মৃত্যুর বিভীষিকা ও মানুষের দায়

মোহাম্মদ নবী পেশায় ড্রাইভার। থাকতেন রাঙ্গামাটি শহরের নতুনপাড়া মসজিদের পাশে। তার মেয়ের বিয়ে রোজার পরেই। এ জন্য প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু এবার পাহাড়ধসে তার পরিবারের পাঁচ সদস্যের সবাই বাড়িটির সাথে জীবনের সব স্বপ্ন আর আনন্দও মাটির বিশাল স্তূপের নিচে চাপা পড়েছে। তিনি নিজে এখন হাসপাতালে লড়ছেন মৃত্যুর সাথে। দশম শ্রেণীর কিশোর শিক্ষার্থী জিয়াদের সামনে পুরো ভবিষ্যৎ। এর পুরোটাই এখন নিকষ অন্ধকার। রাঙ্গামাটির ভেদভেদি বাজার এলাকায় তাদের বাড়ি। ভূমিধসে সবাইকে হারিয়েছে সে। মারাত্মকভাবে আহতাবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। সুবাস চাকমা ও জীবন চাকমা যথাক্রমে পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। সম্পর্কে একে অপরের ভায়রা। তারা কল্পনাও করেননি, পাহাড়ধসে চিরদিনের জন্য হারাবেন স্ত্রী-সন্তানদের। জীবন চাকমার সাথে আগের রাতেও মোবাইলে স্ত্রীর কথা হয়েছিল। তিনি বাড়ি আসছেন বলে স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন। স্ত্রী ও সন্তানেরা অধীর প্রতীক্ষায় ছিল তার জন্য। এখন তিনি আজীবন প্রতীক্ষায় থাকলেও প্রিয়জন আর কোনো দিন ফিরবে না। গত সপ্তাহের প্রবল বর্ষণে নজিরবিহীন পাহাড়ধসে তিন পার্বত্য জেলা এবং বৃহত্তর চট্টগ্রামে দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বসতবাটি ও সড়কসহ সম্পদের ক্ষতি বিপুল। উদ্ধারকাজে নিরত অবস্থায় সেনাবাহিনীর দু’জন কমিশন্ড অফিসারসহ পাঁচজন নিহত এবং ১০ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। রাঙ্গামাটির মানিকছড়িতে ধসের মাটি সরিয়ে উদ্ধার কাজের সময় আবার পাহাড়ে ধস নামে। সেখানে অবস্থানরত ইউনুছ নামের এক লোক ধসে যাওয়া কাদামাটির তোড়ে নিচে একটা পুকুরে পড়লেও বেঁচে যান। কিন্তু পাশেই সেনাবাহিনীর সেই তরুণ মেজর ও ক্যাপ্টেন মাটি চাপা পড়ে তখনই মৃত্যুবরণ করেন। ভূমিধসে রাঙ্গামাটি-বান্দরবান জেলার সড়ক যোগাযোগ মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত। কয়েক দিন ধরে এই দুই জেলা দেশের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এ দিকে, সোমবার ভয়াবহ ভূমিধসের পরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পূর্বনির্ধারিত সুইডেন সফরে গেছেন। তার অনুপস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে কয়েকজন নেতাকে মুজিবকোট পরে দুর্যোগে বিপন্ন পাহাড়ি এলাকা পরিদর্শন করতে দেখা গেল। কাদের সেখানে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ মানুষের দুঃখ দুর্দিনে তাদের পাশে থাকে।’ অপর দিকে, পাহাড়ধসে নিহতদের মাগফিরাত আর আহতদের সুস্থতা কামনায় শুক্রবার দেশব্যাপী মসজিদে দোয়া-মুনাজাতের কর্মসূচি দিয়েছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। এই দুঃসময়ে সরকারপ্রধানের বিদেশ গমনের সমালোচনা করেছেন বিরোধী দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়া।
দুর্ঘটনা নয়, দুর্যোগ
বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বে দীর্ঘ দিন ধরে দারিদ্র্য ও দুর্যোগের দেশ হিসেবে পরিচিত। অবশ্য ইদানীং দারিদ্র্য কমে (অন্তত কাগজকলমে) দুর্যোগের সাথে আরো দু’টি ‘দু’ বেড়ে গেছে। সেই দু’টি হলো দুর্নীতি ও দুষ্কৃতি। এ দেশের গতানুগতিক দুর্যোগের মধ্যে আছে বন্যা, নদীভাঙন, টর্নেডো ও সাইকোনের মতো ঝড়ঝঞ্ঝা, খরা, প্রভৃতি। ইদানীং এই তালিকায় যোগ হয়েছে ভূমিকম্প ও বজ্রপাত। ভূ-কম্পন অতীতে ব্যাপক ক্ষতি ঘটালেও বহু বছর ধরে এর আশঙ্কা তেমন করা হয়নি। এখন আবার ভয়াবহ কম্পনের শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। দেশে বজ্রপাতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেড়ে গেছে। অপর দিকে, নদ-নদীর ভাঙনকে গুরুত্ব দেয়া হলেও ভূমির ভাঙন বা পাহাড়ের ধসের দিকে অতীতে কর্তৃপক্ষের বেশি মনোযোগ ছিল না। এর একটা কারণ, তখন পাহাড়ধস আজকের মতো এত ঘন ঘন ঘটত না এবং এত ক্ষতির কারণ হয়নি জানমালের হিসাবে। নদীভাঙন পুরোপুরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তবে পাহাড়ের ভাঙন বা ধসের জন্য প্রকৃতির সাথে মানুষও দায়ী। অনেক ক্ষেত্রে বরং মানুষের লোভ ও অজ্ঞতাই এজন্য বেশি দায়ী। এই ভয়াবহ বিপর্যয় অনেকটাই এড়ানো যায় যদি উন্নয়নকে টেকসই করার জন্য প্রশাসনের পর্যাপ্ত জ্ঞান ও আন্তরিকতা থাকে। Sustainable Development Goal (SDG) বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এত তোড়জোড়। অথচ উন্নয়নের নামে প্রপাগান্ডা, অপচয়, দুর্নীতির অনুপাতে টেকসই উন্নতি কতটা হচ্ছে, তা একটা বিরাট জিজ্ঞাসা। কুরআনের সর্বশেষ পারার সূরায়ে নাযায় ৬ ও ৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘আলাম্ নাজআলিল আরদা মিহাদাওঁ ওয়াল জিবালা আওতাদা’; অর্থাৎ ‘আমি কি করিনি ভূমিকে শয্যাস্বরূপ এবং পর্বতমালাকে কি করিনি পেরেকসদৃশ?’ এখানে ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে যে, পাহাড়পর্বত কীলক বা পেরেকের মতো ভূমিকা রাখে পৃথিবীর ভূ-প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে। পাহাড় কাটলে প্রকৃতি ভারসাম্য হারায়। সূরায়ে আত্ তাকভীরের ৩ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে, ওয়া ইজাল জিবালু সুয়্যিরাত’; অর্থাৎ, যখন পাহাড়-পর্বত সরিয়ে দেয়া হবে। প্রবল ভূমিধসের সময় উঁচু পাহাড় ধসে ক্রমেই নিচের দিকে সরে যাওয়া যেন এরই কিঞ্চিৎ নমুনা।
ভূমিধস ও বাংলাদেশের ভূগোল
পার্বত্য অঞ্চলে এত মানুষের যে করুণ মৃত্যু ঘটছে, এর দৃশ্যমান কারণ হলো, ভূমিধস বা Landslide. নদীর ভাঙনের মতো পাহাড়ের এই ভাঙন বাংলাদেশের জন্য একটি বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রায় প্রতি বছরই ভূমিধস কমবেশি হচ্ছে। তবে পাহাড়ি জেলাগুলোর প্রত্যন্ত অঞ্চলে এটা ঘটলে খবর যথাসময়ে পাওয়া সহজ নয়। আবার ভূমিধসে উল্লেখযোগ্য কোনো সড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে গেলে সে খবর দ্রুত প্রচার হয়ে যায়। অথবা ধসের কারণে প্রাণহানি হলে কেবল তখনই মনে করা হয় যে, বিষয়টি গুরুতর এবং জরুরি পদক্ষেপের দাবি রাখে। অথচ মানুষ হতাহত না হলেও কিংবা বসতবাড়ি বা কোনো স্থাপনা ধ্বংস না হলেও ভূমিধস প্রকৃতির