অরণ্যে রোদন-খাই খাই তন্ত্রের কালে মুস্তাক-হযরত আলী by আনিসুল হক

মেঘ দেখব, নাকি মেঘের কিনার ঘেঁষে যে রুপালি রেখা দেখা যাচ্ছে, সেটাকেই গুরুত্ব দেব। সেই যে সিরাজউদ্দৌলা নাটকে সংলাপ ছিল, বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, সেই মেঘ আজও গেল না। এত ব্যর্থতা, এত দুঃসংবাদ, এত হতাশা চারদিকে। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বলতে হয়, এখন প্রকৃত আশাবাদীর পক্ষে আর কিছুই সম্ভব নয়, কেবল হতাশ হওয়া ছাড়া।
হতাশার কারণ কিন্তু উচ্চপর্যায়ে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে। আচ্ছা বলুন তো, একটা মানুষের জীবনে কত টাকা লাগে? যিনি ব্যবসায়ী, তিনি তাঁর ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টা করবেন, শিল্পপতি নতুন নতুন শিল্পোদ্যোগ গ্রহণ করবেন, এ খুবই স্বাভাবিক, তা অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার করবে, দেশে উৎপাদন বাড়াবে, কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু একজন রাজনৈতিক নেতার কত টাকা লাগে? ৭০ কিংবা ৮০ বছর যাঁর বয়স, তাঁর কেন দরকার হয় নতুন ব্যাংক? যাঁর একটা আঙুলের নির্দেশে হাজার মানুষ জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত, তাঁকে কেন কমিশন খেতে হয়। কেন আমাদের একজন এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে চাকরি দেওয়ার নাম করে নিজ নির্বাচনী এলাকার যুবকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার? কেন এমপিরা স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করার বিনিময়ে টাকা নেন? আমাদের সাবেক বা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কি দাবি করতে পারবেন, তাঁর মন্ত্রিপরিষদে এমন কেউ নেই, যে দুর্নীতি করে, একজনও নেই যে ঘুষ খায় (দুঃখিত, কমিশন খায়)। জাতি হিসেবে আমাদের মাথা কতটা নিচু হয়ে আসে, যখন বিদেশে আমাদের প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত হয় এবং দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে সংবাদপত্রে শিরোনাম ছাপা হয়। আর কী হলে বলা হবে, আমাদের মানসম্মান গেছে!
কিন্তু দুর্নীতি নিয়ে কেউ কথা বলে না। বিরোধী দলও বলে না। কারণ সব রসুনের গোড়া যে একই। আজকে বিরোধী দল যে আন্দোলন করছে, তা ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার আন্দোলন—যত লুটপাট আর চোটপাট তো সরকারি দল একাই করে ফেলল। আমাদের ভাগ কই?
এ অবস্থায় আমরা একেকটা মেয়াদে ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় নিক্ষেপিত হচ্ছি।
এখন চুলায় আমরা ভালোই পুড়ছি, সামনে আরও বড় অগ্নিকুণ্ড আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, জ্বলেপুড়ে শেষ হওয়া ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই।
লুটপাটের এ কোন অভয়ারণ্যে এসে পড়লাম আমরা? এ কোন জতুগৃহে আমাদের বসবাস? আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
সত্যি, একটা মানুষের খাই কত বড় হতে পারে! তলস্তয়ের গল্পে পড়েছিলাম, একজনকে বলা হয়েছিল, এক দিনে যতটা জমি সে হাঁটতে পারবে, ততটাই তার হয়ে যাবে। সারা দিন লোকটা পাগলের মতো ছুটল, যতটা পারা যায় সে হাঁটবে, যত বেশি জমি পারা যায় সে দখল করবে, ছুটতে ছুটতে সূর্যাস্তের সময় লোকটা ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। ভৃত্য তার জন্য সমাধি খনন করল, শেষ পর্যন্ত লম্বায় ছয় ফুট মাত্র জায়গা তাঁর লেগেছিল।
আমাদের নেতাদের কত খেতে হবে? কত খাওয়া হলে তাঁরা বলবেন, বেশ তো খেলুম। কত টাকা তাঁদের চাই। অথচ এঁরা নেতা হয়েছেন নিজের সেবা করার জন্য নয়, দেশের সেবা করার জন্য, জনগণের সেবা করার জন্য। এই হলো দেশসেবার নমুনা!
