আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী সম্মেলন, চীন-নানান রঙের মেলা by মারুফা ইসহাক

মেঘের ওপরে ভাসতে ভাসতে একসময় আবিষ্কার করলাম আমরা এখন মেঘের নিচে। চারিদিকে কেবল সাদা আর নীল। ধীরে ধীরে দূরের বাড়ি আর রাস্তাগুলো প্রকাণ্ড হয়ে উঠতে লাগল। ৪ জুন ঠিক বেলা ১১টায় চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনসের বিমানটা একটা ঝাঁকি দিয়ে নেমে পড়ল হঙ্কিয়াও ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের রানওয়েতে।


আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে আমি আর বুয়েটের মশিউর এসেছি চায়নার সাংহাইতে। সাংহাইয়ের স্নিগ্ধ বাতাসের অভিবাদনে আমরা যখন থংচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পৌঁছলাম, তখন বেলা প্রায় একটা। ক্যাম্পাসে ঢোকার মুখেই মাও সে তুং-এর বিশাল ভাস্কর্যটা যেন বিশ্বসাম্যের প্রতীক হয়ে স্বাগত জানাল।
চায়নার থংচি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি দ্বিতীয়বারের মতো ৫ থেকে ৮ জুন চীনের সাংহাইতে আয়োজন করল পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী সম্মেলন। এ সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতের কর্ণধার আজকের তরুণদের বিশ্বপরিবেশ ও উন্নয়ন-সম্পর্কিত ধারণা আরও স্বচ্ছ ও জোরদার করা। আর এতে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী মারুফা ইসহাক এবং বুয়েটের শিক্ষার্থী মশিউর রহমান। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা বাদে অন্য দেশগুলোর জন্য যে ১০টি স্কলারশিপ দেওয়া হয়েছে, এর দুটিই পেয়েছে বাংলাদেশ।
সম্মেলনের চারটা দিন বেশ আঁটোসাঁটো রুটিন মেনে চলতে হয়েছে আমাদের। বিভিন্ন দেশের নতুন অনেক বন্ধু যেমন হয়েছে, তেমনি বেশ কিছু দারুণ জায়গাও দেখার সুযোগ হয়েছে। আর এর সঙ্গে ছিল প্রতি মুহূর্তের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। এখানে এসে পরিচয় হলো দুজন বাঙালি শিক্ষার্থী রহমত উল্লাহ ও রায়হান শরীফের সঙ্গে। তাঁরা চীনে পড়াশোনা করছেন।
৫ জুন অর্থাৎ বিশ্ব পরিবেশ দিবসের দিনটিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় চার দিনব্যাপী এই মতবিনিময় সভার। বিভিন্ন দেশের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বিজ্ঞানী ও জ্ঞানী-গুণীদের আলোচনায় উঠে আসে সমসাময়িক বিভিন্ন দেশের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা, সবুজ অর্থনীতির অভিজ্ঞতা, ইকো-ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদি।
অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে পাঁচটি বিষয়ভিত্তিক গ্রুপে অনুষ্ঠিত হয় ওয়ার্কশপ এবং সাংহাইয়ের পরিবেশ-সম্পর্কিত বাস্তব অভিজ্ঞতার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় চমৎকার কিছু জায়গায়। প্রদর্শন করা হয় পরিবেশবিষয়ক নানা পরিকল্পনা। এর মধ্যে ছিল সুজুখু নদীর থিমপার্ক পরিদর্শন, যেখানে এ নদীর অতীত দূষণ অবস্থা ও এটি দূষণমুক্ত করার ইতিহাস আলোকপাত করা হয়। সেসব দেখে মশিউরকে বেশ আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায়, আমাদের বুড়িগঙ্গাকেও তো এমনিভাবে দূষণমুক্ত করা সম্ভব। সাংহাই শহরের অদূরেই রয়েছে চৌমিং দ্বীপ। এটি চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ। ৮.৯ কি.মি. লম্বা টানেল ও ১৬.৬৩ কি.মি. ব্রিজ পার হয়ে পৌঁছাতে হয় এই দ্বীপে। সেখানে দেখানো হয় চিয়ংকাওসা রিজার্ভারে কী করে পানি বিশোধন, সংরক্ষণ ও সরবরাহ করা হয়; আরও দেখানো হয় দংটান জলাশয়।
সাংহাইয়ের একটা দারুণ সুন্দর জায়গা হোয়াংপু নদীর তীরবর্তী বান্ড এলাকা। সেখানে একদিকে রয়েছে ঐতিহাসিক দালানকোঠা, অন্যদিকে আছে বিশাল উঁচু উঁচু আধুনিক দালান। এই দালানগুলো হুতুমপেঁচার মতো সারা রাত জেগে থাকে রংবেরঙের আলোর খেলা দেখিয়ে। হঠাৎ একটা আলোর দিকে চোখ পড়তেই বড্ড চেনা লাগল। মনের অজান্তেই মুচকি হেসে উঠলাম। আরে, এ তো জোছনার আলো! শহরের ঝলমলে আলোয় বড্ড ম্লান লাগছে। তার পরও গোল থালার মতো চাঁদটার দিক থেকে চোখ ফেরানো মুশকিল।
শেষের দিনে ছিল পোস্টার প্রতিযোগিতার ফল ঘোষণা। প্রতিযোগিতায় অন্য সবাইকে অবাক করে দিয়ে তৃতীয় স্থান অধিকারীর নাম ঘোষণা করা হলো: মারুফা ইসহাক ফ্রম বাংলাদেশ। আমি তো বিস্মিত! বিশাল একমুখ হাসি নিয়ে এগোলাম মঞ্চের দিকে। পেলাম সনদ আর এক হাজার ইউয়ান (টাকায় প্রায় ১৪ হাজার)। মিলনায়তনজুড়ে করতালি আর মৃদু গুঞ্জন ‘ফ্রম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ!’
এ বছরের সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, কেনিয়া, ক্যামেরুন, শ্রীলঙ্কা, কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ৪২টি দেশের ২০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন। এ সম্মেলন যেন এক বিশ্বতারুণ্যের মিলনমেলা। বর্ণ, ধর্ম আর সংস্কৃতির ভিন্নতা ছাপিয়ে মূর্ত হয়ে উঠে মানবতা ও পরিবেশভাবনা। এর প্রতিফলন ঘটেছে গ্লোবাল ইয়ুথ ডিক্লারেশনের মধ্যে, যা উপস্থাপন করা হবে রিও+২০ সম্মেলনে। এর মূলকথা, বিশ্বজুড়ে জ্ঞান ও প্রযুক্তির বন্ধন তৈরিতে বিশ্বতরুণদের সহযোগিতা ও পরিবেশ রক্ষায় সবুজ বিপ্লবকে সমর্থন। এ সম্মেলন যেন প্রমাণ করল সংস্কৃতি আর দেশের সীমানা তারুণ্যের শক্তি ও পরিবেশ সচেতনতাকে আলাদা করতে পারে না। তারুণ্যের জয়গান বিশ্বব্যাপী একই সুরে বাঁধা।

No comments

Powered by Blogger.