শিক্ষা-বিশ্ববিদ্যালয় যখন গ্র্যাজুয়েট তৈরির কারখানা by ফজলুল হালিম রানা

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে প্রত্যাশা থাকবে, অতি দ্রুত নামসর্বস্ব এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক_ যাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হয় এবং প্রকৃত উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে এ দেশের সন্তানরা বঞ্চিত না হয় ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের নগরী।


তবে এখন এই ঢাকার ধানমণ্ডি-বনানী কিংবা উত্তরায় যদি কোনো আগন্তুকের দৃষ্টি যায় তাহলে তিনি ধরে নেবেন ঢাকা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নগরী। এ এক আজব কাণ্ড! যেখানে-সেখানে যত্রতত্র নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এগুলো দেখা বা তদারক করার কেউ নেই। গত ৪ মার্চ প্রাইম এশিয়া এবং সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির মধ্যকার কয়েক ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ আমাদের তা-ই মনে করিয়ে দেয়। এ সংঘর্ষের ঘটনায় পথচারীসহ আহতের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। ওই ঘটনায় ছাত্ররা ভাংচুর করে নিরপরাধ মানুষের গাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ঘটনার পর যখন কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ দিয়ে এলাম তখন মনে হলো, যুদ্ধ-উত্তর ইরাক কিংবা আফগানের রাজপথ পাড়ি দিয়ে এসেছি।
পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বক্তব্য একই ধরনের_ তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে এ সংঘাত বা সংঘর্ষ। ওই তুচ্ছ ঘটনার ব্যাপারে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতি আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অভিযোগ, পাল্টা-পাল্টি। তা হলো, কতিপয় ছাত্র মাদক নিচ্ছিল এবং ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করছিল। ঘটনার বাস্তবতায় পুলিশ গুলশান থানায় দুই হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ আমাদের দেশের পুরনো রেওয়াজ।
সে যাই হোক। অবাক হলাম যখন দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় মাদক সেবন এবং ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনাকে উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষই তুচ্ছ বলছে। বাহ! বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক সেবন, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা_ এগুলো তুচ্ছ ঘটনা? এ কর্তৃপক্ষের কর্তৃপক্ষ কারা তা আমি জানি না। তবে যা জানি তা হলো, এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার স্তরে স্তরে এত অন্যায় জমা হয়ে আছে যে, অচিরেই প্রতিকার না করলে এর নৈতিক ভিত্তিটাই ধসে পড়বে। আমাদের মনে রাখা উচিত, কেবল ইন্টেলেকচুয়াল প্রয়োজন মেটানোর জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠেনি। মনুষ্যত্বের চাহিদাও মেটাতে হবে। কর্তৃপক্ষ নামধারী মানুষ হিসেবে যে খাটো মানুষজন রয়েছে তারা কীভাবে মানুষের সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে? আর এ মানুষ করার কথাটিও ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্গত ছিল এবং প্রায়ই শোনা যেত। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে মানুষ হওয়ার সম্পর্ক এখন আর প্রায় কানে বাজে না।
এখন শিক্ষার আদি উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে জীবিকা অর্জন সংযুক্ত হয়েছে। আমরা যখন ইউরোপ থেকে আমাদের আধুনিক শিক্ষা ভারতীয় উপমহাদেশে আমদানি করি তখন বিলেতের ডাক্তার আর্নল্ড প্রমুখ প্রধান শিক্ষক বিদ্যা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্যত্বের যে গুরুত্ব দেন, বাংলার রাজনারায়ণ বসু, রামতনু লাহিড়ী প্রমুখ প্রধান শিক্ষক তথা অধ্যাপকরাও সেই একই গুরুত্ব দেন। আধুনিক শিক্ষা বিদেশ থেকে আমদানি করার সময় কিছু পরিমাণে মনুষ্যত্বও আমদানি করা হয়েছিল। উপমহাদেশের অন্যান্য দু'একটি দেশ এর কিঞ্চিৎ ধরে রাখতে পারলেও বাংলাদেশ নিয়ে শঙ্কিত হতে হয়। না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এমন নিরপরাধ মানুষের গাড়ি ভাংচুর করতে পারে না!
আমাদের দেশে পঞ্চাশের অধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং গত ১৪ মার্চের পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী নতুন করে অনুমোদন পেল আরও ৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এ ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা উদ্যোক্তা, আমার বিশ্বাস_ তাদের মধ্যেও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করবে। তবে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬১টি শাখা রয়েছে আমাদের দেশে। অবাক ব্যাপার হলো, বিদেশি এ বিশ্ববিদ্যালয় শাখাগুলোর শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কোনো অনুমোদন নেই। তার মানে, আইন অনুযায়ী এগুলো সম্পূর্ণ অবৈধ। আমি কখনোই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে নই। কারণ আমাদের দেশের এ উচ্চশিক্ষা যখন আমরা ইউরোপকে অনুকরণ করে নিয়ে আসি তখন ইউরোপের পরিকল্পিত ওই শিক্ষা ব্যবস্থা উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের ছেলেদের জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারপর যখন ভারতে প্রবর্তিত হয় তখনও তেমনি উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ঘরের নির্দিষ্টসংখ্যক ছাত্রের জন্যই ছিল। কেউ তখন কল্পনা করতে পারেনি স্কুল-কলেজের সংখ্যা ও ছাত্রসংখ্যা কম সময়ে এত বেড়ে যাবে। এমনকি গত শতাব্দীর গোড়ার দিকেও তা কেউ ভাবতে পারেনি।
