রসিদ বইয়ের মাধ্যমে ব্যাংকে টাকা জমা নিয়ে সংযোগ, পরে বলছে অবৈধ-১০০ কোটি টাকা নিয়ে বিব্রত তিতাস by অরুণ কর্মকার

১০০ কোটি টাকা নিয়ে বিব্রত তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। এ বছর গ্রাহকদের কাছ থেকে গ্যাসের বিল বাবদ যে পরিমাণ টাকা আসার কথা ছিল, তার চেয়ে ১০০ কোটি টাকা বেশি এসেছে। কিন্তু এই বাড়তি টাকা পুরোনো বকেয়া নয়; চলতি বছরের বিভিন্ন মাসের বিলের টাকার সঙ্গে এসেছে এই বাড়তি টাকা।


তাহলে কি গ্রাহকেরা ভুল করে তিতাসকে এই ১০০ কোটি টাকা দিয়েছেন? নাকি ভালোবেসে দিয়েছেন?
তিতাস সূত্র থেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকার গ্যাসের সংযোগ বন্ধ করার পর থেকে নানা কৌশলে যেসব সংযোগ দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকেই এই টাকা এসেছে। এই সংযোগগুলোকে অবৈধ বলতে চান না গ্রাহকেরা। কারণ, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও বিল বইয়ের মাধ্যমে ব্যাংকে টাকা জমা নিয়ে এসব সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
তিতাসের আবাসিক গ্রাহকেরা যেসব ব্যাংকে প্রতি মাসে গ্যাসের বিল জমা দেন, সেই ব্যাংকগুলো থেকে ওই বাড়তি টাকার হিসাব কোম্পানির কেন্দ্রীয় হিসাব বিভাগে এসেছে। কিন্তু এই টাকা তিতাসের হিসাবে জমা হচ্ছে না (পোস্টিং না হওয়া), তাই বেকায়দায় পড়েছে তিতাস।
সরকার ২০০৯ সালের ২১ জুলাই থেকে শিল্প ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের এবং ২০১০ সালের ১৩ জুলাই আবাসিক খাতে নতুন সংযোগ প্রদান বন্ধ ঘোষণা করে। তখন থেকে কোম্পানির কেন্দ্রীয় নথিপত্র বা কম্পিউটারের হিসাবে কোনো নতুন সংযোগ যুক্ত হয়নি। কাজেই বাড়তি টাকা আসারও কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রায় ১০০ কোটি টাকা এসেছে।
জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আজিজ খান প্রথম আলোকে বলেন, রাজস্ব হিসেবে বাড়তি টাকা জমা হওয়ার বিষয়টি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের (বোর্ড) সভায় উত্থাপন করা হবে। সেখানকার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চাহিদাও বেড়েছে: তিতাসের চাহিদা ও সরবরাহের হিসাব থেকে জানা যায়, সরকার গ্যাসের নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত তাদের আওতাধীন এলাকায় গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ২০ কোটি (২০০ মিলিয়ন) ঘনফুট। এই সময়ে সরকারি উচ্চপর্যায়ের কমিটির সিদ্ধান্তে নতুন সংযোগ দেওয়া হয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। তাহলে সংযোগ বন্ধ থাকার পরও কীভাবে এত চাহিদা বাড়ল?
তিতাস ও পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, কৌশলে হাজার হাজার গ্রাহককে নতুন সংযোগ দেওয়াই এই চাহিদা বৃদ্ধির কারণ। তারা হিসাব করে দেখেছে, নতুন সংযোগ বন্ধ করার পর থেকে এখন পর্যন্ত আবাসিক সংযোগের জন্য যতজন গ্রাহকের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রায় ৬০ শতাংশ ইতিমধ্যে সংযোগ পেয়ে গেছেন। তাঁদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও বিল বই দেওয়া হয়েছে। তাঁরা গ্যাস ব্যবহার করে নিয়মিত বিলও পরিশোধ করছেন। বাকি ৪০ শতাংশকে নতুন সংযোগ দিলেও গ্যাসের কোনো ঘাটতি হবে না। আর না দিলে কৌশলে সংযোগ দেওয়া ও নেওয়া বাড়বে। অর্থাৎ দুর্নীতি আরও ছড়িয়ে পড়বে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে এখন পর্যন্ত গ্যাসের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪৫ কোটি ঘনফুট। নতুন আবাসিক গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে লাগে মাত্র এক-দেড় কোটি ঘনফুট।
অন্যান্য সূত্রমতে, এই চাহিদা না মেটালে নানা কৌশলে সংযোগ প্রদান চলবে। কারণ গ্রাহকের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও এলপি গ্যাসের দাম নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ বাড়াতে পারেনি। কিন্তু জ্বালানি প্রতিটি পরিবারের জীবন ধারণে প্রতিদিনের অপরিহার্য একটি উপকরণ।
