যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রয়োজন হাই-ভোল্টেজ ডিপ্লোম্যাসি by শিহাবউদ্দীন কিসলু

পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে সিনেটর জন কেরির চূড়ান্ত নির্বাচনে ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। বরং বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিরই নিবিড় বাস্তবায়ন হবে। এই অভিমত যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিদের।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে সিনেটর জন কেরির মনোনয়নে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে কি ধরনের পরিবর্তন হতে পারে সে নিয়ে বাংলানিউজের করা প্রশ্নে একথা বলেন তারা।

এ নিয়ে সেদেশে প্রবাসী সাবেক কূটনীতিক, মূলধারার প্রভাবশালী বাংলাদেশি রাজনীতিক, লেখক বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।

ফরাসি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে সক্ষম জন কেরিকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তারা বলেন, কেরি শুধু  প্রেসিডেন্ট ওবামা’র ‘মেন্টর’ ই (দীক্ষাগুরু) নন, তার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম নেপথ্য কারিগরও। তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিই কেরির পররাষ্ট্রনীতি।আর সে কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে কেরির মনোনয়নে বিরোধী রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকেও কোন বিরোধিতা আসছে না।

বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে সিনেটর জন কেরির নামের চূড়ান্ত ঘোষণা এখন স্রেফ আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার। ফরেন রিলেশনস কমিটিতে একটি শুনানির মুখোমুখি হতে হবে জন কেরিকে। এই ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেই বর্তমানে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

২০০৪ সালে সিনেটর ওবামা যখন ডেলিগেট-না-হওয়ায় ডেমোক্রেটিক পার্টির কনভেনশনকক্ষে ঢুকতে পারেন নি, তখন ঝানু রাজনীতিক, কেনেডি পরিবারের সদস্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জন কেরিই তরুণ ও নবাগত সিনেটর ওবামাকে দলীয় কনভেনশনে কি-নোট স্পিকার হিসেবে বক্তৃতার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তারপরই প্রথম ওবামা বিস্ময়কর বক্তৃতা করার ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে আমেরিকার জনগণের কাছে পরিচিতি পান। দুজনের সম্পর্কও তাই খুবই ঘনিষ্ঠ। প্রেসিডেন্ট ওবামা’র ‘মেন্টর’ হিসেবে তাই ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতিতে নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা এই জন কেরী’র ।

কেরি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হচ্ছেন এ খবরের পর জাতিসংঘের সাবেক কুটনীতিক আব্দুর রাজ্জাক খান বাংলানিউজকে বলেন, “বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের একটাই প্রধান স্বার্থ এবং প্রধান মাথাব্যথা ‘বাংলাদেশ যেন  আরেকটি পাকিস্তান না হয়’। বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিকদের নিজেদের স্বার্থেই এ বিষয়টি বোঝা খুবই জরুরি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের ব্যপারে যুক্তরাষ্ট্র এখনও উদ্বিগ্ন এবং সন্দিহান। কারণ ধর্মীয় রাজনীতি ও জঙ্গিবাদের মোকাবেলায় আওয়ামীলীগ এখনও সক্ষম হয়নি। এমনকি নির্বাচনী রাজনীতিতে তারাও জামায়াতের সাথে হাতও মিলিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি সরাসরি জামায়াতের সাথে হাত মিলিয়ে চলছে।’ 
আবদুর রাজ্জাক খান বললেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মিয়ানমারের গুরুত্ব তুলনামুলকভাবে অনেক বেশি। একসময় চীনের উপনিবেশ মিয়ানমার (বার্মা) এখন চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে বেরিয়ে স্বাবলম্বী হতে চেষ্টা করছে । আর সেখানেই  বার্মায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক  সম্পর্ক ও অংশীদারিত্ব অনেক বেশী, সুযোগও অনেক বেশী । এসব বিবেচনায় বাংলাদেশকেও তার স্বার্থ বুঝে পদক্ষেপ নিতে হবে।’

যুক্তরাষ্ট্র্রের সাথে বাংলাদেশের ‘হাই ভোল্টেজ ডিপ্লোমেসি’ এর মাধ্যমে ’হাই ভোল্টেজ রিলেশনশিপ তৈরিতে সচেষ্ট হতে হবে,’ বলেন এই সাবেক কূটনীতিক। 

