শিক্ষা খাত-শিক্ষা প্রশাসনে স্বজনপ্রীতি by আকমল হোসেন

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডে পরিচালনা কমিটিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতিনিধি থাকলেও সেখানে যোগ্যতা ও গণতান্ত্রিকত্ব কোনো সুযোগ নেই। ক্ষমতাসীন দলের অনুসারীদের সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়


সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের জনগণের জন্য শিক্ষা মৌলিক এবং সাংবিধানিক অধিকার। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সংবিধানের আলোকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ৪০ বছরে ১৫ বার সংবিধান পরিবর্তিত হলেও সংবিধানের শিক্ষা সংক্রান্ত ওই ধারাগুলোকে সব শাসকই বহাল রেখেছে। শিক্ষার আদর্শিক জায়গায় এবং রাষ্ট্রের অর্থায়নের জায়গায় সংবিধান অনুযায়ী শাসক মহল কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। একই ধারার গণমুখী সর্বজনীন শিক্ষার স্থলে তিন ধারার শিক্ষা, শিক্ষার ঢালাও বেসরকারিকরণ বাজারের আর দশটি পণ্যের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
শিক্ষা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি যেমন গুরুত্বপূর্ণ সে সঙ্গে দক্ষ ও স্বচ্ছ শিক্ষা প্রশাসনেরও প্রয়োজন। যারা ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক প্রধান, ডিজি (মাউশি) নিরীক্ষা অধিদফতর, শিক্ষা বোর্ড, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের কর্মকর্তাবৃন্দ, যারা শিক্ষার নীতিমালা, কারিকুলাম প্রণয়ন করেন এবং তা বাস্তবায়নের কাজ করেন। সেই শিক্ষা প্রশাসনকে হওয়া দরকার দক্ষ, যোগ্য এবং অভিজ্ঞতা। এই দায়িত্বে যারা আসবেন তাদের ওপর নির্ভর করে দেশের শিক্ষার উন্নয়ন।
সম্প্রতি কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে শিক্ষা প্রশাসনে ক্ষমতাসীনদের প্রভাব, আত্মীয়তার সূত্র এবং বৈষয়িক স্বার্থের বিনিময়ে কর্মকর্তাদের পদায়নের বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড শিক্ষা প্রশাসনে অনেক দিন থেকেই অব্যাহত আছে। শিক্ষার হালহকিকত এবং শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তার দুর্নীতির কারণে স্ট্যান্ড রিলিজের খবর দ্বারাই বোঝা যায় শিক্ষা প্রশাসনের নিয়োগে স্বজনপ্রীতির বিষয়টি। জাতি গড়ার এ সেক্টরটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দক্ষ ও যোগ্য প্রশাসক আনার জন্য স্বজনপ্রীতি নয়, সর্বজনীন প্রীতির দরকার ছিল; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সে কাজটি হয়নি। অতএব শিক্ষা ও শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্ব জাতি গঠনে অনেক বেশি শিক্ষাকে সমাজের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে এবং দেশ ও জাতির উন্নয়নে দক্ষ, যোগ্য ও আদর্শিক মানবশক্তি গড়তে শিক্ষা প্রশাসনে প্রয়োজন দক্ষ প্রশাসক। সেটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্য থেকে প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যন্ত প্রয়োজন। দেশের ৮০ ভাগ শিক্ষা পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের দ্বারা। বাকি ২০ ভাগ সরকারি ও প্রাইভেট শিক্ষা। এ জন্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় গভর্নিং বডিতে দলীয় বিবেচনার বাইরে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও বৈষয়িক লেনদেন পরিহার করতে হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখাশোনার কাজ করে থাকে শিক্ষা বোর্ড, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, অডিট ও নিরীক্ষা অধিদফতর, অধিদফতর মাউশি, নায়েম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা বোর্ড।
এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের সরকারি কলেজ থেকে ডেপুটেশনে আনা হয়। তাদের দ্বারাই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা নানাভাবে নিগৃহীত হন, বিশেষ করে মাউশির অধিদফতর ও নিরীক্ষা অধিদফতরে। এমপিও করার সময় এ বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করে। বিসিএস ক্যাডার এমন অহমিকা থেকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে আচরণ করে থাকে। এ থেকে রক্ষার জন্য বেসরকারি শিক্ষক সংগঠনগুলো দাবি করেছে, শিক্ষা প্রশাসনে তাদের প্রতিনিধিত্বও নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে ১৪ হাজার পদের মধ্যে ৪ হাজার পদ শূন্য, তারপরও তাদের ডেপুটেশনে নিয়ে যাওয়ায় সরকারি কলেজের পাঠদানে বিঘ্ন ঘটার খবর পত্রিকাতেই প্রকাশিত হচ্ছে।