ধর্ম-ছিনতাই ও চাঁদাবাজি বড় ধরনের জুলুম by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ছিনতাই, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, অপহরণ, জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেওয়া বা জবরদখল—এসব অত্যন্ত জঘন্য সামাজিক অপরাধ, যা ইসলামপরিপন্থী। এতে মানবসমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা, সুখ-সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও অগ্রগতি সব বিনষ্ট হয়। ঘরে-বাইরে, রাস্তাঘাটে, যানবাহনে কোথাও জনগণের জানমাল, ধনসম্পদ, মান-সম্মান—কোনো কিছুর পূর্ণ নিরাপত্তা থাকে না। ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজদের ভয়ে মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে নির্ভয়ে চলাচল বা যাতায়াত করতে পারে না।


নিশ্চিন্তে ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করা সম্ভব হয় না। মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। পিতামাতা, অভিভাবকেরা তাঁদের প্রাণপ্রিয় সন্তানসন্ততিদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন না। তাই ইসলামে এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থসম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৮)
অপরের ধনসম্পদ চুরি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি করে করায়ত্ত করলে ইসলামে তার জন্য কঠিন শাস্তি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। জাগতিক স্বার্থে যারা ছিনতাই ও চাঁদাবাজির ন্যায় অসামাজিক কাজে অগ্রসর হতে পারে, তারা ধনসম্পদ লোভী, অধিক সম্পদ করায়ত্ত করার অভিলাষী এবং অন্যায়ভাবে অপ্রয়োজনীয় ভোগ-বিলাসিতা বা পাপের পথে বেহিসাবি অপব্যয় করার সুযোগের জন্য লালায়িত। জোরপূর্বক ছিনতাই করে মানুষের অর্থসম্পদ হাতিয়ে নেওয়া, গোপনে বা প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করা এক ধরনের বিরাট জুলুম। আল্লাহ তায়ালা এদের পরিণাম সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন, ‘যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহাচরণ করে বেড়ায়, নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।’ (সূরা আশ-শুরা, আয়াত-৪২)
যারা জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করে তারা নিজেরাও জুলুমবাজ এবং তারা জুলুমবাজদের সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী। এরা সুস্থ সমাজব্যবস্থার পক্ষে খুবই ক্ষতিকর ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। চাঁদাবাজেরা যেভাবে নিরীহ মানুষকে হুমকি-ধমকি দিয়ে চাঁদা আদায় করে থাকে, তা যেমন তাদের প্রাপ্য নয়, তেমনি যে পথে তা ব্যয় করে, এটাও বৈধ নয়; বরং তা মানব চরিত্রের পরিপন্থী শরিয়তগর্হিত কাজ। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) সুস্পষ্টভাবে তাদের কঠিন শাস্তির কথা ঘোষণা করেছেন, ‘অবৈধ চাঁদা আদায়কারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (আবু দাউদ)
জোরপূর্বক চাঁদা আদায়কারী অন্যায়ভাবে মানুষের ওপর জুলুম, নির্যাতন, চাপ প্রয়োগ এবং শোষণ করে। আল্লাহর বান্দাদের অনেক কষ্টের বিনিময়ে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ লুটপাট করে কেড়ে নেয়। এই ধরনের জালিম লোকেরা কিয়ামতের দিন মজলুমদের ন্যায্যপ্রাপ্য ফিরিয়ে দিতে পারবে না। যদি তাদের কবুলকৃত কোনো সৎকর্ম থাকে, তবে তা-ই দিতে হবে। এদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে নবী করিম (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে প্রকৃত দরিদ্র হলো সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন প্রচুর নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত নিয়ে আসবে, কিন্তু সে কাউকে গালি দিয়ে আসবে, প্রহার করে আসবে অথবা কারও সম্পদ আত্মসাৎ করে আসবে; অতঃপর এসব ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের একে একে তার পুণ্যকর্ম দিয়ে দেওয়া হবে। যখন পুণ্যকর্ম ফুরিয়ে যাবে, তখন মজলুমদের পাপ কাজ তার ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’
জোরপূর্বক চাঁদা যে ব্যক্তি আদায় করে, যে লোক তার সহযোগিতা করে, যে ব্যক্তি লেখে, আর যে সাক্ষী থাকে, তারা সবাই এই জঘন্য পাপের সমান অংশীদার। তারা সবাই জুলুমের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অন্যায়ভাবে হারাম উপার্জনকারীর ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘যে গোশতের টুকরাটি হারাম সম্পদ থেকে উৎপন্ন হয়, তা জাহান্নামের উপযুক্ত।’ অন্য একটি হাদিসে আছে, ‘কারও সম্পদ সে স্বেচ্ছায় না দিলে তা হালাল হয় না।’
ছিনতাইকারীদের কোনো সামাজিক মানমর্যাদা নেই। তাদের কেউ সুনজরে দেখে না এবং তাদের সঙ্গে কেউ সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চায় না। ছিনতাই, চাঁদাবাজি নানা অপরাধের জন্ম দেয়। ছিনতাইকৃত অর্থ-সম্পদ কোনো ভালো কাজে ব্যবহূত হয় না। অন্যায়ভাবে অর্জিত সম্পদ পাপাচার, অপরাধ ও অসামাজিক কার্যকলাপেই ব্যয় করা হয়। এতে সমাজে অন্যায়-অপরাধ আরও বেড়ে যায়। অন্যায় প্রতিরোধের শিক্ষা দিয়ে মহানবী (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কাউকে অন্যায় কাজ করতে দেখে, তাহলে সে যেন তার হাত দিয়ে তা প্রতিরোধ করে। যদি সে তাতে অক্ষম হয়, তবে মুখ দ্বারা নিষেধ করবে। যদি তাতেও সে অপারগ হয়, তাহলে সে অন্তর দিয়ে ঘৃণা পোষণ করবে।’ (মুসলিম)
ইসলামের আলোকে ছিনতাই ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। ধর্মীয় দিকনির্দেশনা অনুসারে মুসলমানদের পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় রেখে, আর্থসামাজিক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে নীতি-নৈতিকতার বিকাশ, সুশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার। অপরাধের মাত্রা অনুসারে শরিয়তের বিধান মতে প্রচলিত আইনে উপযুক্ত শাস্তির বন্দোবস্ত করতে হবে। সমাজ ও দেশ থেকে বেকারসমস্যা দূরীভূত করে এ ধরনের অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা ও জনমত সৃষ্টিতে মসজিদের ইমাম, খতিব তথা ধর্মীয় নেতাদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালাতে হবে।
বলপ্রয়োগে অসহায় মানুষের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে যারা ভোগ-বিলাসিতায় পরম আয়েশি জীবন যাপন করে পৃথিবীতে উচ্চাভিলাষী সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি, আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতার দাপট দেখায়, ইহকাল ও পরকালে তাদের পরিণতি যে কঠিন, তা সহজেই অনুমেয়। অন্যায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা অবশ্যই তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল ভোগ করবে। এসব পরিণামের কথা চিন্তা করে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ সর্বপ্রকার হারাম উপার্জন, জুলুম-নির্যাতন এবং অন্যের সম্পদ জবরদখলের পথ চিরতরে বর্জন করে যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে আত্মোন্নয়ন ঘটায়, সে-ই প্রকৃত বুদ্ধিমান। বান্দা যদি তওবা করে আত্মশুদ্ধি করতে চায়, তাহলে তার ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী সৎভাবে ও দুর্নীতিমুক্ত জীবন যাপন করা উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.