শান্তির অগ্রদূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান



পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পৃথিবীর বুকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.){৫৭০-৬৩২ খ্রি.}-এর শুভাগমন উপলক্ষে মুসলিম উম্মাহর তথা সৃষ্টিকুলের জন্য সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ উৎসব। বিশ্বশান্তির অগ্রদূত এমন এক সময় দুনিয়ায় আগমন করেন, যখন আরবের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা অধঃপতনের চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। প্রাক্-ইসলামি তথা আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে চরম উচ্ছৃঙ্খলতা, পাপাচার ও ব্যভিচারে ভরপুর ছিল তখনকার আরবীয় সমাজ। ব্যক্তিপূজা, অগ্নিপূজাসহ বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসী আরবসমাজে অন্যায়-অপরাধ, কলহ-বিবাদ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, নৈরাশ্য আর হাহাকার ছাড়া কিছুই ছিল না। সেই চরম দুঃসময়ে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে রাসুলুল্লাহ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁকে শান্তি, মুক্তি ও সামগ্রিক কল্যাণের জন্য বিশ্ববাসীর রহমত হিসেবে আখ্যায়িত করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত-১০৭)
ইসলামের আবির্ভাব মুহূর্তে এবং তার আগের বিশ্বের মানবসমাজে বিরাজমান ছিল চরম বৈষম্য। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি অহরহ চলত। তখনকার সামাজিক অনাচার ও অশান্তির অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এই অশান্ত সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশ্বমানবতার মহান মুক্তিদূত হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ ও পদ্ধতি ছিল অনন্য। আরব দেশে যুদ্ধবিগ্রহ, কলহ-বিবাদ, রক্তপাত, অরাজকতা ইত্যাদি দূরীভূত করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির ভিত্তিতে তিনি একটি অনুপম আদর্শ কল্যাণমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)-এর ভূমিকা অতুলনীয়।
প্রাক্-ইসলামি যুগে আরবসমাজে অশান্তির দাবানল সর্বক্ষণ দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকত। কিশোর বয়সে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কোমল হূদয় এই বীভৎস দৃশ্যাবলি দেখে কেঁদে ওঠে। তিনি ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক শান্তিসংঘ গঠন করে এসব অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আর্তমানবতার সেবা করা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা, অত্যাচারিতকে সহযোগিতা করা, শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্রে গোত্রে সম্প্র্রীতি বজায় রাখা—এসব ছিল এ শান্তিসংঘের অঙ্গীকারবাণী। মক্কার ধনাঢ্য ও বিদুষী মহিলা হজরত বিবি খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) বিপুল ধনসম্পদের মালিক হন। এ সম্পদ তিনি ভোগবিলাস কিংবা নিজের স্বার্থে ব্যবহার না করে আর্তমানবতার সেবায় অকাতরে বিলিয়ে দেন।
পবিত্র কাবাগৃহে ‘হাজরে আসওয়াদ’ বা কালো পাথর স্থাপনের দুর্লভ গৌরব লাভের বিষয় নিয়ে একবার গোত্রে গোত্রে ভয়াবহ যুদ্ধ বাধার উপক্রম হয়। জায়গামতো বসানোর প্রয়োজনে কে তুলে আনবে বা কোন গোত্রের নেতা এই পবিত্র কালো পাথর উঠিয়ে আনবেন, এ নিয়ে প্রচণ্ড বাগিবতণ্ডা শুরু হয়। তুমুল বিতর্ক যখন মারামারি বাধার পর্যায়ে, তখন উপস্থিত একজন প্রস্তাব করলেন, আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদকে দেওয়া হোক মীমাংসার দায়িত্ব। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বয়স তখন অল্প, কিন্তু সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততার জন্য তিনি ‘আল-আমিন’ উপাধি পেয়ে গেছেন এবং ন্যায়নীতি ও ধৈর্যগুণে এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। অত্যন্ত ধৈর্য আর মনোযোগের সঙ্গে তিনি সমস্যাটি শুনলেন। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন, একটা চাদর আনা হোক। চাদরের মধ্যখানে পাথরটি রেখে মক্কার বিখ্যাত চার গোত্রের চার নেতা চাদরের চার কোনায় ধরে পাথরটাকে ওঠাবেন। সমন্বিতভাবে এ জটিল সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হলো। আর শান্তিপ্রিয় মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.) রেখে গেলেন প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
