৩৬৪ দিনের নতুন ক্যালেন্ডার by ড. আবু এন এম ওয়াহিদ

এমন কী ভাবতে পারেন, আপনার জন্মদিন প্রতিবছর ঘুরেফিরে একই দিনে একই বারে পড়বে? অর্থাৎ দিবসটি যদি হয় ৩০ ডিসেম্বর শুক্রবার, আজীবন আপনি ৩০ ডিসেম্বর শুক্রবারেই আপনার জন্মদিন পালন করতে পারবেন। একইভাবে, ভাবতে পারেন আপনার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রিয়জনের জন্মদিন প্রতিবছর একই বারে বা দিনে


পড়বে? কেমন হবে, আরো যদি বলি প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ এবং ১৬ ডিসেম্বর একই দিনে উদযাপন করা সম্ভব হবে। এ যদি সম্ভব হয়, তাহলে নিশ্চয়ই আপনি আপনার প্রিয় দিবসগুলো পালনের আগাম পরিকল্পনায় কিছু বাড়তি সুবিধা পাবেন। অদূর ভবিষ্যতে এমনি একটি সুযোগ সবার দুয়ারে এসে টোকা দিতে পারে। এত দিন সেটা কল্পনাবিলাস বলে মনে হলেও এখন আর সেটা কল্পনা নয়। বর্তমানে এটি একটি বাস্তব সম্ভাবনার বিষয়। গত ২৮ ডিসেম্বর মেলিসা গ্রে নামে সিএনএনের এক রিপোর্টার ইন্টারনেটে একটি সাড়া জাগানো সংবাদ পোস্ট করেছেন। খবরে বলা হয়েছে, আমেরিকার নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন কৃতী অধ্যাপক (অ্যাস্ট্রোফিজিঙ্রে অধ্যাপক রিচার্ড কন হেনরি এবং ফলিত অর্থনীতির অধ্যাপক স্টিভ হ্যাঙ্কে) দীর্ঘদিন গবেষণার পর বিশ্ববাসীর জন্য একটি অভিনব বিকল্প ক্যালেন্ডার আবিষ্কার করেছেন। এই ক্যালেন্ডার হবে যথারীতি ১২ মাসের, কিন্তু বছরে ৩৬৫ দিনের পরিবর্তে থাকবে ৩৬৪ দিন। চতুর্থ বর্ষের লিপইয়ার সম্পূর্ণরূপে তুলে দেওয়া হবে এবং প্রতি পঞ্চম কি ষষ্ঠ বর্ষে পূর্ণ এক সপ্তাহ যোগ করা হবে, অর্থাৎ সেই বছরটি হবে ৩৭১ দিন লম্বা। প্রতিটি তারিখের সঙ্গে প্রতিটি বারের সমলয় বা সঙ্কালিকতা (সিনক্রোনাইজেশন) নিশ্চিত করা হবে এবং এটিই হবে এই ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। এর ফলে প্রতিবছর পহেলা জানুয়ারিতে পুরনো ক্যালেন্ডার ফেলে দিয়ে ঘরের দেয়ালে নতুন ক্যালেন্ডার কিনে এনে টাঙাতে হবে না। ফিবছর একই ক্যালেন্ডার সর্বজনীনভাবে ব্যবহার করা যাবে।
বিশ্বব্যাপী ক্যালেন্ডারের ডিজাইন, কাগজ, ছাপা, বিপণন, ইত্যাদি বাবদ সাশ্রয় হবে কোটি কোটি টাকা। উদ্যাপনের জন্য মানুষজন তাদের প্রিয় বিভিন্ন দিবস এবং ইভেন্ট অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করতে পারবে তাতেও যাতায়াত এবং কেনাকাটা বাবদ বেঁচে যাবে কাড়ি কাড়ি টাকা। অধ্যাপক হেনরি এবং হ্যাঙ্কে আরো দাবি করেছেন এতে করে স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক প্রোগ্রাম তৈরিতে এবং ব্যাংক-বীমাসহ যাবতীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের লেনদেন ও হিসাব-নিকাশে পাবে অনেক বাড়তি সুবিধা। এই নতুন ক্যালেন্ডারে আট মাস হবে ৩০ দিনের এবং বাকি চার মাস হবে ৩১ দিনের। এখনকার ফেব্রুয়ারির মতো ২৮-২৯ দিনে আর কোনো মাস থাকবে না। জানুয়ারি শুরু হবে ৩০ দিন নিয়ে। প্রতি দুই মাস পর পর তৃতীয় মাস হবে ৩১ দিনে। অর্থাৎ জানুয়ারি ৩০ দিন, ফেব্রুয়ারি ৩০ দিন, মার্চ ৩১ দিন, এপ্রিল ৩০ দিন, মে ৩০ দিন, জুন ৩১ দিন, জুলাই ৩০ দিন, আগস্ট ৩০ দিন, সেপ্টেম্বর ৩১ দিন, অক্টোবর ৩০ দিন, নভেম্বর ৩০ দিন, ডিসেম্বর ৩১ দিন। এ নিয়ে বছর হবে সর্বমোট ৩৬৪ দিন নিয়ে।
