সরকারি দল, বিরোধী দল ও মরার দল by ফারুক ওয়াসিফ

বিরোধী দল নারকেলগাছের মতো। সরকারি দল হলো পানের বরজ। আর জনগণ? আমরা তো পিপীলিকাসম। কীভাবে, সেটাই বলা যাক।
নারকেলগাছের ডাল সময়-সময় কেটে দিতে হয়, নাহলে ফল ধরে না, গাছ বাঁচে না। যত তাদের ওপর দমন-পীড়ন চলে, তত তারা জনমন থেকে সহানুভূতি পায়। সেটাই তো ক্ষমতাহীন অবস্থায় তাদের টিকে থাকবার পুষ্টি। পাহাড়ধসে শতাধিক মৃত্যুর চার দিন পর রাঙামাটির দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে রওনা হয়েছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাঁর যাত্রা শেষ হতে পারল না। পথে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় গাড়িবহরে হামলা হয়। পরের ঘটনা অনুমেয়। মির্জা ফখরুলসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা আহত হয়েছেন। গন্তব্যে পৌঁছতে না পেরে ফিরে এসেছেন চট্টগ্রামে। দেশজুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষিত হয়েছে। সরকারি অবহেলার কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে নয়, পাহাড় ধ্বংস করে বিপজ্জনক আবাসন চালাতে দেওয়ার জন্যও নয়, তাঁদের প্রতিবাদ দলের শীর্ষ নেতাদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে।
রাঙামাটি যেতে না পারলেও তাঁরা ব্যর্থ নন। সরকার-সমর্থকদের বলপ্রয়োগের রাজনীতির গোমর আবার ফাঁস করা গেল। মির্জা ফখরুল হেরেও জিতে গেলেন। তাঁর প্রথম হার হয়েছে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতু ও যোগাযোগমন্ত্রী ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস। তিনি মির্জা ফখরুলের আগেই হেলিকপ্টারে করে এলাকা পরিদর্শন করে এসেছেন। আওয়ামী লীগের আর কোনো বড় নেতার যাওয়ার খবর পত্রিকায় আসেনি। সাবেক পরিবেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদ কাছাকাছি এলাকার সাংসদ। তাঁর মন্ত্রী থাকাকালেই পার্বত্য এলাকার বন ও পাহাড় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হওয়ার অভিযোগ আছে। তিনিও যাননি। যা হোক, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে রাঙামাটিতে জবাবদিহি করতে হয়নি। সরকারের পরিবেশ-বিধ্বংসী কার্যকলাপের সমালোচনাও শুনতে হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের দায়টা তিনি সহজেই সেরে আসতে পেরেছেন।
কিন্তু তাঁর জন্য যা সহজ, বিরোধী দলের জন্য তেমনটা হওয়ার জো নেই। সোজা কাজটা বিরোধীদের জন্য কঠিন করে তোলাই তো সরকারি দলের ‘অবদান’। তাই হামলা-ভাঙচুর করে মির্জা ফখরুলের গাড়িবহর ফেরত পাঠানো হলো। বিএনপি যদি আরেকটু গতিশীল হতো, ঘটনার পরদিনই রাঙামাটির দিকে ছুটত। ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত। অন্তত দেশব্যাপী সে রকম আওয়াজ তোলার চেষ্টা করত। তাহলে সম্ভবত এ রকম হামলা তাঁরা এড়াতে পারতেন। বিরাট আকারে পাহাড় ধসের ঘটনার আকস্মিকতায় আওয়ামী লীগ দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকতো। দেড় শ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু, গণমাধ্যমের সমালোচনা, আন্তর্জাতিক নজর, প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর মিলিয়ে পাহাড়ধসের প্রথম ২-৩ দিনে তাঁদের আচরণ তেমনটাই ছিল। ও রকম অবস্থায় ঝটিকা সফর করলে বিএনপি দৌড়ে ও মিডিয়া চমকে এগিয়েই থাকত।
তাতে কী পেত? এক দিনের মিডিয়া কভারেজ। সম্ভবত তাদের চাওয়া ছিল আরও বেশি কিছু। তাই তারা রয়ে সয়ে মাঠে নেমেছেন। যে বিরোধী দলকে সংসদ ও রাজপথে গায়ের জোরে ‘নাই’ করে দেওয়া গেছে, তাদের পাঁচটি গাড়ির বহর রাঙামাটি শহরে ঢুকলে তা তেমন কোনো ‘ঘটনা’ হতে পারত না। এসব সফর আসলে রুটিন কাজের বেশি কিছু না। বিএনপিকে রুটিন পালন করতে দিলে তাই সরকারের কোনো ক্ষতিই হতো না। কিন্তু বিএনপির এখন দরকার ছিল একটি বড় ‘ঘটনা’। একটা হামলা, বাধা দেওয়া, নেতাদের আহত হওয়ার চাইতে নাটকীয় আর কী হতে পারে? আমাদের রাজনীতি এক চলমান মেগাসিরিয়াল। সেই সিরিয়ালের প্রতিটি পর্বে যে পক্ষ বেশি মনোযোগ কাড়তে পারবে, অনলাইন-ফেসবুকে তারা তত এগিয়ে থাকবে। রাজনীতি তো এখন এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ তাই না? সে রকম এক করুণ নাটক বিএনপি পেয়ে গেছে।