আব্দুর রাজ্জাক খান বাংলাদেশের রাজনীতিক ও সরকার নির্বিশেষে সকলের সমালোচনা করে বলেন   “যুক্তরাষ্ট্রকে মুল্যায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরকার ও প্রশাসন আসলেই গুডফর নাথিং।”

বাংলাদেশ নিয়ে  যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ এবং বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মমত্ববোধ সত্বেও বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার সুযোগকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ তারা, মত রাজ্জাকের।

বাংলাদেশের ‘মেরিটাইম’ সুবিধা’র কথা ইঙ্গিত করে এই কূটনীতিক আরো বললেন, “শুধু তাই নয়, সরকার ও রাজনীতিকদের মুখে লাগাম দেওয়ার সাথে এ বিষয়টিও নজরে রাখা উচিত যে, পারস্পারিক সম্পর্ক ও স্বার্থের ক্ষেত্রে শ্রদ্ধাবোধের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে আরেকটি সত্য জানতে হবে- ইন্টারেস্ট অব দ্য কান্ট্রি ইজ প্যারামাউন্ট ইন দেয়ার ফরেন পলিসি।”

যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারায় বাংলাদেশি রাজনীতিক যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী ইউনিয়ন ডিসি -৩৭ এর  প্রভাবশালী নেতা ও ডেমোক্রেট মাফ মেজবাহ উদ্দিন বাংলানিউজকে বললেন, ‘বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ওবামা প্রশাসনের মনোভাব সবসময়ই ইতিবাচক। সিনেটর জন কেরিও বাংলাদেশ সম্পর্কে যথেষ্ট সহানুভুতিশীল বলেই আমরা জানি। তবে এই সহানুভুতিকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বকে আরো মজবুত করতে বাংলাদেশকেই সচেষ্ট থাকতে হবে।’

মাফ মেজবাহ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন করে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন না হলেও কূটনীতির মাধ্যমে  বিশ্বব্যপী ‘হারমোনিয়াস’ পরিবেশ নিশ্চিত করাই হবে জন কেরির লক্ষ্য।’ জন কেরির কমিটিতে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জারসহ অনেক ঝানু পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাজনীতিকদের শুনানি  হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

মেজবাহ বলেন, ‘সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বিশ্বব্যপী ‘হারমোনিয়াস’ পরিবেশ সৃষ্টির কাজটিই করতে চেষ্টা করবেন কেরি। আর ওবামা প্রশাসনের দিক নির্দেশনাও যে সেটাই, তা এরই মধ্যে প্রতীয়মান। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য, গণতন্ত্রের জন্য তার অবদান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। 

মাফ মেজবাহ উদ্দিন এও বললেন, ‘প্যলেস্টাইনের বিষয়ে ‘টু স্টেট সলিউশন’ আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার নিশ্চিত করতে ওবামা প্রশাসন যেমন আন্তরিক, তেমনি রোহিঙ্গা ইস্যুতেও বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পুশ করার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে সহানুভুতিশীল য়ুক্তরাষ্ট্র। জন কেরি এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হতে পারেন।’

তিনি বলেন, ‘নাফিসের মত ঘটনাতেও বাংলাদেশিদের ‘জেনারালাইজড’ না করে (ঢালাওভাবে একপাল্লায় না মেপে) বরং এ ধরনের ঘটনাকে  বিচ্ছিন্ন ঘটনাই মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে ভবিষ্যতে এমন কিছু না করা, যাতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিব্রত হয়।

মূলতঃ ড. ইউনূস প্রসঙ্গ তুলে এনেই মাফ মেসবাহ বলেন, “এ ধরনের বিষয়গুলি এড়িয়ে চলাই হবে বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক এবং বুদ্ধিমানের কাজ।”

জন কেরির মূল্যায়ন করে তিনি বলেন, ‘এমন একজন রাজনীতিক যিনি নিজে যা বিশ্বাস করেন তাই করেন, যেটাকে তিনি ইস্যু মনে করবেন না, কারো কথাতেই সেদিকে পা দেবেন না।’