অধ্যাপক হেনরি এবং হ্যাঙ্কের এই ক্যালেন্ডার একেবারে যে এক নতুন জিনিস তা কিন্তু নয়। এর আগেও কেউ কেউ বিকল্প ক্যালেন্ডারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন; কিন্তু সেগুলো বিশ্ব সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তবে হেনরি-হ্যাঙ্কের ক্যালেন্ডার ভিন্ন এবং এটা ভালোভাবে গৃহীত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস। কারণ ইতিপূর্বে প্রস্তাবিত বিকল্প ক্যালেন্ডারের চেয়ে হেনরি-হ্যাঙ্কের এই ক্যালেন্ডার নিঃসন্দেহে অনেক উত্তম। ওইগুলো দিন-তারিখের জটিল হিসাব মেলাতে গিয়ে সাত দিনের সাপ্তাহিক সাইকেলকে ভাঙতে বাধ্য হয়েছিল, কিন্তু হেনরি এবং হ্যাঙ্কেকে তা করতে হয়নি। তাঁরা সফলতার সঙ্গে এমনভাবে দিন, বার, ও তারিখের হিসাব এবং লয় মিলিয়েছেন, যাতে করে তাঁরা সহজেই সাত দিনের সাপ্তাহিক সাইকেলকে অটুট রাখতে পেরেছেন। সাত দিনের সপ্তাহিক সাইকেল না ভাঙার কারণে ইহুদি সম্প্রদায়ের সপ্তাহিক ধর্মীয় পবিত্র দিন সাবাথ সংক্রান্ত ফোর্থ কমান্ডমেন্টের কোনো ব্যত্যয় হবে না। পশ্চিমা বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতার জন্য এটা একটা মূল্যবান উপাদান যা হেনরি-হ্যাঙ্কের ক্যালেন্ডার সহজভাবেই ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। কয়েক বছর আগে হেনরির মাথায় এই নতুন ক্যালেন্ডারের আইডিয়া আসে। এ ব্যাপারে তাঁর গবেষণাকাজ বেশ কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর তিনি হ্যাঙ্কেকে সঙ্গে নেন এর অর্থনৈতিক তাৎপর্য এবং নিহিতার্থ বোঝার জন্য। প্রথম দিকে তাঁর কাছে এটা অনেক কঠিন একটি কাজ বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু তিনি কোনো অবস্থাতেই হাল ছাড়েননি। দীর্ঘদিন ধৈর্য ধরে এর সঙ্গে লেগেছিলেন। বারবার কসরত করার পর অবশেষে সাফল্য এসে তাঁকে ধরা দেয়। এখন তাঁরা দুজনই এই বিরল কৃতিত্বের দাবিদার। এই নতুন ক্যালেন্ডার ব্যবহারের ফলে হিসাব-নিকাশে অনেক সংশয় এবং অযাচিত জটিলতা দূর হবে। আর্থিক জগতের সুদের হিসাব-নিকাশ অনেক সোজা হয়ে যাবে। স্কুল-কলেজকে প্রতিবছর নতুন করে একাডেমিক ক্যালেন্ডার ডিজাইন করতে এবং ছাপাতে হবে না। প্রস্তাবিত এই নতুন ক্যালেন্ডার খেলোয়াড়দের জন্যও বয়ে আনবে সুখবর। তাঁরা ফিবছর একই ক্যালেন্ডার ধরে একই সময়ে প্র্যাকটিস করতে পারবেন এবং সব টুর্নামেন্ট একই টাইম স্কেজুলে বছরের পর বছর ধরে খেলতে পারবেন।