বিএনপির কোনো নেতা ১৯৭০ সালে দক্ষিণের ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকা থেকে ফিরে মাওলানা ভাসানীর মতো পল্টনে জনসভা ডেকে জলদগম্ভীর কণ্ঠে বলতে পারতেন, ‘ওরা কেউ আসেনি!’ প্রধানমন্ত্রী তখন সুইডেন সফরে রওনা হয়ে গেছেন। বেগম খালেদা জিয়া কিংবা মির্জা ফখরুলের তরফে তাই অভিযোগ ওঠানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু তাতে খুব বেশি লাভ হতো কি? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কথা আছে, জগতে যোগ্য লোক আছে কিন্তু তাকে দেখাবার যোগ্য মঞ্চ সব সময় পাওয়া যায় না। মির্জা ফখরুল নিশ্চয়ই বড় নেতা, অনেক নির্যাতনও তাঁকে সইতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর দলের মঞ্চটা এখন বড্ডই ছোট। সে রকম মঞ্চ থেকে হুংকার দেওয়া যায় না, অনুযোগ-অভিযোগ করা যায় কেবল। ফলে সেটাই করেছেন, অভিযোগ করেছেন সরকারকে আর ফরিয়াদ জানিয়েছেন জনগণের প্রতি।
অগুরুত্বপূর্ণ একটি সফরকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার জন্য আওয়ামী লীগকে ধন্যবাদ জানাতে পারে বিএনপি। রোজার মৌসুমে সহানুভূতি আদায়ের বড় একটা সুযোগ পাওয়া গেল। এই বা কম কী? বিএনপি এখন বোঝাতে পারবে, ‘দ্যাখো, সরকার আমাদের দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে দিল না!’
দৃশ্যত রাঙামাটি সফরের ঘটনায় আওয়ামী লীগ ঝামেলায় পড়েছে। হামলাটা অবশ্যই নিন্দনীয়। সেই নিন্দা মোকাবিলা করতে আওয়ামী লীগের কম গুরুত্বপূর্ণ নেতারা সাফাই গাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। এলাকাটি আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদের। তাঁর লোকজনই এ হামলা করেছে। হাছান মাহমুদের উত্তর, ‘ঘটনাটি শুনেছি। বিএনপি নেতাদের গাড়িবহর দুজন পথচারীকে ধাক্কা দেয়। এরপর সেখানে উত্তেজিত লোকজন কিছু একটা করেছে।’
ফেসবুক-ভিডিওর যুগে হামলাকারীদের পরিচয় পাওয়া কঠিন না। কিন্তু সেই যে, সহজ কাজটা সরকারি ক্ষমতায় কঠিন হয়ে যাবে। কারো টিকিটি ছোঁয়া হবে না। দেশের রাজনৈতিক মেগাসিরিয়ালে এটাই তো চলে আসছে। সেই সিরিয়ালের পর্বে পর্বে অকাতরে মানুষ মরছে। নারী-পুরুষ-শিশু, হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি, অবাঙালি। কে বিপন্ন নয় বাংলাদেশে? রাষ্ট্রীয় অবহেলা, বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর অন্যায়ে অজস্র মানুষের মৃত্যু এখন স্বাভাবিক। জনগণ হলো মহাশয়, যাদের সবই সয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা বলয়ের বাইরে পড়ে থাকা মানুষেরা ভোগে ও মরে। আমাদের রক্ষার কোনো বাঁধ, আশ্রয় নেই।
সরকারি দল হলো পানের বরজের মতো। চারদিকে বেড়া, মাচা, খুঁটি-লাঠির আশ্রয়ে পানের লতা বড় হয়। বেশি রোদে সমস্যা, বেশি বৃষ্টিতে সমস্যা; এতই নাজুক। সরকারি দলের যে প্রতাপ রাঙামাটিতে দেখা গেল, তা ওই মাচার গুণ। মাস্তানের লাঠি, বাহিনীর বন্দুক, প্রশাসনের মাচা আর টাকার ছাতায় তারা সুরক্ষিত। এতটাই সুরক্ষিত যে শত শত মানুষের লাশের ভার ঝেড়ে ফেলে তাঁরা নেমে পড়লেন বিরোধী দল পেটাতে।
আর জনগণ? জনগণ হলো পিঁপড়ার মতো, নিজের চেয়ে দশ গুণ ওজন বহন করতে পারে বলেই দেশটা টিকে আছে। স্বজন হারানোর অমানুষিক শোক বহন করেও তারা জীবন চালিয়ে যায়। তাজরীনের পর, রানা প্লাজার পর, রাঙামাটির পরও তারা জীবন চালিয়ে যাবে। তারা বাঁচে যে যার মতো, মরে দলে দলে। সরকারি দল ও বিরোধী দলের বাইরে এই আমাদের আরেক দল, মরার দল। এই দলের সদস্যসংখ্যাই এখন সবচেয়ে বেশি।

No comments

Powered by Blogger.