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডে পরিচালনা কমিটিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতিনিধি থাকলেও সেখানে যোগ্যতা ও গণতান্ত্রিকত্ব কোনো সুযোগ নেই। ক্ষমতাসীন দলের অনুসারীদের সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আরও স্বচ্ছ ও গতিশীল করার জন্য বার কাউন্সিলের মতো সব এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীকে ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধি মনোনয়নের ব্যবস্থা করা জরুরি। এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও বেসরকারি কলেজ থেকে ডেপুটেশনে আনা। এরও পরিবর্তন করা দরকার। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডিতে দলীয় লোক মনোনয়ন দেওয়ায় নিয়োগ বাণিজ্য চলছে। ফলে যোগ্য প্রশাসক নিয়োগ হচ্ছে না। সে সঙ্গে ভালো শিক্ষকও নিয়োগ পান না। গভর্নিং বডিতে দলীয়করণ থাকায় শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে নানা দ্বন্দ্বের কারণে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ সমস্যা দূরীকরণে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আদলে পৃথক নিয়োগ কমিশন করা জরুরি। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের নির্বাচন ইশতেহারে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকলেও এখন বাস্তায়নের প্রক্রিয়াই আসেনি। এ ক্ষেত্রে সরকারি কলেজের শিক্ষকদের আপত্তির বিষয়টি পত্রিকায় এসেছে। তাদের বক্তব্য, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নন, তাদের সঙ্গে সরকারি কলেজের নিয়োগ হতে পারে না। শিক্ষার মান উন্নয়নে, দলীয়করণ রোধে শিক্ষক নিয়োগের পৃথক কমিশন হওয়া জরুরি, প্রয়োজনে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আলাদা নিয়োগ সেল হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের নিম্নগামী হওয়ার কথা শিক্ষাবিদরা বলছেন। কারণ সেখানেও মেধার তুলনায় দলীয়করণের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। এখানেও স্বচ্ছতা আনা জরুরি।
ক্ষমতাসীনদের মধ্যেও আবার আন্তঃগ্রুপ যে যখন সুযোগ পায় তার অনুসারীদের কদর বেড়ে যায়। দলীয় আনুগত্য অথবা বৈষয়িক বিষয়টি পূরণ ছাড়া সাধারণ মেধাবীরা শিক্ষা প্রশাসনে আসতে পারছে না। শিক্ষার মান উন্নয়নে এ ধারার পরিবর্তন জরুরি। শিক্ষা প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর শিক্ষা মন্ত্রণালয় চলে প্রশাসন ক্যাডারের লোকদের দ্বারা, এর পরিবর্তে শিক্ষা ক্যাডারের লোক অথবা শিক্ষার সঙ্গে জড়িতদের অন্তর্ভুক্ত করলে শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নে আরও গতিশীলতা আসতে পারে। শিক্ষা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক পেশা, চিন্তা, গবেষণা আর প্রতিনিয়ত অনুশীলনের বিষয়। ফলে এ পেশার লোকদের জন্য বাড়তি আর্থিক সুবিধা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষা পেশায় বাড়তি আর্থিক সুবিধা দিয়ে পৃথক বেতন কাঠামো আছে। আমাদের দেশের শিক্ষক সংগঠনগুলো অনুরূপ দাবি করে আসছে অনেক দিন থেকে। বর্তমান শাসক তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কমিশনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এখনও বলছেন। তবে তার প্রক্রিয়া এখনও শুরু করেননি। নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণা করেছেন। ২০১৮ সালের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করবেন; কিন্তু তার জন্য বাজেট বরাদ্দ নেই। বরং ২০১১-১২ অর্থবছরের যে বাজেট দিয়েছেন তার দ্বারা ৭ বছর ধরে বন্ধ থাকা টাইম স্কেলই চালু করার জন্য অর্থ বরাদ্দ নেই। সব মিলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, পৃথক নিয়োগ কমিশন, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল গঠনের প্রক্রিয়া যেন হুমকির মুখে। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির জন্য শিক্ষা প্রশাসনে সংস্কার এবং অর্থায়ন বৃদ্ধি জরুরি। শিক্ষা প্রশাসনে দলীয় প্রীতি, আত্মীয়তার কানেকশন, বৈষয়িক কানেকশনকে দূর করতে হবে, স্বজনপ্রীতির পরিবর্তে সর্বজনপ্রীতি আর দক্ষতা ও যোগ্যতার মাপকাঠিতে কর্মকর্তা পদায়নের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

আকমল হোসেন :কলেজ শিক্ষক সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় (বাকবিশিস) কেন্দ্রীয় কমিটি
 

No comments

Powered by Blogger.