সংযোগ দেওয়া হলো কীভাবে: কয়েকজন আবাসিক গ্রাহক বলেন, গ্যাস-সংকটের কারণে সরকার নতুন সংযোগ বন্ধ করার পর তাঁরা বিকল্প জ্বালানির সন্ধান করেছেন। কয়েক মাস বহু চেষ্টা করেও নির্দিষ্ট দামে এলপি গ্যাসের নিয়মিত সরবরাহ পাননি। এর মধ্যে বাধ্য হয়ে কেরোসিনের চুলাও ব্যবহার করতে হয়েছে।
কিন্তু বেশি দিন তা সম্ভব না হওয়ায় গ্রাহকেরা নতুন গ্যাসের সংযোগ পাওয়ার জন্য তিতাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করেন। একপর্যায়ে তিতাসের লোকেরাই এগিয়ে আসেন সংযোগ দেওয়ার জন্য। তিতাসের লোকেরা বলেন, বৈধভাবেই সংযোগ দেওয়া সম্ভব। কথা অনুযায়ী তাঁরা বকেয়া বিল ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য রসিদ বইও দেন। ব্যাংকে এক বছর বা ছয় মাসের বকেয়া বিল দেওয়ার পর সংযোগও লাগে। এরপর প্রতি মাসে ব্যাংক নিয়মিত বিল নিয়েছে।
একজন গ্রাহক বলেন, ‘রসিদ বইয়ের মাধ্যমে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে সংযোগ পেলে এটাকে অবৈধ বলব কীভাবে? আমরা ধরে নিয়েছি, যেকোনোভাবেই হোক, তাঁরা নতুন সংযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অবশ্য এ জন্য তাঁরা বাড়তি টাকাও নিয়েছেন।’
আরেকজন গ্রাহক বলেন, ‘আমি গ্যাসের সংযোগ পেয়েছি সরকার নতুন সংযোগ বন্ধ করার পর। ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের একটি সনদ পাই, যাতে লেখা, ওই সময় পর্যন্ত আমার গ্যাস বিল পরিশোধ করা হয়েছে। কোনো বকেয়া নেই। তাই নতুন দেওয়া সংযোগ নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ-অবিশ্বাস ছিল না। কিন্তু জানুয়ারি মাসে তিতাসের একদল লোক এসে বলেন, ব্যাংকে আর বিল জমা দেবেন না। কারণ, বিলগুলো তিতাসের মূল হিসাবে জমা হচ্ছে না। তিতাসের লোকেরা এখন মাঝে মাঝে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। টাকা পেলে অবশ্য সংযোগ দিয়ে দেন।’
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, প্রত্যেক গ্রাহকের বিল কোম্পানির হিসাবে যুক্ত করার জন্য একটি করে নম্বর (গ্রাহক সংকেত) রয়েছে। দেখা গেছে, যে গ্রাহকের নামে চারটি চুলা বরাদ্দ, তিনি বিল দিয়েছেন ১২টি চুলার। ওই আটটি চুলা কৌশলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এগুলোর বিল কোম্পানির হিসাবে যুক্ত করার জন্য গ্রাহক সংকেত নেই। এভাবে প্রায় ১০০ কোটি টাকা হিসাবে যুক্ত করা যাচ্ছে না।
এ রকম কী পরিমাণ সংযোগ দেওয়া হয়ে থাকতে পারে, জানতে চাইলে কয়েক দিন আগে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, প্রায় এক লাখ হবে।
বৈষম্যে ক্ষুব্ধ গ্রাহক: উত্তরার একজন গ্র্রাহক বলেন, সরকার গ্যাসের নতুন সংযোগ বন্ধ ঘোষণার আগেই তাঁর বাড়িতে গ্যাসের সংযোগ দেওয়ার যাবতীয় কাজ শেষ হয়। এমনকি রাইজার (বাড়ির প্রাঙ্গণে গ্যাসের সংযোগস্থল) পর্যন্ত স্থাপন করা হয়। কিন্তু তিনি সংযোগ পাচ্ছেন না। অথচ তাঁর এক প্রতিবেশী অনেক পরে বাড়ির কাজ শেষ করেও সংযোগ পেয়েছেন। এটা একধরনের বৈষম্য, যা মেনে নেওয়া যায় না।
আদাবরের একজন গ্রাহক বলেন, ‘যাঁর বাড়িতে গ্যাসের সংযোগ আছে, তিনি ৪৫০ টাকায় মাসের জ্বালানি ব্যয় মেটাচ্ছেন। আর আমার এলপি গ্যাস কিনতে লাগছে চার হাজার টাকা। তা-ও সহজে পাওয়া যায় না। এই বৈষম্য মন থেকে মানতে পারছি না।’
কয়েকজন গ্রাহক বলেন, সরকার সংযোগ বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার আগেই তাঁরা টাকা-পয়সা পরিশোধ করে বরাদ্দপত্র (ডিমান্ড নোট) পেয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এটা শুধু বৈষম্য নয়, অবিচারও বটে।
একজন গ্রাহক বলেন, সরকারের যেসব উচ্চপদস্থ ব্যক্তি বলে বেড়াচ্ছেন যে আবাসিক গ্রাহকদের নতুন সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়, তাঁরা কি সংযোগ ঠেকাতে পেরেছেন? গ্যাস তো ঠিকই খরচ হচ্ছে। শুধু সরকার রাজস্ব পাচ্ছে না। টাকা যাচ্ছে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে। আর এতে সাধারণ মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে সরকার।

No comments

Powered by Blogger.