সার্বিক বিষয় বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে  সম্পর্ক কে গভীরতর করা--অভিমত মাফ মেজবাহর। 

বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবী হাসান ফেরদৌস বললেন, ‘যদি জঙ্গিবাদ, চরমপন্থিদের ব্যপারে বাংলাদেশ সরকার তাদের বর্তমান নীতি পরিবর্তন না করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক আরো সুসংহত ও সুদৃঢ়ই হবে। তবে এক কথায় জন কেরি  হিলারি ক্লিনটনের স্থলাভিষিক্ত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন হবে না। বরং বর্তমান পররাষ্টনীতিরই সুসংগঠিত ও নিবিড় বাস্তবায়ন হবে এবং মৌলিক নীতিগুলোর ধারা অব্যাহত থাকবে।’

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘জন কেরি ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতিতে সবসময়ই ভুমিকা রেখে চলেছেন। ওবামার সাথে তার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ওবামার বিতর্কের ’স্পেয়ারিং পার্টনার’ ছিলেন জন কেরি সেকথা সবার জানা । 

হাসান ফেরদৌস এ-ও বললেন, ‘তবে মনে রাখতে হবে, জন কেরি বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে স্থায়ী সমাধানের ব্যপারে আগে থেকেই আগ্রহ প্রকাশ করে আসছেন। পাকিস্তানও জন কেরির ব্যাপারে খুবই ইতিবাচক। তিনি অত্যন্ত ক্রুশিয়াল সময়ে দুটি দেশ সফরও করেছেন। পাশাপাশি ভারতের সাথে জন কেরির  রয়েছে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।’

নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী  হিসেবে জন কেরি বিশেষ করে এ অঞ্চলের কূটনীতিতে বিশেষ ভুমিকা রাখবেন উল্লেখ করে হাসান ফেরদৌস আরো বললেন “বাংলাদেশকে মনে রাখতে হবে, জন কেরি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার অর্থ ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্র্রের এই সম্পর্ক আরো গভীর ও সুদৃঢ় হবে। বাংলাদেশকে এসব কিছু বিবেচনা করেই এগুতে হবে। এই সুযোগে ঢাকা ওয়াশিংটন কৌশলগত সম্পর্ককে দীর্ঘস্থায়ী এবং সুদৃঢ় রূপ দিতে হবে।” 

হাসান ফেরদৌস বলেন, ‘ড. ইউনুস ইস্যুতে ব্যক্তিগত সৌহার্দ্য থেকে হিলারি ক্লিনটনের হয়তো এক ধরনের উদ্যোগ ছিল, যা জন কেরীর ক্ষেত্রে থাকবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থই সবসময় প্রধান্য পাবে, তা যিনিই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোন না কেন।’

ইউ এস বাংলাদেশ পার্টনারশিপের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক আজিজ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘জন কেরি বর্তমান ও ভবিষ্যতের দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে পারস্পারিক  স্বার্থসংশ্লিষ্ট লক্ষ্যগুলো অর্জনে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত দিক নির্দেশনা আরো গতিশীল করবে। সে ক্ষত্রে বাণিজ্য, অর্থনীতি ও নিরাপত্তার বিষয়টিই হবে মুখ্য।

জন কেরির এ নিয়োগকে শুধু বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই নয়, এ অঞ্চলের দেশগুলির জন্য ও খুবই  গুরুত্ব বহন করছে, মত আজিজ আহমেদের।’

তিনি বলেন, ‘ঝানু রাজনীতিক এবং কূটনীতিতে সেরাদের একজন জন কেরি। তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির সংকটে  ‘নাট শেল’ ভেঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করবেন বলে সহজেই ধরে নেয়া যায়। গণতন্ত্র ও উন্নয়নে বিশ্বাসী ‘হার্ড লাইনার’ জন কেরি  দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে ‘ক্যাটালিস্ট’ হিসেবেও বরফ গলাবেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র্রনীতির ইতিহাসে হাতে গোনাদের একজন হয়ে নতুন রেকর্ড করবেন এমনটাই আশা করছেন পর্যবেক্ষকরা।

জন কেরির হাতে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের উন্নয়নই দেখছেন আজিজ আহমেদ।

No comments

Powered by Blogger.