চরাচর-স্বাধীনতার চিহ্ন সবুজের বুকে লাল বৃত্ত by সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে/সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে, সবখানে। রবি ঠাকুরের গানের এই লাইনগুলো বোধ করি সবচেয়ে বেশি অর্থবহ হয়ে উঠেছিল ১৯৭১-এর মার্চে। স্বাধীনতার এক সুর ছড়িয়ে পড়েছিল সব বাঙালির চেতনায়।


তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে মিটিংয়ে যোগ দিতে যাওয়ার আগে রুমীও গেয়ে উঠেছিলেন-তুমি যে সুরের আগুন ছড়িয়ে দিলে...। তাঁকেও আন্দোলিত করেছিল বলে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মনে রেখেছিলেন সেই কথা, '৭১-এর ২ মার্চের স্মৃতিচারণে তুলে ধরেছেন বর্ণনা। শহীদ রুমীর মতো কলাভবনে সংগ্রামের মাসের দ্বিতীয় দিনে এক স্বপ্নে প্রাণিত হয়ে সেদিন ছুটে এসেছিলেন বুদ্ধিজীবী, বাবার কাঁধে ছোট শিশুকন্যা, শামিল হয়েছে কৃষক, মজুরসহ আপামর জনতা। এক দিনে একই ভূখণ্ডে দুটি পতাকা ওড়ানোর ইতিহাস লেখা হয়েছিল ২ মার্চ। নিজেদের কঠোর অস্তিত্ব প্রমাণের তাগিদে পাকিস্তানি শাসকদের কার্যালয়ে সবুজ-সাদা আর মুক্তির আহ্বানে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে ওড়ানো হয়েছিল সবুজ জমিনে টকটকে লাল সূর্যের নিশানা। সেই বৃত্তের মাঝে বাংলাদেশের সোনালি মানচিত্র। আগের দিন রাতে জহুরুল হক হলের একটি কক্ষে তৈরি করা হয় পতাকা। জন্মলগ্ন থেকেই এ পতাকা সংগ্রামী। পহেলা মার্চ রাতে ছাত্ররা মিলে যখন এক টুকরো সবুজ কাপড়ে লাল বৃত্তে মানচিত্র আঁকলেন তখনই নাম বদলে ইকবাল হলের নামকরণ হলো সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। ১ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান, তারই যেন তীব্র প্রতিবাদের ভাষা ছিল এই পতাকা। তাঁর সেই স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের পর স্বাধীনতার ঘোষণা ছাড়া যেন আর অধিকার আদায়ের পথ ছিল না আমাদের। তাই এ পতাকার গুরুত্ব অনেক। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভা চলাকালে একটি মিছিলে করে বয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। মঞ্চ থেকে পতাকাটি তুলে নিয়েছিলেন সে সময়ের ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং আ স ম আবদুর রব। তুলে ধরা হলো পতাকা, যেন এক মুহূর্তে গোটা বিশ্বের কাছে ঘোষণা করা হলো স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের কথা। মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া হলো স্বাধীনতা আর তার জন্য লড়াইয়ের প্রস্তুতির মন্ত্র। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারও এ পতাকার নকশাই তুলে ধরে। এই পতাকাই উড়েছে পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়। এটাই ছিল জাতীয় পতাকা। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর সরকারি সিদ্ধান্তে এর মাঝের মানচিত্র অংশটুকু বাদ দেওয়া হয়; কিন্তু সবুজ আর লালের ব্যাকরণ আগের মতোই অপরিবর্তিত। তবে একটি জাতির অস্তিত্ব প্রমাণ করে বলে পতাকার রয়েছে নিজস্ব মর্যাদা। রয়েছে সঠিক মাপ, যথাস্থানে ব্যবহার, নির্দিষ্ট দিনে অর্ধনমিত রাখা, সঠিকভাবে ব্যবহারের বিষয়। আর এ নিয়মগুলো পালন না করলে শুধু পতাকাটিকেই নয়, পুরো জাতিকেই অবমাননার শামিল হয়ে ওঠে। জাতিসংঘের আসরে এ পতাকাই তো পরিচয় করিয়ে দেয় বাংলাদেশকে, ক্রিকেট মাঠে আনন্দের চিহ্ন, এভারেস্ট চূড়ায় আমাদের জয়ের নিশানা। এই লাল-সবুজের ব্যাকরণই তো মনে করিয়ে দেয় লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের জন্ম নেওয়ার কথা।
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

No comments

Powered by Blogger.