কর্মীদের করা মামলা নিয়ে সংকটে বিমান by টিপু সুলতান

ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস নিজ কর্মীদের সঙ্গে মামলা নিয়ে আরেক সংকটে পড়েছে। কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রায় এক হাজার ৪০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী বিমানের বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিমান সূত্র জানায়, মামলায় লড়ার ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত বিমানের পক্ষে সাফল্যের তেমন কোনো নজির নেই।


তার পরও চরম আর্থিক সংকটে থাকা জাতীয় প্রতিষ্ঠানটিকে মামলা পরিচালনা খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত তিন বছরে মামলার পেছনে বিমানের খরচ হয়েছে তিন কোটি টাকা। গত মাসে আবার বাজেটের অতিরিক্ত এক কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে মামলা নিয়ে এই সংকটের কথা স্বীকার করেন বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এয়ার কমোডর (অব.) জাকীউল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিমানের সঙ্গে কর্মীদের মামলায় জড়ানো পুরোনো অভ্যাস।’
বিমানের আইন শাখা থেকে জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশে তিন শর বেশি মামলা লড়ছে বিমান। এর মধ্যে ২০০৭ সালে স্বেচ্ছা-অবসর কর্মসূচির (ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট স্কিম—ভিআরএস) নামে ছাঁটাই হওয়া এক হাজার ১০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর করা ৬১টি রিট হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন। তিনটি বেঞ্চ ঘুরে সর্বশেষ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আবদুর রউফের বেঞ্চে এসব রিটের শুনানি শেষ হয় গত ২৩ জানুয়ারি। আদালত ২৬ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণার তারিখ দিয়েছেন।
ভিআরএসে ক্ষতিগ্রস্ত কেবিন ক্রুদের দুটি রিট আবেদন হাইকোর্টের আরেক বেঞ্চে বিচারাধীন। এর বাইরেও চাকরিচ্যুত ব্যক্তিদের আরও কয়েকটি রিট আবেদন আছে।
এর আগে চাকরিচ্যুত ও বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া ২৫৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী হাইকোর্টে মামলায় জিতে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু বিমান হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। এরই মধ্যে ৫৩ জন আপিল বিভাগে পক্ষে রায় পেয়ে পদোন্নতি ও বকেয়া বেতন পেয়েছেন। বাকি ২০৪ জনের ব্যাপারে আপিল বিভাগে মামলা চালাতে মোটা ফি দিয়ে আইনজীবী নিযুক্ত করেছে বিমান।
বিমানের একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় কর্তৃপক্ষ নিজেই নিয়মকানুন লঙ্ঘন করে কর্মীদের মামলার দিকে ঠেলে দেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব কর্মকর্তা বলেন, সরকারি চাকরির বয়স দুই বছর বাড়লেও বিমান তা এখনো বাস্তবায়ন করেনি। এই অবস্থায় আগের নিয়মে যাঁদের এখন অবসর প্রস্তুতিতে যাওয়ার কথা, সেসব কর্মী অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবিতে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিমানের এমডি প্রথম আলোকে বলেছেন, অবসরের বয়সসীমার বিষয়ে বিমান এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। পরিচালনা পর্ষদে আলোচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, মামলার মতো অনুৎপাদনশীল খাতে দিন দিন খরচ বাড়তে থাকলেও এ থেকে বেরিয়ে আসতে কর্তৃপক্ষের কোনো চিন্তা নেই। বরং তারা আরও মামলার ক্ষেত্র সৃষ্টি করছে। ২০০৭ সালে ব্যয় হ্রাস ও অতিরিক্ত জনবল কমানোর যুক্তিতে এক হাজার ৮৭৭ জনকে ছাঁটাই করার কথা উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের মধ্য থেকেই আবার এক হাজার ১০০ জনকে নৈমিত্তিকভাবে চাকরি দেওয়া হয়। এখনো ৪৯৭ জন নৈমিত্তিক ভিত্তিতে চাকরি করছেন। তার পরও কর্মীর সংকট দেখিয়ে অতিরিক্ত সময় কাজ (ওটি) করানো হচ্ছে। ওটির জন্য মাসে প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয় হয়। বিমানের এসব স্ববিরোধী যুক্তি ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দফায় এক হাজার ৪০০ জন কর্মী হাইকোর্টে রিট করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ডিসেম্বর মাসেই মামলা চালানোর জন্য ৬০ লাখ টাকা বিল দিয়েছে বিমান। এরপর গত ১৯ জানুয়ারি বিমানের হিসাব শাখার ব্যবস্থাপক (বাজেট) বরাবর আইন শাখা থেকে আরও এক কোটি ২০ লাখ টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ চাওয়া হয়।
বিমানের বিপক্ষে হাইকোর্টে মামলাগুলোর বাদীপক্ষের সূত্র জানিয়েছে, তারা দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীদের নিয়োগ দিয়েছে। তার পরও তাদের খরচ বিমানের তুলনায় অনেক কম হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, মামলায় ব্যয়িত অর্থের একটা অংশ বিমানের কতিপয় ব্যক্তি বা কর্মকর্তার পকেটে যায়। আর এ কারণে তাঁরা বিমানের কর্মীদের যৌক্তিক দাবিদাওয়াও আদালত পর্যন্ত নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখছেন। মামলায় হেরে গেলে আপিল বিভাগ পর্যন্ত যান। তাতেও বিমানের পক্ষে রায় গেছে, এমন নজির খুবই কম।
বিমানের এমডি জাকীউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারার অভিযোগ থাকলে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। তিনি স্বীকার করেন, ‘বিমানের মামলার লিগ্যাল কস্ট অনেক বেশি।’
আইন শাখার মহাব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, মামলা পরিচালনা খাতের টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়, এমন কোনো অভিযোগ তিনি শোনেননি। তিনি বলেন, বিমানের একটি আইনজীবী প্যানেল রয়েছে। এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেলও বিমানের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে শুনানিতে অংশ নিয়েছেন।
গত তিন বছরে বিমান যেহেতু একটি মামলায়ও জেতেনি, সেহেতু এ খাতে বিপুল অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতা কী—এ প্রশ্নের জবাবে আইন শাখার মহাব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, মামলাগুলোর অধিকাংশই বাধ্যতামূলক অবসর ও চাকরিচ্যুতি-সংক্রান্ত। এসব ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ আইন শাখার মতামত নেয়নি।
আইনজীবী নিয়োগেও অনিয়ম: অভিযোগ রয়েছে, বোয়িং কোম্পানি থেকে কেনা দুটি নতুন উড়োজাহাজ গ্রহণ করার আগে আইনি পরামর্শ নিতে আইনজীবী নিয়োগেও অনিয়ম হয়েছে। বিমানের নীতিমালা অনুযায়ী, দরপত্র আহ্বান করে আইনজীবী নিয়োগ দিতে হয়। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর ১৫ বছর হাইকোর্টে কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়।
বোয়িংয়ের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি বলে স্বীকার করেছেন বিমানের আইন শাখার মহাব্যবস্থাপক। তিনি বলেন, এবার যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়, তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেও বিমানের সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ করেছিলেন। তাই তাঁকে আবার নিয়োগ দেওয়া হয়।
শফিকুল ইসলাম জানান, গত বছর বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ আনার আগে দেশে-বিদেশে দুই জায়গায় আইনজীবী প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়ে পরামর্শ নিয়েছে বিমান। এ বাবদ ব্যয় হয়েছে নয় লাখ মার্কিন ডলার বা ছয় কোটি ৩০ লাখ টাকা।

No comments

Powered by Blogger.