তৎকালীন আরবদের মধ্যে কোনো রকম ঐক্যবোধ বা জাতীয় চেতনা ছিল না। গোত্রপ্রীতির কারণে কলহ-বিবাদ লেগেই থাকত। নবী করিম (সা.) এ কৃত্রিম ভেদাভেদ ও দ্বন্দ্ব-কলহের চিরতরে অবসান ঘটান। আরবে দাসত্বপ্রথা মানুষে মানুষে চরম শ্রেণীবৈষম্যের সৃষ্টি করেছিল। মহানবী (সা.) প্রথম বিশ্বনেতা, যিনি সমাজ থেকে দাসত্বপ্রথার বিলোপ সাধন করেন। নারীদের অমর্যাদা ও বিশৃঙ্খল জীবনযাপন আরবসমাজের অশান্তির কারণ ছিল। মহানবী (সা.) তাদের দুর্গতি ও দুর্দশার হাত থেকে উদ্ধার করে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’ তৎকালে আরবে কন্যাশিশুকে মাটির নিচে জীবন্ত প্রোথিত করা হতো। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ জঘন্য প্রথা নিষেধ করেন।
মদিনায় হিজরতের পর হজরত মুহাম্মদ (সা.) সেখানে ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বশান্তির অগ্রনায়ক এ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, নাগরিকদের মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রাখাসহ নানা দিক বিবেচনা করে মদিনার সনদ প্রণয়ন করেন। এতে মদিনায় বসবাসরত সব ধর্মাবলম্বী মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকারের যথোপযুক্ত স্বীকৃতি ছিল। শত অত্যাচার-নির্যাতন এবং যুদ্ধ করে যে জাতি আজীবন নবী করিম (সা.)-কে সীমাহীন কষ্ট দিয়েছে, সেসব জাতি ও গোত্রকে ক্ষমা করে এবং তাদের সঙ্গে উদার মনোভাব দেখিয়ে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের পর মহানবী (সা.) বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে অসংখ্য আন্তধর্মীয় শান্তিচুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এগুলো বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা এবং বর্ণবৈষম্য, গোত্রভেদ প্রথা প্রভৃতি বিলোপ সাধনে বিরাট অবদান রাখে।
সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)-এর অনবদ্য ভূমিকার অনন্য স্মারক হুদায়বিয়ার সন্ধি। বাহ্যিক পরাজয়মূলক হওয়া সত্ত্বেও কেবল শান্তির স্বার্থে তিনি এ সন্ধিতে স্ব্বাক্ষর করেন। ৬৩ বছরের মাক্কি ও মাদানি জীবনে তিনি সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব সুচারুভাবে সমাপন করে গিয়েছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছেন যেমন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, তেমনি যুদ্ধ করেছেন শান্তি সুরক্ষার জন্য। জীবনে অনেক যুদ্ধের মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁকে, অথচ এর কোনোটিই আক্রমণাত্মক যুদ্ধ ছিল না। মহৎ সব গুণে শান্তির দূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন ছিল পরিপূর্ণ।
পৃথিবীতে কোনো প্রকার অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজমান থাকত না। তাই তো অমুসলিম লেখক উইলিয়াম হার্ট ‘একশত শ্রেষ্ঠ মানব’ গ্রন্থে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রথম নম্বরে স্থান দিয়েছেন। প্রখ্যাত দার্শনিক জর্জ বার্নার্ড শ যথার্থই বলেছেন, মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো কোনো ব্যক্তি যদি আধুনিক জগতের একনায়কত্ব গ্রহণ করতেন, তাহলে এমন এক উপায়ে তিনি এর সমস্যা সমাধানে সফলকাম হতেন, যা পৃথিবীতে নিয়ে আসত বহু বাঞ্ছিত শান্তি ও সুখ।
তাঁর জীবনচরিতের গভীর দর্শন সত্যিকার শান্তির পথের দিশা দেয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.