বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আজ-প্রবীণের সংখ্যা বাড়ছে চিকিৎসাসেবায় সংকট by শিশির মোড়ল

দেশে প্রজনন হার কমছে আর মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। বাড়ছে প্রবীণদের সংখ্যাও। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম বলছে, বাংলাদেশে ৬০ বছর বা এর বেশি বয়সী মানুষ এখন এক কোটির বেশি, যা মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ।তবে প্রবীণদের সংখ্যা বাড়লেও তাঁদের চিকিৎসাসেবার পৃথক ব্যবস্থা দেশের সরকারি বা বেসরকারি কোনো


হাসপাতালে নেই। বার্ধক্যজনিত রোগের চিকিৎসা অবহেলিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে মানবিক সংকট তৈরি হতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক সাংবাদিকদের বলেন, প্রবীণেরা জনসংখ্যার ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষক এ কে এম নূরুন নবী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রবীণদের সংখ্যা এক কোটির সামান্য কম বা বেশি। বড় কথা হলো, সংখ্যাটা অতি দ্রুত বাড়ছে। এতে সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর চাপ পড়ছে। এই চাপ মোকাবিলায় আমরা তৈরি না, আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘গুড হেলথ অ্যাডস লাইফ টু ইয়ারস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে, প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি সারা বিশ্বের প্রবণতা। তবে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে তা দ্রুততম সময়ে ঘটছে। এই জনগোষ্ঠীর চাপ পড়ছে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর। আজ বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। এবার দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ‘প্রবীণদের যত্ন নিন: স্বাস্থ্য রক্ষায় এগিয়ে আসুন’। দিবসটি উপলক্ষে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রবীণ বাড়ছে: বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এ বছরের গোড়ার দিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর প্রভাব বিষয়ে ‘গ্লোবাল পপুলেশন এজিং: পেরিল অর প্রোমিজ?’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, গত শতকের সত্তর ও নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার যথাক্রমে ৫ ও ৬ শতাংশ ছিল প্রবীণ। ২০৩০ ও ২০৫০ সালে হবে যথাক্রমে ১২ ও ২২ শতাংশ।
অধ্যাপক নূরুন নবী বলেন, এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০৪৪ সালে প্রবীণদের সংখ্যা ১৫ বছর বা এর কম বয়সী জনগোষ্ঠীকে ছাড়িয়ে যাবে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, গত দুই দশকে (১৯৯০-২০১০) জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে প্রবীণ জনগোষ্ঠী বৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমান ও আগামী (২০১০-২০৩০) দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ১ শতাংশে। কিন্তু প্রবীণ জনসংখ্যা বাড়বে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ হারে। পরবর্তী দুই দশকে (২০৩০-২০৫০) প্রবীণ বাড়বে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ হারে, আর জনসংখ্যা বাড়বে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ হারে।
জনসংখ্যাবিদদের মতে, প্রজননক্ষম নারীরা কম সন্তান জন্ম দেওয়ায় মোট প্রজনন হার কমছে। এতে কম বয়সী মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম থাকছে। অন্যদিকে গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে।
অধ্যাপক নূরুন নবী বলেন, স্বাধীনতার পরপরই মোট প্রজনন হার ছিল ৬ দশমিক ৩ এবং মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৫ বছর। বর্তমানে প্রজনন হার ২ দশমিক ২ এবং গড় আয়ু ৬৭ বছর।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বয়স বাড়লে মানুষের অন্যের ওপর নির্ভরতা বাড়ে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম বলছে, প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ার অর্থ হলো, নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক দেশে প্রবীণদের জন্য পৃথক বরাদ্দ থাকে না।
স্বাস্থ্য খাতে প্রভাব: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মো. জিলন মিঞা সরকার প্রথম আলোকে বলেন, প্রবীণদের স্বাস্থ্য ভঙ্গুর। একটুতেই তাঁরা কাতর হয়ে পড়েন। এঁদের প্রস্রাব-পায়খানায় নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অনেকের স্মৃতি বিলোপ ঘটে। এঁরা সাধারণভাবে অপুষ্টিতে ভোগেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রবীণেরা নানা ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার হন। নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর প্রবীণদের ৯৪ শতাংশ দৃষ্টি ও ৪৩ শতাংশ শ্রবণ সমস্যায় ভোগেন। এঁদের একটি বড় অংশ পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম বলছে, বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক ব্যাধির (হূদেরাগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা) প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পেছনে আছে প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধি। এসব রোগে চিকিৎসার খরচ অনেক বেশি।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জনসংখ্যা বিভাগের প্রধান কিম স্ট্রিডফিল্ড প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে একজন ডায়াবেটিক রোগীর চিকিৎসা খরচ চার মার্কিন ডলারের মতো। সব রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বার্ষিক স্বাস্থ্য বাজেটের চেয়েও বেশি। এই ব্যয় আরও বাড়বে।
প্রস্তুতি নেই: চিকিৎসকেরা বলছেন, অনেক উন্নত দেশে শিশুদের পাশাপাশি বৃদ্ধদের জন্যও আলাদা চিকিৎসাব্যবস্থা আছে। বৃদ্ধদের সঙ্গে কুশল বিনিময়, পৃথকভাবে যত্ন নেওয়া বিশেষায়িত চিকিৎসার অংশ। কিন্তু এ দেশে আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হক বুধবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দেশের শহর ও গ্রাম সর্বস্তরেই প্রবীণদের স্বাস্থ্য নিয়ে সমস্যাও বাড়ছে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের দীর্ঘস্থায়ী রোগ ও শারীরিক অক্ষমতাও বাড়ছে। ফলে পরিবার, সমাজ বা দেশে এর প্রভাব পড়ছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বার্ধক্যজনিত রোগ চিকিৎসার জন্য আলাদা ব্যবস্থা কোনো হাসপাতালেই নেই।
এদিকে সরকারের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত উন্নয়ন কর্মসূচিতেও (২০১১-২০১৬ পর্যন্ত) প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি স্থান পায়নি।
সম্প্রতি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রবীণদের স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন অধ্যাপক জিলন মিঞা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, প্রবীণদের চিকিৎসা বা জেরিয়াট্রিক মেডিসিন এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশেষায়িত শাখা। কিন্তু বিএসএমএমইউ বা কোনো মেডিকেল কলেজে এ বিষয়ে কোনো পাঠ্যক্রম নেই। এটা শুরু করা দরকার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে, নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে বার্ধক্যজনিত রোগ চিকিৎসায় প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব রয়েছে।
করণীয়: বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম বলছে, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া প্রবীণ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার থাকা দরকার।
সংস্থাটি কিছু উদ্যোগ গ্রহণেরও সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে আছে অবসরের বয়সসীমা, প্রবীণদের প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ ও প্রবীণদের উপযুক্ত কাজের ক্ষেত্র বাড়ানো। এ জন্য স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। পৃথিবীর নানা প্রান্তের ভালো উদাহরণগুলো অনুসরণ করতে হবে। সামাজিক স্বাস্থ্য বিমা ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার সমস্যা সমাধানে পথ দেখাতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে পরীক্ষামূলকভাবে সপ্তাহে এক বা দুই দিন প্রবীণদের চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ধীরে ধীরে শয্যার ব্যবস্থা বা ইউনিট খুলতে হবে। পরে পৃথক ওয়ার্ড খোলা যায়। তা ছাড়া চিকিৎসা নিতে আসা সারিতে দাঁড়ানো প্রবীণ মানুষটিকে আগে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া যায়। অন্তত এ কাজটি করতে কোনো খরচ নেই।

No comments

Powered by Blogger.