বোনের ভালো চাই, মায়ের তো বটেই by ড. তুহিন ওয়াদুদ

নারী উন্নয়ন নীতিমালা যুগোপযোগী হয়েছে' শিরোনামে গত ১২ মার্চ কালের কণ্ঠে পাঠকদের মতামতভিত্তিক একটি বিশেষ পৃষ্ঠা প্রকাশিত হয়। সেখানে নারী উন্নয়ন নীতিমালা নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার পাঠকের মতামত স্থান পেয়েছে। মতামতগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পক্ষে ও বিপক্ষে উভয় ধরনের মতামত সেখানে আছে।


এমনকি নারীরা অনেকে যে নিজেদের অধিকারের বিপক্ষে কথা বলেন, তারও প্রমাণ সেখানে আছে। লেখাটি পড়তে পড়তে মনে পড়ল রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন একদিন বাঙালি নারীদের বিজ্ঞানমনস্ক এবং যুক্তিবাদী করে গড়ে তোলার জন্য সাখাওয়াৎ গার্লস মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই স্কুলটির শতবর্ষ হলো। সেই সময়ের সঙ্গে এই সময়ের পার্থক্য কম নয়। গত ১৬ মার্চ সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদ্যাপিত হলো। এখনকার দিনে মেয়েদের লেখাপড়ার অনুকূল পরিবেশ থাকলেও তখনকার দিনে তা সহজ ছিল না। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের স্বামী সাখাওয়াৎ হোসেন মৃত্যুর আগে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর শিক্ষানুরাগী রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন স্বামীর নামে ১ অক্টোবর ১৯০৯ স্বামীর বাড়ি বিহারের ভাগলপুরে মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু পরিবারের অন্য শরিকদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় কয়েক মাস পরই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিয়ে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার তালতলায় অলিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে দুটি বেঞ্চে দুটি কক্ষে আটজন ছাত্রী নিয়ে পুনরায় সাখাওয়াৎ গার্লস মেমোরিয়াল স্কুলের যাত্রা শুরু হয়।
স্কুলটির ছাত্রীসংখ্যা বাড়তে থকে। প্রয়োজন হয় বৃহৎ পরিসরের। প্রয়োজনের তাগিদে স্কুলটি স্থানান্তরিত হয় ইউরোপিয়ান অ্যাসাইলাম লেনে। সেখান থেকে লোয়ার সার্কুলার রোডে এবং শেষ পর্যন্ত ৯ নম্বর লর্ড সিংহ রোডে। বর্তমানে কয়েক হাজার ছাত্রী এখানে লেখাপড়া করছে। সরকার স্কুলটিকে সরকারি করেছে। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালি নারীদের অবরুদ্ধ জীবন যাপন করতে হতো। পাশ্চাত্য প্রভাবে হিন্দু সমাজে নারীদের শিক্ষাচর্চায় আগেই এগিয়ে আসতে দেখা যায়। ১৮২৯ সালে রামমোহন রায় সহমরণ প্রথা বন্ধে আইনকরণে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৮৫৬ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের তৎপরতায় বিধবা বিবাহ আইন করা হয়। রামমোহন রায় কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে সে কারণে সমাজের শ্যেন দৃষ্টির মধ্যে পড়তে হয়েছিল। মধ্যযুগের মুসলমানরা বাংলা চর্চা করত না। মতবাদের অসারতা উপলব্ধি করে একসময় তাদের সে মতিভ্রম দূর হয়। কবি আবদুল হাকিম মধ্যযুগে তাই যথার্থই বলেছিলেন, 'যে জন বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।' এরপর মুসলমানরা বলতে শুরু করল, ইংরেজি পড়া যাবে না। ইংরেজি খ্রিস্টানদের ভাষা। পরবর্তী সময়ে সেই মতিভ্রমও দূর হয়। নারীদের গৃহের বাইরে বের হওয়াকে পাপ বলে গণ্য হতো। প্রতিবারই মুসলমানদের কাছে ধর্মের দোহাই ছিল বড় হাতিয়ার। হিন্দু নারীদের শিক্ষিত করে স্বাধীনতা দিতে রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কৃষ্ণ ভাবিনী দাস কিংবা লক্ষ্মীমণি দেবী এগিয়ে এসেছিলেন। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন বাঙালি নারীদের মুক্ত করতে এগিয়ে এসেছিলেন। রোকেয়া প্রদর্শিত পথে বাংলার নারীরা হেঁটেছে এবং হাঁটছে। নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ নিয়ে বাংলাদেশে যুগোপযোগী আইনের বিরুদ্ধে কেউ কেউ সোচ্চার হয়েছে। ৪ এপ্রিল এ নীতিমালার বিপক্ষে তারা হরতাল পালন করেছে। ধর্ম আমাদের কাছে সব সময়ই মানবকল্যাণের পক্ষে বলেই মনে করি। ধর্মের মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকার কথা নয়। ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময় ধর্মের অজুহাতে কখনো বাংলা ভাষার প্রতি, কখনো ইংরেজি ভাষার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, ধর্মান্ধদের সেটা একটা অপচেষ্টা ছিল। সময় তার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। খুবই অবাক হওয়ার ব্যাপার যে অনেক নারীও চান না নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১-এর মাধ্যমে তাঁদের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। একটি রাষ্ট্র দেশের সব জনগণকে সমানাধিকার দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে_এটি প্রশংসার যোগ্য। অতীতেও অনেক নতুন বিষয়ের অবতারণা হতে দেখে কারো কারো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে। প্রথাগত চিন্তাচেতনায় আস্থাহেতু নারীদের সম-অধিকার আমাদের অনেকের সহ্য হচ্ছে না। সময়ের ব্যবধানে একদিন সমানাধিকারে আমরা অভ্যস্ত হব। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন যখন প্রথম সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল চালু করেন তখন তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি যে পঁাঁচজন ছাত্রীকে একজন শিক্ষক কিভাবে পড়াবেন। অনেক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি যে মিটিমিটি আলোক শিখাটি জ্বালিয়েছিলেন, তা পর্যায়ক্রমে সারা বাংলার মুসলমান নারীদের চিত্তে নক্ষত্রের মতো জ্বলে ওঠে। যে মুসলমান বাংলা পড়তে চায়নি তারা বাংলা পড়েছে, যে মুসলমান ইংরেজির প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েছে তারা আবার ইংরেজির প্রতি যত্নবান হয়েছে, যারা আজ নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১-এর বিরোধিতা করছে তারাই একদিন এই নীতিমালাকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেবে। কারণ যে বাঙালি নারীদের জন্য নারী উন্নয়ন নীতিমালা_তারা কেউ আমার বোন, কেউ আমার মা। বোনের ভালো চাই, মায়ের তো বটেই।
লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ,
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

No comments

Powered by Blogger.