স্বাভাবিক চিত্র পাল্টে দিয়ে ব্যাপক ক্ষতি ঘটায়, যে কারণে মানুষকেই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বাংলাপিডিয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় ভূমিধস অহরহ ঘটছে। গোটা দেশের সাথে বান্দরবান শহরকে যুক্তকারী প্রধান সড়কগুলো প্রায় প্রতি বছর ভূমিধসের মুখোমুখি হচ্ছে, যা শহরটি ও সংলগ্ন অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ভবনাদি ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের কারণে সৃষ্ট ভূমিধস সাধারণত পার্বত্য জেলা শহরের শহর ও উপশহর কেন্দ্রে সীমিত। বহু ঘরবাড়ি ও অবকাঠামো, বিশেষ করে খাড়া উঁচু ঢালের ওপর যেগুলো বিদ্যমান, সেগুলো ভূমিধসের কারণে ধসে পড়ে জানমালের ক্ষতি সাধন করে। বিগত বছরগুলোতে খাড়া উঁচু ঢালে জুমচাষ এবং অন্যান্য চাষাবাদও ভূমিধস সংঘটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, পাহাড়ের বৃক্ষশূন্য এমনকি তৃণহীন অনাবৃত ঢালে বৃষ্টির পানির অনুপ্রবেশ ভূমিধসের একটা কারণ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও সংলগ্ন অঞ্চলের ওপর গবেষণায় এটা জানা যায়। এবার পার্বত্য এলাকার ভয়াবহ ভূমিধসে কাদামাটির স্রোত নেমে আসতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি এমন যে, এখানকার মৃত্তিকা প্রধানত কাদা বা পলি ও বালু দিয়ে গঠিত। এ দেশে শক্ত পাথুরে মাটি সে তুলনায় অনেক কম। রাঙ্গামাটি জেলার সাগর বিল এলাকায় নরম নদীবাহিত অবক্ষেপের ওপর ভর করে থাকা ‘নদীর তীরের বিপুল বোঝা’ এবং উঁচু পার্শ্বঢাল ভূমিধসের প্রধান কারণ। ১৯৯৭ সালে ভৌগোলিক তথ্যব্যবস্থা বা জিআইএস পদ্ধতি ব্যবহার করে পার্বত্য খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলায় ১৬০টি ভূমিধসপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছিল। এরপর ২০০০ সাল পর্যন্ত দু’বছরে ভূমিধস নিয়ে বেশি কাজ করা হয়েছে রাঙ্গামাটি জেলা শহর আর বান্দরবান সদর উপজেলায়। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, আমাদের দেশে পাহাড়ি এলাকায় রাস্তাঘাট নির্মাণকালে ভূমিধসপ্রবণ অঞ্চলের কথা বিবেচনায় আনা হয়নি। অর্থাৎ এত বড় একটা বিপর্যয়ের বিষয় গুরুত্ব পায়নি। এ কারণে প্রত্যেক বছরই এসব সড়কে ঘটছে ভূমিধস; হঠাৎ মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে যোগাযোগ। শুধু সড়কই নয়, মানুষের জানমাল এবং বাড়িঘর স্থাপনা সমেত অবকাঠামো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে। পাহাড়ধসে মর্মান্তিক প্রাণহানি আর সম্পদ নাশের সর্বশেষ ঘটনার পর বিশেষজ্ঞরা নানা অভিমত দিচ্ছেন। ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, ‘ভূমিধস বা পাহাড়ধস ঠেকাতে শেকড় গভীরে যায়, এমন গাছের বন তৈরি করতে হবে।’ তার ভাষায়, ভূমিধস বা পাহাড়ধস হয় দু’টি কারণে। এক. অতিমাত্রায় বৃষ্টি, দুই. ভূমিকম্প। এর সাথে আছে পাহাড়ের মাটির গুণাবলি। ভূমিকম্পে যে শক্তিতে পাহাড় নাড়া খায়, যদি পাহাড়ের মাটির গুণাবলি ভালো হয়, তবে পাহাড় ধসের আশঙ্কা কম থাকে। কিন্তু পাহাড়ের মাটি যদি দুর্বল হয়Ñ বেলেমাটি ও কাদামাটির গঠন থাকে, তবে ধসের আশঙ্কটা বেড়ে যায়।
