সাকার অভিযোগ গঠনের আদেশ ২৭ মার্চ-সিরাজুদ্দীন হোসেন হত্যায় মুজাহিদ জড়িত

একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর গভীর রাতে সাত-আটজন রাইফেলধারী যুবক রাজধানীর চামেলীবাগে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের বাসায় যায়। তাঁরা সিরাজুদ্দীনকে শনাক্ত করে একটি মিনিবাসে তুলে নিয়ে যান। তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমনকি লাশও পাওয়া যায়নি।

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের নিয়ন্ত্রণে ও পরিচালনায় ওই ঘটনা ঘটে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গতকাল মঙ্গলবার মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযোগ উপস্থাপনকালে রাষ্ট্রপক্ষ এ তথ্য জানায়। রাষ্ট্রপক্ষ বলে, একাত্তরে দৈনিক ইত্তেফাক-এর নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’ শীর্ষক একটি লেখা লিখেন। ১৬ সেপ্টেম্বর জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এ ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ শীর্ষক আরেকটি লেখায় সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ‘ভারতের দালাল’ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতিকারী’ উল্লেখ করা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিষয়ে সোচ্চার সিরাজুদ্দীন অনেক দিন থেকেই জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন।
সকালে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে দুই সদস্যের ট্রাইব্যুনালের (এক সদস্য অনুপস্থিত ছিলেন) কার্যক্রম শুরু হলে মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোখলেসুর রহমান ও রানা দাসগুপ্ত।
অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের মে মাসের এক ভোরবেলায় মুজাহিদ ৮-১০ জন রাজাকারসহ পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের বৈদ্যডাঙ্গি, মাঝিডাঙ্গি ও বালাডাঙ্গি নামের তিনটি হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রাম তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেন। তাঁরা সেখানে তিন শ থেকে সাড়ে তিন শ ঘর জ্বালিয়ে দেন এবং ৫০-৬০ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করেন। ওই গণহত্যায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২১ জনের নাম-পরিচয়সহ তালিকা আনুষ্ঠানিক অভিযোগে উল্লেখ আছে।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বলেন, একাত্তরের ৩০ আগস্ট রাত আটটার দিকে রাজধানীর নাখালপাড়ায় পুরাতন এমপি হোস্টেলে স্থাপিত সেনাক্যাম্পে যান মুজাহিদ ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী। সেখানে আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, রুমী (শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছেলে), আজাদ, বদিউল আলম ও জুয়েলকে দেখে তাঁরা গালিগালাজ করেন। রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাঁদের হত্যা করার জন্য তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের পরামর্শ দেন।
অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে একদিন বেলা ১১টার দিকে ফরিদপুরের খাবাসপুর মসজিদ এলাকা থেকে গোয়ালচামট গ্রামের (রথখোলা) রণজিত নাথকে আটক করে রাজাকাররা। তাঁকে ফরিদপুরের পুরাতন সার্কিট হাউসে অবস্থানকারী মুজাহিদ ও পাকিস্তানি মেজর আকরাম কোরাইশীর সামনে হাজির করা হয়। রণজিতকে সেখানে আটক রেখে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। এতে তাঁর দাঁত পড়ে যায়। পরে রণজিতকে রশিদ মিয়ার বাড়িতে আটক রাখা হলে তিনি রাতের বেলা জানালার শিক বাঁকিয়ে পালিয়ে যান।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বলেন, একাত্তরের ২৬ জুলাই স্থানীয় রাজাকাররা আবু ইউসুফ নামের এক ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে ধরে আলফাডাঙ্গা থেকে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। মুজাহিদ ওই ক্যাম্পে গিয়ে এক পাকিস্তানি মেজরকে কিছু বলার পরে ইউসুফের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। তাঁকে সেখানে এক মাস তিন দিন আটক রেখে নির্যাতনের পর যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নির্যাতনে ইউসুফের বুক ও পিঠের হাড় ভেঙে যায়।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ১৪ আগস্ট বেলা একটার দিকে মুজাহিদ কয়েকজন রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার এ কে এম হাবিবুল হককে হত্যার জন্য তাঁর বাড়িতে হামলা চালান। হাবিবুল বাড়ি থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন।
