একজন কর্মিবান্ধব নেতা

বনানী গোরস্থানে সবুজের নীড়ে মা-বাবার পাশে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন ব্যক্তিত্ব শফিউল আলম প্রধান ঘুমিয়ে আছেন। ঢাকা ইকবাল রোডে, দিনাজপুর ও পঞ্চগড়ে এবং সর্বশেষ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে হাজার মানুষের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে সবাই চোখের পানি ফেলে প্রিয় নেতাকে বিদায় জানালেন। কেউ চিৎকার করে কেঁদেছেন, কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছেন আর কেউবা নীরবে অশ্রু ঝরিয়েছেন। ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টিÑ জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধান। ২১ মে তিনি ৬৯ বছর বয়সে স্ত্রী রেহানা প্রধান, মেয়ে ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান, ছেলে রাশেদ প্রধান, চার ভাই দুই বোনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে চিরবিদায় নিলেন। তার মৃত্যুতে সাথে সাথে শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির মহাসচিবসহ ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা ও জাগপার নেতাকর্মীরা ভিড় জমাতে শুরু করলেন আসাদ গেটের সেই বাড়িতে। কেউ কেউ বললেন, এই তো সেদিন প্রধান ভাই তার স্ত্রী রেহেনা প্রধানের জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছিলেন। খুবই অসুস্থ হয়ে স্কয়ার হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই প্রধান ভাই অসুস্থ হয়ে মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। হাসিমাখা মুখে বলেছিলেন, গণতন্ত্রের জন্য, মেহনতি শ্রমিকের জন্য আরো কিছু দিন হয়তো বেঁচে থাকতে হবে। সেই মানুষটি এভাবে নীরবে চলে যাবেন, বুঝতেই পারিনি। শফিউল আলম প্রধান ছিলেন কর্মিবান্ধব নেতা। তাকে অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে। এককালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অনেক স্নেহের। শেষ পর্যন্ত ’৭৪ সালে এপ্রিল মাসে মুহসীন হলের সেভেন মার্ডারের ঘটনার জের ধরে থাকতে পারলেন না ছাত্রলীগে। ’৭৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দুর্নীতির শ্বেতপত্র বের না করলে হয়তো আজ ইতিহাস অন্যরকম হতো। সে সময়ে যেসব ব্যক্তি তার কর্মী ও শিষ্য ছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই মন্ত্রী, এমপিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। সেই তালিকা থেকে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বর্তমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বাদ পড়েন না। প্রধান ভাই রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য ছিলেন। তার বাবা মরহুম গমীর উদ্দিন প্রধান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের স্পিকার ছিলেন। ১৯৫০ সালে পঞ্চগড়ের জন্মগ্রহণ করেন প্রধান। তার স্ত্রী অধ্যাপিকা রেহেনা প্রধান ছিলেন ‘অগ্নিকন্যা’। ১৯৮০ সালের ৬ এপ্রিল রমনা গ্রিনে প্রধান ভাই প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টিÑ জাগপা। তার সাহসী বক্তব্য সবাই সাদরে গ্রহণ করতেন। তিনি কাউকে পরোয়া করে কথা বলতেন না। এ জন্য বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। ক্ষমতা কিংবা চেয়ারের জন্য তার লড়াই ছিল না। তার লড়াই ছিল আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে। কখনো আপস করেননি। তার সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার লুৎফর রহমান ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুর রহমান আসাদ ’৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে (ডাকসুর ভিপি) আমান-খোকন-আলমের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মরহুম প্রধানের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, তিনি কখনো একা সিদ্ধান্ত নিতেন না। দলের সবাইকে নিয়ে পরামর্শ করে কর্মসূচি ঘোষণা করতেন সপ্তাহে অন্তত দুই-তিন দিন কর্মীদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করতেন। তার আসাদ গেটের দলীয় কার্যালয় এবং পুরানা পল্টনের অস্থায়ী কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। দুুপুর বেলায় নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে কখনো চা-পুরি, কখনো ডাল-রুটি খেয়েই দিনটি কাটিয়ে দিতেন। নিজের জন্য আলাদা কিছু করতেন না। এজন্যই তৃণমূলপর্যায়ের নেতাকর্মীদের পেয়েছিলেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তিনি অন্য দলের রাজনৈতিক কর্মীদেরও মর্যাদা দিতেন ও ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন নেতা তৈরি করার কারিগর। তৃণমূলপর্যায়ের নেতাকর্মীদের ও তাদের পরিবারের খবর নিতেন এই নেতা। তাদের বিভিন্নভাবে উৎসাহ দিতেন। জাতীয় রাজনীতিতে চরম সঙ্কটময় মুহূর্তে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন। গণতন্ত্র গুম হয়ে আছে, মানুষের ভোটের অধিকার পযুদস্ত, অনিশ্চিত পথে হাঁটছে গণতন্ত্রের অন্বেষণে রাজনৈতিক দলগুলো, ঠিক সেই সময়ে বিপ্লবী এই কণ্ঠস্বরের বিদায় নিদারুণ দু:খের। ১৯ মে সকালে মোবাইলে আমার সাথে শেষ কথা হয়েছিল। তিনি ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বৃহত্তর দিনাজপুরে স্বাধীনতা প্রথম পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানির কতটুকু মর্যাদা আমরা দিতে পেরেছি? একসময়ে যে ছাত্রলীগের জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন, সেখানে তারই সেই শিষ্য এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি কি অতীতের স্মৃতি মনে করে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই মহান নেতাকে সমাহিত করার উদ্যোগ নিতে পারতেন না? তার সাথে আলেম ওলামার সাথে ছিল গভীর সম্পর্ক। মরহুম চরমোনাই পীর সাহেব, শায়খুল হাদীস, মুফতি আমিনী, মাওলানা মুহিউদ্দীন খানসহ দেশবরেণ্য সব আলেমের প্রাণের মানুষ ছিলেন তিনি। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, যাদু মিয়া, আনোয়ার জাহিদসহ জাতীয় নেতাদের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে। শিক্ষকদেরও তিনি অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। সর্বশেষ তার প্রিয় শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদের সাথে বেগম খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০ অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। তিনি তখন স্যারের পা ছুঁয়ে দোয়া নিতে গেলে স্যার তাকে পরম মমতায় বুকে টেনে নিয়েছিলেন। কথাটি ২৪ মে জাতীয় প্রেস কাবে প্রথম স্মরণ সভায় ব্যক্ত করেছিলেন স্বয়ং ড. এমাজউদ্দীন আহমদ।

No comments

Powered by Blogger.