পাহাড়ের বুকে ভার্সিটিজীবন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাস পাহাড়, বন, রকমারি বৃক্ষ আর প্রাণিসম্পদে এখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য। এই পাহাড় আগেও ছিল। অতীতে এখানে বনজঙ্গল ছিল নিশ্চয়ই। তবে আমরা যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম ও হলে থাকতাম, তখন সব পাহাড় ছিল সম্পূর্ণরূপে বৃক্ষশূন্য। সেই ফাঁকা পাহাড় ও টিলায় বৃক্ষায়ন বা বনায়ন শুরু হয় অনেক পরে। বহু বছরের বন উজাড় বা বৃক্ষনিধনের পরিণামে একসময় ক্যাম্পাসে বা আশপাশের পাহাড়ে গাছপালা আর অবশিষ্ট থাকেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কিছু পরে ক্যাম্পাসের দীর্ঘ রাস্তার দু’পাশে বৃক্ষরোপণ করে এগুলোর পরিচর্যার পদক্ষেপ নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উদ্যোগী ছিলেন উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের (মরহুম) প্রফেসর আবদুল আজিজ খান। আমরা তাকে দেখেছি নিজে বৃক্ষপরিচর্যার কাজ তত্ত্বাবধান করতে। পরে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছিলেন। ধর্মভীরু মানুষটি ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রফেসর এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ভায়রা। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয়, ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে আমরা দেখলাম, বিভিন্ন হলের সামনে ইউক্যালিপটাস গাছ। এ ধরনের গাছ শুধু যে মাটিকে দূষিত করে, তা নয়; এর শেকড় অগভীর। একবার সামান্য ঝড়ে গাছগুলো উপড়ে পড়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা কয়েকজন ছাত্র একবার হাইকিং প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম। সে দিন সকালে যাত্রা করে অবিরাম হেঁটে দুপুরে পৌঁছি ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের কাছে। আমরা পদব্রজে পার হয়েছিলাম হাটহাজারী-সীতাকুণ্ড পাহাড়ের একটা অংশ। তখন আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা হলোÑ এসব পাহাড় প্রায় ন্যাড়া বা ন্যাংটা; অর্থাৎ বৃক্ষশূন্য। আমাদের কয়েক ঘণ্টার পদযাত্রা অভিযানের সময় পুরো পাহাড়ে মাঝে মধ্যে বুনো কলার কিছু ঝোপ ছাড়া গাছপালা প্রায় চোখেই পড়েনি। পথে বারবার দেখা পেয়েছি আশপাশের জনপদের গরিব মানুষের। তারা পাহাড়ে জ্বালানি কাঠ বা লাকড়ির সন্ধানে গিয়ে যৎ সামান্য যা পাচ্ছিলেন, তা আঁটি বেঁধে মাথায় বা ঘাড়ে করে ফিরছিলেন। এ ছাড়াও, চট্টগ্রামে একাধারে কয়েক বছর অবস্থানকালে লক্ষ করতাম, এই বিরাট এলাকার পাহাড় ও টিলাগুলোর বিস্তীর্ণ অংশই একেবারে ফাঁকা, কোনো বন দূরের কথা, বৃক্ষ বলতে কিছু চোখে পড়ত না। এই অবস্থায় কী করে যে, পাহাড়গুলোতে বহু দিন ভয়াবহ ভূমিধস ঘটেনি, এটাই বিস্ময়ের ব্যাপার। অনেক ক্ষেত্রে শেষাবধি প্রকৃতির পাল্টা মার শুরু হয়ে যায়, ধস আর ধ্বংসের তাণ্ডব ঘটিয়ে। ন্যাড়া পাহাড় ছ্যাঁড়া বরাত। মানে, পাহাড় যদি বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ে, তা হলে দুর্ভাগ্য নেমে