নকল যন্ত্রাংশে ৭ ড্রেজার বিকল

ক্রয়চুক্তি লঙ্ঘন করে নকল পার্টস সংযোজন করায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৭টি ড্রেজার অচল হয়ে পড়ে আছে। সাড়ে চারশ’ কোটি টাকার এসব ড্রেজার কেনার ২ বছর পর বড় ধরনের এ অনিয়ম ধরা পড়েছে। দরপত্র সিডিউল অনুযায়ী ড্রেজারগুলো সরবরাহের সময় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্পেয়ার্স পার্টস দেয়ার কথা। কিন্তু এখন ব্যবহার করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এগুলো উন্নত দেশের নয়, স্থানীয়ভাবে তৈরি করে দেয়া হয়েছে। আর এমন গুরুতর অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে রীতিমতো প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভোস্তা এলএমজি-কর্ণফুলী জয়েন্টভেঞ্চার কনসোর্টিয়াম লিমিটেড। এর ফলে এখন প্রয়োজনীয় স্পেয়ার্স পার্টস না পাওয়ায় বিপুল অংকের টাকায় কেনা ড্রেজারগুলো অকেজো হয়ে পড়ে আছে। সূত্রগুলো বলছে, এ কাজের তদারকির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাউবোর কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে এতবড় জালিয়াতি ও দুর্নীতি করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, ‘ড্রেজারের যন্ত্রাংশ সরবরাহে স্পেসিফিকেশন লঙ্ঘন বরদাশত করা হবে না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই চুক্তির শর্ত মানতে হবে। রাষ্ট্রের টাকায় এসব ড্রেজার কেনা হয়েছে। এটা রাষ্ট্রীয় সম্পদ।’ এক প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, ‘ড্রেজারের সব যন্ত্রাংশ উন্নত দেশে তৈরি হওয়ার চুক্তি করা হয়েছে। নিন্মমানের সব যন্ত্রাংশ সরিয়ে চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়েছে। আমার সাফ কথা, চুক্তিবহির্ভূত কোনো নাট-বল্টুও গ্রহণ করা হবে না।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক শহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ক্রয় চুক্তিবহির্ভূত স্পেয়ার পার্টসের দাম প্রায় ৫৫ কোটি টাকা। এসব যন্ত্রাংশ পরিবর্তন করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। ড্রেজ পাম্প একটি ড্রেজারের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র। উন্নত বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি এ যন্ত্র তৈরিতে দক্ষ। ড্রেজ পাম্পই হচ্ছে ড্রেজারের মূল শক্তি। এটা সচল না হলে শত কোটি টাকার ড্রেজারই অকেজো। এমন গুরুত্বপূর্ণ ড্রেজ পাম্পকে সহায়তাকারী সব যন্ত্রাংশই যেন উন্নতমানের হয় সেজন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। অথচ ‘ওয়ারিং প্লেট’ নামে গুরুত্বপূর্ণ একটি যন্ত্র বানানো হয়েছে যশোরের একটি ওয়ার্কশপে। তাও আবার এক-দুটি নয়। নয়-নয়টি।
ঝালাই দিয়ে সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে আরও কয়েকটিতে। ড্রেজার মেশিন চালানোর পর ধরা পড়ে সরবরাহ করা এসব স্পেয়ার পার্টস নকল। ৪৪২ কোটি টাকায় কেনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৭টি ড্রেজারে ৫৫ কোটি টাকার এরকম নকল স্পেয়ার পার্টস সরবরাহ করা হয়েছে। এ কারণে পাউবোর স্বপ্নের ড্রেজার প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। অথচ এসব ড্রেজার বাবদ ৯০ ভাগ টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করা হয়ে গেছে। জানা গেছে, ক্রয় চুক্তিবহির্ভূত স্পেয়ার পার্টসের কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ড্রেজার কার্যক্রম এখন অচল হয়ে আছে। এ কারণে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। গঠিত কারিগরি তদন্ত কমিটির (ড্রেজার এনসিলারি ক্রাফটস ইন্সপেকশন অ্যান্ড একসেপটেন্স) প্রতিবেদনে