশগত কিছু দিক অবশ্যই দায়ী হতে পারে। বুয়েটের শিক্ষাক্রম এমনভাবে সাজানো, যেখানে সৃজনশীল কাজের সুযোগ কম। বন্ধ দুনিয়ার মতো মনে হতে পারে। একজন শিক্ষক চান শিক্ষার্থীকে ভালো ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে গড়ে তুলবেন। শিক্ষার্থী চায় শিক্ষকের পথ অনুসরণ করে ভালো ছাত্র হতে, ভালো ইঞ্জিনিয়ার হতে। শিক্ষকের কাছে যেমন সার্বিক মানবিক গুণাবলি অর্জনের বিষয়টি উপেক্ষিত, তেমনি শিক্ষার্থীও বইয়ের বাইরের জগৎকে চেনা, সেখানে নিজেকে সম্পৃক্ত করার চিন্তা থেকেও দূরে থাকে। ফলে সেই প্রতিষ্ঠানটি একান্তই ভালো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে ভালো ভালো ইঞ্জিনিয়ার প্রতিবছরই বের হয়। তাদের সঙ্গে খোলা দুনিয়ার পরিচয় তুলনামূলক কম থাকে।
ওপরের মূল্যায়ন ভুল না হলে, এ সুযোগটি গ্রহণ করে অপশক্তিগুলো। যে কারণে বুয়েট কিংবা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মৌলবাদের প্রতি ঝুঁকছে। তারা প্রত্যেকেই মেধাবী। আসলে অবচেতন মনেই তারা অন্ধকারের দিকে চলে যায়। আর ভালো ইঞ্জিনিয়ার হতে গিয়ে কেউ কেউ বন্দুক চালকও হয়ে যাচ্ছে।
দুই দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুর্বলতাও পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো নয়। আমরা যদি সনি নিহত হওয়ার ঘটনার দিকে তাকাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই অবাক হতে হবে। কারা এসব ঘটিয়েছে, তা মোটামুটি সবাই জানে। কিন্তু এত দিন পরও কি খুনিদের শাস্তি হয়েছে? অথচ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় সুব্রত, শান্ত ও অনিন্দ্যকে শাস্তি হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ পেতে হয়েছে। অন্যদিকে খুনের অভিযোগে অভিযুক্তদের কিছুই হয়নি। তৎকালীন উপাচার্য বিষয়টি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন সাংস্কৃতিক পরিবেশ আছে বুয়েটে কি সেটা আছে? সাধারণ বিনোদনমূলক কাজ যেটুকু হয়, সেখানে শিক্ষকদের উপস্থিতি থাকে কম। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রিক। ফলে বুয়েট শিক্ষার্থীদের শুধু ভালো ছাত্র হতে দেখা যায়। এ জন্যই হয়তো সেখানে ছাত্ররাজনীতিতে বিরাট শূন্যতা থেকে গেছে। সে সুযোগটিই বারবার গ্রহণ করছে অপশক্তিগুলো।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে বুয়েটকে নতুন করে ভাবা দরকার। ভালো ইঞ্জিনিয়ার তৈরির পাশাপাশি মানবিক গুণাবলি অর্জনের সুযোগটিও যেন সেখানে সম্প্রসারিত হয়। তাহলেই বোধ করি, অন্তত মৌলবাদী শক্তি সেখানে প্রবেশের সুযোগ পাবে কম। আর তখনই এই একবিংশ শতাব্দীর দুনিয়াতে এসেও সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে কোনো শিক্ষার্থীর জীবনপ্রদীপ নিভে যাবে না।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.