আসে। এটাই দেখা গেল ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি। তখন চলছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ছুটি। এ সময় প্রথম বর্ষার প্রবল বর্ষণে ক্যাম্পাসে বৃক্ষশূন্য পাহাড় মারাত্মক ভূমিধসের কারণ হয়েছিল। এক রাতে পাশের পাহাড় ধসে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুদামের পাকা ভবন চাপা দেয়। সেই সাথে কয়েকজন প্রহরীও চাপা পড়েন। অনেক কষ্টে মাটি সরিয়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে তাদের লাশ বের করা হয়েছিল। এমন মর্মান্তিক ঘটনা এই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে আর বোধ হয় ঘটেনি। পরে শুনেছি, রাতে প্রথমে একটা অস্পষ্ট মৃদু আওয়াজ কিছুক্ষণ শোনা যাওয়ার পরই বিশাল পাহাড় নেমে এসে চাপা দেয় মালামালসমেত গুদাম ও তার প্রহরীদের। আসলে ধসের শিকার হয় যে পাহাড়, সেটি ধীরে ধীরে যখন ভেঙে নিচের দিকে এগোতে থাকে, তখন ‘চলন্ত মাটি’র একধরনের মৃদু শব্দ হতে পারে। যারা এ ব্যাপারে সচেতন, তারা হয়তো দৌড়ে পালিয়ে অন্তত জানটা বাঁচাতে পারেন। কিন্তু যাদের এ ব্যাপারে জানা নেই কিংবা যারা তখন ঘুমে থাকেন, তাদের মাটিচাপা পড়া অনিবার্য হয়ে ওঠে।
প্রতিকারের জন্য পরামর্শ
কথায় বলে ‘অভাবে স্বভাব নষ্ট’। পাহাড়ি অঞ্চলে দরিদ্র বাঙালিদের অনেকে জনসংখ্যার চাপে বিপজ্জনক স্থানে বসতি গড়েছে। এ জন্য তারা অবৈধভাবে পাহাড় কেটেছে, সেই সাথে কেটেছে গাছপালাও। তবে শুধু ছিন্নমূল Settler বা বাঙালি বসতি স্থাপনকারীই নয়, পার্বত্য এলাকার কথিত আদিবাসী তথা বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর লোকেরাও এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে দায়ী। বিশেষ করে তাদের ‘ঐতিহ্য’ হিসেবে গণ্য যে জুম চাষপ্রথা, এটাও ভূমিধসের কারণ ঘটায়। এই প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট সাধারণ মানুষের উপযুক্ত জীবিকা ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালি হোক আর পাহাড়ি, সবাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং সবার সমান অধিকারের নিশ্চয়তা সংবিধান দিয়েছে। তাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করা সরকারের একটা গুরুদায়িত্ব। ভূমিধসপ্রবণ কিংবা এর আশঙ্কাপূর্ণ অঞ্চলের বাসিন্দাদের শুধু জীবিকা ও বসতির নিরাপত্তাই নয়, তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে অবকাঠামো নির্মাণসহ বিবিধ উন্নয়ন কার্যক্রমে। তাদের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতনতা। বুঝাতে হবে যে, তাদের নিরাপদ জীবনের স্বার্থেই পাহাড় ও বন তথা প্রকৃতিকে অুণœ রাখতে হবে। পার্বত্যাঞ্চলের ুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের একটি পুরনো প্রথা হলো জুমচাষ। অনেকেই এটাকে ‘আবহমানকালের ঐতিহ্য’ হিসেবে গণ্য করে আবেগবশত এর ক্ষতির দিকটা এড়িয়ে যান। অতীতে জুমচাষের জন্য যথেষ্ট জমি পাওয়া যেত। এ কারণে প্রাকৃতিক বন সৃষ্টির জন্য ভূমি দীর্ঘ সময় অনাবাদি রাখা সম্ভব হতো। কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগেই অনাবাদি রাখার