ড্রেজারে নকল যন্ত্রপাতি সরবরাহের বিষয়টি ধরা পড়ে। গত বছরের ১০ অক্টোবর এ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এরপর থেকে এসব নকল যন্ত্রাংশ সরিয়ে ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতে ড্রেজার পরিদফতর থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দফায় দফায় চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু যন্ত্রাংশ সরবরাহ দেয়া হয়নি। টেস্ট রেজাল্ট পর্যালোচনা করে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের একাংশে বলা হয়- ‘সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভোস্তা এলএমজি-কর্ণফুলী জয়েন্টভেঞ্চার কনসোর্টিয়াম লিমিটেড কর্তৃক পাউবোর দুই প্রকল্পে সরবরাহ করা স্পেয়ার পার্টসগুলো অত্যন্ত নিন্মমানের। দিনের পর দিন তারা একই ধরনের ছলচাতুরী এবং জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে পাউবোর ড্রেজিং কার্যক্রমকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। ড্রেজার সরবরাহকারী বিশাল প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও সামান্যতম দেশাত্মবোধ এবং ব্যবসায়িক সততার অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের সুনাম।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী জয়েন্টভেঞ্চার কনসোর্টিয়াম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রশীদ নকল পার্টস দেয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘জার্মানি থেকে স্পেয়ার পার্টস এনে দেয়া হচ্ছে।
ইতিমধ্যে প্রি-শিপমেন্ট কমিটি জার্মানি গিয়ে স্পেয়ার পার্টস দেখে এসেছে।’ ৭ ড্রেজারের স্পেয়ার পার্টসের বিষয়ে প্রথমে বলা হয়, গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পের (ফেজ-২) জন্য ২টি কাটার সাকশন ড্রেজারের স্পেয়ার পার্টস বিষয়ে। ২৩৯ কোটি টাকায় কেনা ২৬ ইঞ্চি দুই ড্রেজার সম্পর্কে বলা হয়, পাউবোর কমিটি কর্তৃক স্পেয়ার পার্টস গ্রহণের পর মাঠপর্যায়ে ব্যবহার করতে গিয়ে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা যায়। ড্রেজ পাম্পের মূল ওয়ারিং প্লেট প্রায় ২ হাজার ৮শ’ ঘণ্টা চলার পর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর স্পেয়ার পার্টস হিসেবে দেয়া ওয়ারিং প্লেট চলেছে মাত্র ২২৫ ঘণ্টা। এর পরই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পের ড্রেজিং কাজ। পরে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভোস্তা এলএমজি-কর্ণফুলী জয়েন্টভেঞ্চার কনসোর্টিয়ামকে স্পেয়ার পার্টস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়। কিন্তু তারা এ বিষয়ে কোনো সাড়া দেয়নি। এরপর কমিটি নিজস্ব উদ্যোগে পাইলট প্ল্যান্ট অ্যান্ড প্রসেস ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (বিসিএসআইর) থেকে সক্ষমতা (হার্ডনেস) টেস্ট করা হয়। এতে দেখা যায়, ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী ওয়ারিং প্লেটের (আউটার) সক্ষমতা থাকার কথা ৬শ’ অশ্বশক্তি। সেখানে টেস্ট রেজাল্টে ধরা পড়েছে মাত্র ১৭১। এরপর টেস্ট রেজাল্টসহ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে অবহিত করা হয়। ক্রয় চুক্তিবহির্ভূত স্পেয়ার পার্টস সরিয়ে প্রয়োজনীয় পার্টস সরবরাহ দেয়ার অনুরোধ করা হয়। এরপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জরুরিভিত্তিতে বিমানে পার্টস এনে দেয়ার অঙ্গীকার করে। কিন্তু ৮ মাস গত হয়ে গেলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাউবোর ড্রেজার কার্যক্রম। পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ড্রেজিং বিষয়ে আরেকটি প্রকল্পের নাম ‘প্রকিউরমেন্ট অফ ড্রেজার অ্যান্ড এনসিলারি ইকুইপমেন্ট ফর রিভার ড্রেজিং অফ বাংলাদেশ।’ এ প্রকল্পের জন্য ১৬৩ কোটি টাকায় কেনা হয় ৫টি ড্রেজার। এর মধ্যে ২টি ২২ ইঞ্চি ও ৩টি ২৬ ইঞ্চি (মাটি কাটার মূল যন্ত্রাংশের মাপ)। এ ড্রেজারের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়- ৫শ’ মিলিমিটার ডিসচার্জ পাইপ কাটার সাকশন ড্রেজার সরবরাহ নেয়া হয় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে। ২০১৫ সালের ১২ মে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেয়ার পার্টস সরবরাহ করে। প্রকল্প দুটির চারটি ড্রেজারই একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান (ভোস্তা এলএমজি-কর্ণফুলী জয়েন্টভেঞ্চার কনসোর্টিয়াম) থেকে নেয়া হয়। গড়াই নদী ড্রেজিংয়ের স্পেয়ার পার্টস সরবরাহে মারাত্মক অনিয়মের বিষয়টি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পাউবো অবহিত থাকায় পরবর্তী স্পেয়ার পার্টস সরবরাহে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সতর্ক থাকার কথা ছিল। ধরে নেয়া হয়েছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ক্রয় চুক্তি মেনে চলবে।’ কিন্তু স্পেয়ার পার্টসের সক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখা যায়, ‘ইমপিলার’ নামে আরেকটি যন্ত্রের সক্ষমতা থাকার কথা ৬০০। আছে মাত্র ২২২। পরে টেস্ট রেজাল্টসহ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে অবহিত করা হয়। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রেও অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ড্রেজিং কাজকে চরমভাবে ব্যাহত করেছে। চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ সরবরাহের অঙ্গীকার করেও বারবার ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছে।
যশোরের ওয়ার্কশপের সন্ধান যেভাবে : সূত্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী তদন্ত কমিটির সদস্যরা গত বছরের ১৫ অক্টোবর যশোরের বিসিক শিল্প নগরীর ভেতরে এবং বাহিরের কয়েকটি ওয়ার্কশপ পরিদর্শন করেন। এ সময় ৬৫০ মিলিমিটার ডিসচার্জ পাইপ কাটার সাকশন ড্রেজারের বাহির এবং ভেতরের ওয়ারিং প্লেটের (আউটার অ্যান্ড ইনার) কাঠের তৈরি নমুনা দেখতে পান, যা দিয়ে মোল্ড তৈরি করা হয়। এসব দেখে হতবাক হয়ে পড়েন কমিটির সদস্যরা। এরপর ওই ওয়ার্কশপের মালিকের সঙ্গে কথা বলে কমিটির সদস্যরা জানতে পারেন ৯টি ওয়ারিং প্লেট তার ওয়ার্কশপ থেকে তৈরি করা হয়েছে। ঝালাই দিয়ে সক্ষমতা বাড়ানো হয় আরও কয়েকটিতে। পরে গড়াই নদী পুনঃখনন কাজ পরিদর্শনকালে কমিটির সদস্যরা কয়েকটি ওয়ারিং প্লেটে ঝালাই দেয়ার সত্যতা পান। এমনকি ওয়ারিং প্লেটে সিরামিক দিয়ে লেপন করার বিষয়টিও তদন্ত কমিটির চোখে ধরা পড়ে। শুধু তাই নয়, তদন্ত কমিটির সদস্যরা একই অবস্থা দেখতে পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ ড্রেজার ক্যাম্পাসে রাখা আরও কয়েক ধরনের যন্ত্রাংশে। যার সঙ্গে ক্রয় চুক্তির কোনো মিল নেই। ড্রেজারের সঙ্গে যে হোস পাইপ দেয়া হয়েছে তাও নিন্মমানের। হোস পাইপ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, পাম্প চালানোর সঙ্গে সঙ্গে মাটিমিশ্রিত পানির চাপে হোস পাইপ ফেটে যায়। তদন্ত কমিটির মতে, এগুলো বাংলাদেশে তৈরি করা হয়েছে। এসব হোস পাইপ সরিয়ে চুক্তি অনুযায়ী মানসম্পন্ন পাইপ সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। কিছু হোস পাইপ বিমানে এনে দেয়ার অঙ্গীকার করেও বারবার সময়ক্ষেপণ করছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির মালিক আবদুর রশীদ। আর এতে করে সংশ্লিষ্ট ড্রেজিং কাজ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.