নিশ্চয়ই সব নেতা দুর্নীতিবাজ নন। নিশ্চয়ই সব মন্ত্রী ঘুষ খান না। কিন্তু যখন এই আমলে কিংবা ওই আমলে মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বিদেশি দূত বা দাতারা সরাসরি তোলে, তখন লজ্জায়-অপমানে আমাদের মাথা নিচু হয়ে যায়।
এমনি ঘোরতর অন্ধকারে আশার জায়গা কোথায়? সংসার সমুদ্রে সুখ-দুঃখ তরঙ্গের খেলা, আশা যে তার একমাত্র ভেলা।
আশার জায়গা হলো, এ দেশের মানুষ। এ দেশের কৃষক দুর্নীতি করে না, কিন্তু তারা তাদের কঠোর পরিশ্রম আর তুলনাহীন সৃজনশীলতা দিয়ে ১৬ কোটি মানুষের মুখের অন্ন জোগায়। বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে মানুষের যে ঘনত্ব, সেই হারে যদি পৃথিবীর সব মানুষকে বসানো হতো, তাহলে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের দুই-তৃতীয়াংশ জমিতে ৭০০ কোটি মানুষ এটে যেত, তার পরেও যুক্তরাষ্ট্রের এক-তৃতীয়াংশ জমি পড়ে থাকত। আজকে আমেরিকার কৃষককে যদি বলা হয়, পৃথিবীর সব মানুষের মুখে আহার জোগাতে হবে, তার ওপরে যে চাপ পড়ত, তার দেড় গুণ চাপ বাংলাদেশের কৃষক সার্থকতার সঙ্গে বহন করে চলেছে। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা, আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকেরা, আমাদের শিল্পোদ্যোক্তারা দারুণ সব কাজ করছেন, আর দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, আর লাভের গুড় শীর্ষ খাদকেরা খেয়ে নিচ্ছে, লুটেপুটে খাচ্ছে আর বড় বড় কথা বলছে।
আরেকটা গল্প পড়েছিলাম ছোটবেলায়। একজন সাধু কাপড়চোপড় পরেন না। মানুষের সমাজে আসার পরেও তাঁকে কাপড় পরানো গেল না। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, চারদিকে এত মানুষ, আপনার লজ্জা করছে না? তিনি বলেছিলেন, মানুষ কই, আমি তো চারদিকে কেবল পশু দেখি।
আজকে তিনি হয়তো বলতে পারতেন, নেতা কই, আমি তো চারদিকে শুধু খাদক দেখি।
আহ্, কী খাই এদের।
লুৎফর রহমান রিটনের ছড়াটা মনে পড়ে, আবদুল হাই, করে খাই খাই, এক্ষুনি খেয়ে বলে কিছু খাই নাই।
বড় বড় সব গাড়ি চড়েন তারা, বেতন যা পান, তাতে ওই গাড়ির তেল কেনার টাকাও তো হওয়ার কথা নয়।
আচ্ছা, এই যে লুট করে পাওয়া কোটি কোটি টাকা, এসব তাঁরা রাখেন কোথায়?