স্যার আশুতোষ তার গ্র্যাজুয়েট তৈরির কারখানায় যে ওভার প্রডাকশন ঘটান সে জন্য অনেকে সেই সময় তাকে নিন্দা করেন। কিন্তু সময় বদলেছে, জনসংখ্যা বেড়েছে, সঙ্গে ছাত্রসংখ্যাও বেড়েছে। কাজেই প্রয়োজনের খাতিরেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতার সুযোগ নেই। তাছাড়া আমাদের দেশে যে কয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে তাতে প্রতি বছর এইচএসসি পাস করা এ দেশের মেধাবী সন্তানদের আমরা ভর্তির সুযোগ দিতে পারি না। এখন সময়ের প্রয়োজনেও দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠবে_ এটিই স্বভাবিক। সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষার মান যথাযথ হলে তা সরকারি, কি বেসরকারি হোক_ সে প্রশ্ন বড় নয়। আমেরিকার হার্ভার্ড এবং রাসেল গ্রুপের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ পৃথিবীর নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ই বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে প্রতিষ্ঠিত এবং সেগুলো বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে আছে।
আমাদের দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই যে নামসর্বস্ব তা নয়। আমরা জানি, এগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে। কিন্তু মুশকিল হলো, এগুলোর পাশাপাশি সাইনবোর্ডসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয় নামে কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সেগুলো শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে রীতিমতো ব্যবসা করে যাচ্ছে। গড্ডলিকার মতো ছেলেমেয়েরাও ছুটছে সেখানে। জানে বেকার হবে, কোথাও পাত্তা পাবে না। তবুও একটি সার্টিফিকেট বা একটি ডিগ্রি তাদের চাই। আর কিছু না হোক, সমাজে তো মান বাড়বে। লোকে তো শিক্ষিত বলে সমীহ করবে। পড়াশোনা শেষ না করলেও তো মানুষের কাছে বলা যাবে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম।
এই তথাকথিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির কথা শুনলে আঁতকে উঠতে হয়। এগুলো না দিচ্ছে গরিব-মেধাবী ছেলেমেয়েদের স্কলারশিপ, না দিচ্ছে একটি মানসম্মত বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষা সহায়ক সুযোগ-সুবিধা। তাছাড়া এর অধিকাংশের শিক্ষার মান, পঠন ও পাঠন পদ্ধতি এক কথায় বলতে গেলে নমঃ নমঃ। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, 'ছাত্র-শিক্ষক সবার সনদই জাল!' শিরোনামে গত ৯ মার্চ সমকালের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়। ওই সংবাদে দেখা যায়, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম ট্রেনিংয়ের ছাত্র এবং শিক্ষক_ উভয়ের সনদই জাল। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের তদন্তে ধরা পড়ে বিষয়টি। দেখা যায়, ওই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টাকার বিনিময়ে সনদ বিক্রি করে! এই হচ্ছে হাল অবস্থা।
ইউজিসির তথ্যমতে, এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাত্র ১১টির নিজস্ব ক্যাম্পাস থাকলেও অন্যগুলোর নেই। সেগুলো ভাড়া বাড়িতে ক্যাম্পাস খুলে বসেছে এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক্ষেত্রে ঢাকার আবাসিক এলাকা বেছে নিয়েছে। আধা কিলোমিটারের মধ্যে বহু বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। এর চেয়েও দুঃখজনক হলো, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই বিল্ডিংয়ে কিংবা পাশাপাশি বিল্ডিংয়ে রয়েছে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এ কারণেই ঘটে গত ৪ মার্চের ঘটনা। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুরু থেকেই নিয়মনীতির উপেক্ষা করে আসছিল। আমরা যেটি বাস্তবে দেখছি তা হলো, অনেকের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা থাকলেও সেগুলো এ বিষয়ে গড়িমসি করছে এবং কোনো না কোনোভাবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে টালবাহানা করে টিকে আছে। মূলত একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী শিক্ষাকে পণ্য করে কোচিং সেন্টারের মতো এ ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছে। ফলে বিঘি্নত হচ্ছে উচ্চশিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে প্রত্যাশা থাকবে, অতি দ্রুত নামসর্বস্ব এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক_ যাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হয় এবং প্রকৃত উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে এ দেশের সন্তানরা বঞ্চিত না হয়। তা না করা গেলে এভাবেই হয়তো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নিপীড়নের মতো ঘটনায়ও এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ লঘু অপরাধ বলে চালিয়ে দেবে_ যেটি খুবই দুঃখজনক।

ফজলুল হালিম রানা : শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
redpen_ju@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.