কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধির পথে দেশ?

বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ করাই অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ। এখন যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, তা মূলত সরকারি বিনিয়োগ-নির্ভর। বেসরকারি বিনিয়োগ চাঙা না হওয়ায় কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। গতকাল শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণসংক্রান্ত সংলাপে বক্তারা এ কথা বলেন। রাজধানীর লেক শোর হোটেলে এই সংলাপ হয়। সংলাপে সিপিডির পক্ষ থেকে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে বলা হয়, আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে বাড়তি ৬৬ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বেসরকারি বিনিয়োগ লাগবে। অন্যদিকে সরকারি বিনিয়োগ দরকার ৫০ হাজার কোটি টাকা। সিপিডি আরও বলেছে, জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পাওয়ায় কর্মসংস্থানের গতি কমেছে। সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী প্রতিবছর গড়ে এখন ৪ লাখ ৭০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে। সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে রাজনীতিবিদ, সাবেক আমলা, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন। রেহমান সোবহান এ সময় বলেন, ‘আমাদের কোনো কর্মসংস্থান নীতি নেই। অথচ এই দেশে মানবসম্পদ হলো বড় শক্তি।’ তাঁর মতে, সরকারি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা থাকা উচিত। রেহমান সোবহান আরও বলেন, বাজেট কত বড়, বাস্তবায়ন কতটা হলো—এসব সংখ্যাতাত্ত্বিক অনুশীলন ছাড়া আর কিছুই নয়। বাজেট থেকে মানুষ কতটা সুবিধা পেল, সেটাই বড় কথা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, এর সুবিধা সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে কি না, তা দেখতে হবে।
পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে টাকার অঙ্কে কোনো বছরই বেসরকারি বিনিয়োগ কমেনি। আমাদের চেয়ে কম বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত নিয়ে অনেক দেশ এগিয়েছে। আগামী ৫ বছরে ১ কোটি মানুষ শ্রমবাজারে আসবে, ওই পাঁচ বছরে আমরা ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান করব।’ বাজেট সম্পর্কে তিনি বলেন,  সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমন কিছু বাজেটে থাকবে না। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। অর্থ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, ‘গ্রামগঞ্জে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে, আমরা তা দেখছি না। কৃষক যে ট্রাক্টর কিনছে, তা-ও একধরনের বিনিয়োগ।’ বাজেটের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা ঝুঁকিবাজ সরকার। হিসাব করেই বাজেটের লক্ষ্যগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে।’ সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেই। এ দেশে ব্যবসায় খরচ বেশি, আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে আগ্রহী নন। বর্তমান সরকার মানবসম্পদে বিনিয়োগ না করে মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগের সুবিধা হলো ৮ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু ২৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে। এটি শুধু সরকারি অর্থের অপচয় নয়, দুর্নীতিকেও উৎসাহিত করে। অর্থনীতিতে তিন ধরনের সমস্যা আছে বলে মনে করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের উদ্ধৃতিকে উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একটি ইঞ্জিন দিয়ে উড়োজাহাজ চলার মতো অবস্থায় আছে। সরকারি বিনিয়োগ-নির্ভর প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ছে না। কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধির একটি পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছি কি না, সেটা দেখতে হবে। অপর দুটি সমস্যা হলো প্রতিষ্ঠানের সংস্কার ও নীতি সংস্কারের অভাব এবং বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা কম।’ সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইনের কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। সরবরাহ পর্যায়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস, ইন্টারনেট সেবা, রেস্তোরাঁ, ব্র্যান্ডের পোশাক কিনতে খরচ বাড়তে পারে। আমদানি পর্যায়ে জ্বালানি তেল, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেলের আমদানি ব্যয় বাড়বে, যা ভোক্তার ওপর পড়বে। নতুন মূসক আইন সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, ভ্যাট হলো অত্যন্ত হিসাবনির্ভর ব্যবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশের বহু কারখানা অশিক্ষিত লোকদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তাঁদের ভ্যাটের হিসাব রাখার সক্ষমতা নেই। তিনি বলেন, নিয়মানুযায়ী আবগারি শুল্ক থাকলে ভ্যাট থাকবে না। বাংলাদেশে দুটোই আছে। সরকার আবগারি শুল্ক উঠিয়ে  ব্যাংক সেবার ওপর ভ্যাট বসাতে পারে। বাজেট প্রণয়ন পদ্ধতির সমালোচনা করে এই সাবেক অর্থ উপদেষ্টা বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বাজেট তৈরি হয়। সেখানে সাংসদদের কোনো ভূমিকা থাকে না। এটি বাজেটের বড় দুর্বলতা। বাজেট নিয়েও সাংসদেরা খুব বেশি আলোচনা করেন না। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। এ ছাড়া বক্তব্য দেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য জাহাঙ্গীর হোসেন, বিলুপ্ত বেসরকারীকরণ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম, মেঘনা ব্যাংকের এমডি নুরুল আমিন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.