সময়ের পরিধি দশ বছর থেকে মাত্র দু’তিন বছরে নেমে এসেছে। এটা পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক। এর বড় কারণ, পার্বত্য অঞ্চলেও জনবসতি বৃদ্ধি পাওয়া। জুমচাষের ক্ষতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ভূমিক্ষয়, উর্বরতা হ্রাস, বন উজাড় ও বন্যপ্রাণীর আবাস বিনষ্ট হওয়া, নদীসহ জলাধার ক্রমশ ভরাট হয়ে যাওয়া। এই প্রেক্ষপটে জুমের ফলনও অনেক হ্রাস পেয়েছে। এর বিকল্প পন্থা উদ্ভাবন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। পাহাড়ধস ও এর পরিণামে জানমালের ধ্বংসতাণ্ডব সম্পর্কে আমাদের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। গত ১০ বছরে সাড়ে ৪০০ মানুষ এবং কেবল এবারেই দেড় শতাধিক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুই কি এ ব্যাপারে যথেষ্ট নয়? যদি এর পরও পাহাড় বাঁচাতে এবং প্রাণ ও সম্পদের বিনাশ ঠেকাতে স্থায়ী, বাস্তবধর্মী ও সমন্বিত পদক্ষেপ সরকার না নেয়, তা হলে হয়তো আরো বড় দুর্যোগই হবে আমাদের নিয়তি। এ ক্ষেত্রে উন্নয়নের সাথে প্রকৃতির তো বটেই, সরকারের সাথে এনজিও এবং বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয় ঘটাতে হবে। পাহাড়ি এলাকায় অবকাঠামো নির্মাণ, বসতি স্থাপন ও নগরায়নের মতো কর্মকাণ্ডে সর্বাগ্রে ও সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে পরিবেশগত মূল্যায়নকে। উন্নয়ন মানুষের জন্য। প্রকৃতি বিপন্ন হলে সে মানুষও বিপন্ন হয়ে পড়বে। তখন কোটি কোটি টাকার অবকাঠামোও কাজে আসবে না। সর্বোপরি, কর্তৃপক্ষকে সততা ও নিষ্ঠাসহকারে প্রকৃতি রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং সজাগ থাকতে হবে যাবতীয় অনিয়ম-অপচয়-দুর্নীতির বিরুদ্ধে। আরেকটা কথা, পাহাড়ধস শুধু চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের যেখানে টিলা বা অনুচ্চ পাহাড় আছে, সেখানেও ঘটে মানুষ হতাহত হতে পারে। তাই সেসব এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপত্তাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। ঝড়, বন্যা, ভাঙন, ভূমিধসের মতো বিপর্যয়ে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে যদি উদ্ধার ও ত্রাণতৎপরতা নিশ্চিত করা হয় তবে বিপর্যয় প্রতিরোধ কিংবা ক্ষতি হ্রাসের জন্য নিতে হয় স্থায়ী ব্যবস্থা, যার পেছনে থাকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। সে ক্ষেত্রে, ক্ষতিগ্রস্তদের কর্মসংস্থানসহ পুনর্বাসনের কার্যক্রম তো থাকেই, সর্বোপরি থাকে সংশ্লিষ্ট বিপর্যয়ের কারণ চিহ্নিত করে সম্ভাব্য প্রতিকারের যথাসাধ্য উদ্যোগ। এবারকার পাহাড়ধসের বেলায়ও তা মনে রাখা জরুরি। এ জন্য বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সড়ক ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মতো দূরবর্তী জনপদের নিরাপত্তাও গুরুত্ব পেতে হবে। পার্বত্য জেলা শহরের সাথে বন্দরনগরীর ঝুঁকিপূর্ণ বসতির সমস্যাও মোকাবেলা করতে হবে। পাহাড়ে ভূমিধসকে প্রকৃতির ওপর মানুষের অত্যাচারের প্রতিশোধ হিসেবে দেখছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর খান তৌহিদ ওসমান। তিনি বলেছেন, “পাহাড়ি এলাকার বন-জঙ্গল ধ্বংস করা হচ্ছে। কেটে ফেলা হচ্ছে গাছপালা। অব্যাহত রয়েছে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন। এতে করে পাহাড়ের ‘অভ্যন্তরীণ বন্ধন’ দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই দুর্বলতার কারণে কয়েক দিনের বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হুড়মুড় করে পাহাড় ভেঙে পড়েছে।” ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ বলে একটা কথা বহুল প্রচলিত। প্রকৃতি সর্বংসহা নয়। কারণ স্রষ্টা প্রকৃতিকে একটি নিয়মের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হওয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। এর ব্যতিক্রম হওয়া মানে, বিকৃতি ও অস্বাভাবিকতা। এতে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়; প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এ জন্য মানুষ দায়ী এবং এর কুফল সর্বাধিক ভোগ করতে হয় মানুষকেই। এ যেন পাপের শাস্তি। কথায় বলে Nature gives and forgives. But man gets and forgets, প্রকৃতি মানুষকে দান করে এবং রক্ষা করে। মানুষ ভোগ করে এবং প্রকৃতির এ দানের কথা ভুলে যায়। সেই অকৃতজ্ঞ (কখনোবা কৃতঘœ) মানুষকে মাঝে মাঝে শিক্ষা দেয়ার জন্য এমনকি ক্ষমাশীল প্রকৃতিকেও কঠোর ও নিষ্ঠুর হতে হচ্ছে। তবুও মানুষের বোধোদয় হবে কি? তবুও কি ‘সৃষ্টির সেরা’ মানবসন্তান পাহাড় কাটা, বৃক্ষ বিনাশ, ঢালে বসতি প্রভৃতি অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড বন্ধ করবে না ? বাংলাদেশের প্রধানত দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল পাহাড়ে পরিপূর্ণ এবং উত্তর-পূর্ব অংশে কিছু টিলা আছে। বহু দেশে পার্বত্য এলাকার পরিসর ও উচ্চতা এ দেশের চেয়ে অনেক বেশি। কোনো কোনো দেশের বেশির ভাগই পাহাড়পর্বতে ভরা। সেসব দেশ কিভাবে পাহাড়ে ভূমিধস ঠেকাচ্ছে এবং সেখানে টেকসই বসতি বা অবকাঠামো গড়ে তুলছে, তা জেনে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন শুধু নয়, পাশের ভারত আর কাছের নেপালও অনেক ক্ষেত্রে পাহাড়ি ভূমিধস নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চাইতে পারে তাদের সহযোগিতা। যথাযথ প্রস্তুতি দুর্যোগের ক্ষতি কমায়। অপ্রস্তুত থাকলে ধারণাতীত ক্ষতির শিকার হতে হয়।
রাজনীতি ও দুর্নীতি
দুর্যোগঝুঁকি হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ একজন লিখেছেন ডেইলি স্টারে। সুন্দর পাহাড় আজ ভয়াল মৃত্যুর উপত্যকা হয়ে উঠেছে। এর পেছনে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির ভূমিকা যে গুরুত্বপূর্ণ, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, Politically and socially empowered people of the society in conjunction with corrupt government officials are involved with hill graving and cutting in Bangladesh, violating the existing rules and regulations. পাহাড় কাটা এবং সেখানে পরিবেশের ক্ষতিসাধন কঠোর হস্তে দমনের জন্য তিনি আইনি পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.