উপস্থাপিত অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরে রাজধানীর ফকিরাপুলের গরম পানির গলিতে ফিরোজ মেম্বারের বাড়িতে রাজাকার ক্যাম্প ছিল। এপ্রিলে শান্তি কমিটি গঠনের পর সেখানে কার্যালয় বসানো ও রাজাকারদের নিয়োগ দেওয়া হয়। মুজাহিদ নিয়মিত সেখানে যাতায়াত করতেন এবং সেখান থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটন করা হতো।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল জানতে চান, সেখানে যাতায়াত করা কেন অপরাধ হবে? জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি রানা দাসগুপ্ত বলেন, মুজাহিদ ওই রাজাকার ক্যাম্পে গিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটনের নির্দেশ দিতেন এবং সে অনুসারে সারা দেশে আলবদর বাহিনী, রাজাকাররা অপরাধ ঘটাত। সাক্ষীদের জবানবন্দিতে এ বিষয়গুলো আছে।
অভিযোগে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আরও বলেন, একাত্তরে মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে শারীরিক শিক্ষা কলেজ) পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল। পরে রাজাকার ও আলবদর গঠিত হওয়ার পর তারাও সেখানে ক্যাম্প বসায়। মুজাহিদ ও নিজামী সেখানে নিয়মিত যাতায়াত এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও পরামর্শ করতেন। ওই ক্যাম্প থেকেই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।
এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কথা বলা হলেও কারও নাম সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড একটি স্পর্শকাতর বিষয়। কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই।
রানা দাসগুপ্ত বলেন, সাক্ষীদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এগুলো বেরিয়ে আসবে। পরে তিনি বলেন, শহীদুল্লা কায়সার, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, রাশিদুল হাসান, আবুল খায়ের, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন, ডা. মুর্তজা প্রমুখ বুদ্ধিজীবীর নাম সাক্ষীদের জবানবন্দিতে আছে।
অভিযোগের সঙ্গে মুজাহিদের মুক্তিযুদ্ধকালে দেওয়া বক্তব্য ও বিবৃতি সংযুক্ত করা হয়। এসবের মাধ্যমে তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে প্ররোচনা দিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রসংঘের সমাবেশে, সংবাদপত্রের বিবৃতিতে এবং লেখায় মুজাহিদ ওই প্ররোচনা ও উসকানি দেন। ১৯৭১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রাম-এ মুজাহিদের নামে লেখা ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র, যুক্তি নয়’ শীর্ষক প্রবন্ধের মাধ্যমে মুক্তিকামী বাঙালিকে নিশ্চিহ্নের প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা টাউন হলের এক সমাবেশে তিনি বলেন, ছাত্রসংঘের একজন কর্মী জীবিত থাকতেও পাকিস্তানকে ভাঙতে দেওয়া হবে না। দরকার হলে তাঁরা সীমান্তে গিয়ে অস্ত্র ধারণ করবে। ৭ নভেম্বর বিকেলে বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে ছাত্রসংঘের গণজমায়েতে মুজাহিদ বলেন, আর কোনো হিন্দু লেখকের লেখা বই প্রচার, বিক্রি বা পড়া যাবে না। রাষ্ট্রপক্ষ বলে, এসব বক্তব্যের মাধ্যমে মুজাহিদ মুক্তিকামী বাঙালির বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণার সৃষ্টি করেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ উপস্থাপন ও অভিযোগ গঠনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষ হলে ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের জন্য ২২ মার্চ দিন ধার্য করেন।
সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে আদেশ ২৭ মার্চ: বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযোগ গঠন করা হবে কি না, এ বিষয়ে আদেশের জন্য ২৭ মার্চ দিন পুনর্নির্ধারণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। গতকাল ট্রাইব্যুনালের এক সদস্য অনুপস্থিত থাকায় আদেশের দিন পুনর্নির্ধারণ করা হয়। ট্রাইব্যুনাল বলেন, এক সদস্যের অনুপস্থিতিতে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল সব সদস্যের উপস্থিতিতে এ আদেশ দিতে চান।

No comments

Powered by Blogger.