একসময় হ্যাঙ্কে বিশ্বব্যাপী কারেন্সি রিফর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ থেকে তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে বলছেন, ১৯৯১ এবং ১৯৯৯ সালে যথাক্রমে আর্জেন্টিনা এবং মন্টেনিগ্রোতে লোকজন কারেন্সি রিফর্মে প্রথমে ঘোর আপত্তি জানিয়েছিল, কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারল আসলে কারেন্সি রিফর্মের ফলে প্রথমে সামান্য একটু অসুবিধা হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর সুবিধা অনেক বেশি তখন তারা রিফর্ম প্রস্তাবে রাজি হলো। এই নতুন ক্যালেন্ডারের ব্যাপারে তিনি একই রকম আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। হ্যাঙ্কে বলছেন তাঁরা যদি, তাঁদের হিসাব ঠিক দেখাতে পারেন এবং দুনিয়াব্যাপী মানুষজনকে এর সুফল বোঝাতে পারেন তবে দুদিন আগে হোক আর পরে হোক পৃথিবীর লোকজন তাঁদের এই নতুন বিকল্প ক্যালেন্ডার সাদরে গ্রহণ করবে। নতুন বিকল্প ক্যালেন্ডারের সঙ্গে অধ্যাপক হেনরি এবং হ্যাঙ্কে আরেকটি যুগান্তকারী প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁরা সারা পৃথিবীর ২৪টি টাইম জোনকে ভেঙে একাকার করে এক সর্বজনীন নতুন টাইম জোনের ধারণা পেশ করেছেন। এর ফলে তাঁদের মতে, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় দিনের বিভিন্ন সময় হবে বটে, অর্থাৎ কোনো বিশেষ সময়ে কোথাও হয়তোবা হবে দিন, কোথাওবা রাত, কোথাও সকাল, কোথাওবা আবার সন্ধ্যা হবে; কিন্তু সবার ঘড়িতে যেকোনো মুহূর্তে একই সময় দেখাবে। এতে করে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের লেনদেনে পাওয়া যাবে বেশ কিছু অতিরিক্ত সুবিধা। ইউনিভার্সাল টাইমের ব্যাপারে হ্যাঙ্কে বলছেন, অনেক দিন ধরে এয়ারলাইনস পাইলটরা সময়ের সব ভেদাভেদ ভুলে গ্রিনিচমান সময়কে এক সর্বজনীন সময় হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। সুবিধা আছে বলেই তাঁরা তা করছেন। তবে এয়ারলাইনস পাইলটদের কথা বাদ দিলেও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একক টাইম জোন কী সুবিধা এনে দেবে সেটা অবশ্য এই দুই বিজ্ঞানী সাধারণ মানুষের জন্য খোলাসা করে বলেননি। কারণ, সব সময় সবার ঘড়িতে একই সময় দেখাবে বটে; কিন্তু বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় যখন সকাল ১০টা তখন সেনেগালের রাজধানী ডাকারে সকাল ১০টা না বিকেল ১০টা, না রাত ১০টা, লোকজন তা বুঝবে কিভাবে? সেই তো ম্যাপ, গ্লোব, এবং ভূগোলবিদ্যাকে আওড়াতে হবে। তবে আশা করা যায়, নতুন টাইমজোনের উদ্ভাবকদের কাছ থেকে এর একটি সঠিক ব্যাখ্যা শিগগিরই পাওয়া যাবে।
লেখক : অধ্যাপক টেনেসি স্টেইট ইউনিভার্সিটি
এডিটর জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ।
awahid2569@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.