তবু বলি, মেঘ দেখে তোরা করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে। না-মানুষের এ দেশে প্রকৃত মানুষের উপস্থিতির খবরও আমরা পাঠ করি।
এমনি একটা খবরের জন্ম দিয়েছেন মুস্তাক আহমদ আর তাঁর মামাতো বোন মাহমুদা আক্তার। গত ২৫ মার্চের প্রথম আলোয় ভেতরের পাতায় ছাপা হয়েছে খবরটা। শিরোনাম, এই আমাদের ঢাকা।
খবরে হতাশার কথা আছে, আশার আলোও আছে। হতাশার ব্যাপারটা হলো, মিরপুর প্রগতি সড়কে একজন মানুষ পড়ে আছে রাস্তায়। খানিকটা রক্তাক্ত এবং অচেতন। হয়তো কোনো গাড়ি ধাক্কা দিয়ে চলে গেছে, কিন্তু কেউই তার উদ্ধারে এগিয়ে আসছে না। কেউ না। আশার কথা হলো, মিরপুর ইউনিভার্সিটি কলেজের ছাত্র মুস্তাক আহমদ চাকরির ইন্টারভিউ থেকে ফিরছিলেন মামাতো বোন মাহমুদা আক্তারকে নিয়ে। তাঁদের চোখে পড়ে ওই মানুষটাকে। তাঁরা তাঁর উদ্ধারে এগিয়ে আসেন। কোনো যানবাহন ওই অচেতন মানুষটাকে বহন করতেও রাজি হচ্ছিল না। জোর করে ট্যাক্সিক্যাবে তুলে তাঁরা তাঁকে হাসপাতালে নেন। পকেটের কাগজ দেখে তাঁর পরিবারের কাছে খবর পাঠান। আর যিনি এভাবে রাস্তায় পড়েছিলেন, তিনি একজন ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব।
আমরা ঢাকাবাসীর নিষ্করুণ নির্লিপ্ততা ও নির্মমতা নিয়ে আহাজারি করতে পারি। কিন্তু তারও চেয়ে বড় কথা, মুস্তাক আর মাহমুদার জন্য আমাদের গৌরব করতে হবে। আমাদের বলতেই হবে যে, পুরো সমাজটা শেষ হয়ে যায়নি, আমাদের মধ্যে মুস্তাক আর মাহমুদারাও আছেন। তেমনিভাবে আমাদের স্যালুট জানাতে হবে হযরত আলীকে। ৬ এপ্রিল মিরপুর চিড়িয়াখানা সড়কের কাছে সকালবেলা হযরত আলী দেখেন, ছিনতাইকারী মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিচ্ছে প্রাতর্ভ্রমণে বেরোনো দুই নারীর কাছ থেকে। ছিনতাইকারীরা গাড়ি নিয়ে এসেছে। হযরত আলী নিজের জীবন নিয়ে সটকে গেলেই পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। ইট হাতে তেড়ে যান ঘটনার দিকে। আর ছিনতাইকারীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হয়ে হযরত আলী মারা যান।
আমি মাঝেমধ্যে চিন্তা করি, আপাদমস্তক দুর্নীতিতে, নিষ্ঠুরতায়, বিবেকহীনতায় নিমজ্জিত এ দেশে সূর্য কেন ওঠে? বৃষ্টি কেন হয়?
এই দেশে সূর্য আলো দেয় মুস্তাক-মাহমুদারা আছেন বলে। হযরত আলীরা এখনো নিস্পৃহতা, নির্লিপ্ততা অর্জন করতে পারেনি বলে।
আসলে এ দেশে বেশির ভাগ মানুষই ভালো। আমাদের সমস্যা ওপরতলায়। যারা দেশটার সাইনবোর্ড, তাদের মধ্যেই আসল সমস্যা। আমাদের সরিষার মধ্যেই ভূত।
কিন্তু গুটিকয়েক মানুষ আমাদের দেশের সমস্ত সম্ভাবনাকে টুঁটি চিপে মেরে ফেলবে, আমাদের ভবিষ্যতের ডানাটাকে ছিঁড়ে ফেলবে টেনেহিঁচড়ে, এ রকমটা কত দিন চলবে। হিতোপদেশে দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত মানুষগুলো নিবৃত্ত হবে, খাই খাই করা মানুষগুলো খাওয়া বন্ধ করবে, তা মনে হয় না। খেতে খেতে গলা পর্যন্ত খাওয়া হয়ে গেলে কি তারা থামবে? নাকি আরও খাবে?
হয়তো, ছয় ফুট জায়গার মধ্যে আশ্রয় নেওয়ার পরেই কেবল এদের ক্ষুধা মিটবে।
কিন্তু এত চমৎকার একটা দেশের অসাধারণ মানুষগুলোর এই যে ভালোত্ব, এই যে পরিশ্রম, এই যে সৃজনশীলতা—এরা কি তাকেও খেয়ে ফেলছে না?
ওরে আশা নাই, ওরে আশা শুধু মিছে ছলনা—এই কি আমাদের ললাটলিপি?
মুস্তাক-মাহমুদা, হযরত আলী, আমি আপনাদের কাছে এসে দুহাত পেতেছি। আপনারাই আমাদের একমাত্র ভরসাস্থল। আপনারাই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন, হয়তো আপনারাই আমাদের উদ্ধার করবেন এই বিপুল বিনাশ থেকে!
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.