স্মরণ-মোহাম্মদ সাইদুর : শিকড়সন্ধানী মানুষ by স্বপন কুমার দাস

বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার সাংস্কৃতিক পরিচয় ছিল যার নখদর্পণে, এ দেশের কথক, লেখক, গায়েন, বাউল তথা লোকশিল্পীদের পরিচয় যার মুখস্থ, তিনি ছিলেন মোহাম্মদ সাইদুর। তিনি দীর্ঘ ৫০ বছরেরও অধিককাল এ দেশের লোকসাহিত্য ও লোকশিল্প নিদর্শন সংগ্রহের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন।


তিনি এ দেশের লোকসাহিত্যের ওপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গেছেন। শিকড় সন্ধান করে এ দেশের সমৃদ্ধ লোকসাহিত্যকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন। তিনি বহু লোকশিল্পীকে তুলে এনে খ্যাতির শিখরে পেঁৗছে দেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন। রেখে যান নিজ কর্মের অনন্য স্বাক্ষর। মোহাম্মদ সাইদুর ১৯৪১ সালের ২৮ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার সদর থানার চরবগাতিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কুতুবদ্দিন আহমদ ছিলেন লোকগীতি গায়েন ও পুঁথি পাঠক। তিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালে মওলানা ভাসানী আহূত ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে উপস্থিত হন জারিগানের দল নিয়ে। মোহাম্মদ সাইদুর সাংবাদিক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি তৎকালীন দৈনিক পূর্বদেশের জেলা বার্তা পরিবেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকতা করার সময়ই তিনি এ দেশের সমৃদ্ধ লোকসাহিত্যের সন্ধান পান। এরপর তিনি সংগ্রাহক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমীর সংগ্রাহক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। চাকরিরত অবস্থায় ১৯৬৮ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে গীতিকবিতা, কাহিনী, পুঁথি ও কেচ্ছার কথক ও লেখন সংগ্রহ করে বেশ কয়টি মূল্যবান গ্রন্থ সংকলন করেন। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত এসব গ্রন্থের মধ্যে জামদানি, বেড়াভাসান উৎসব, মহররম উৎসব, বাংলা একাডেমী ফোকলোর সংকলন, কিশোরগঞ্জের ইতিহাস উল্লেখযোগ্য। শুধু লোকসাহিত্য নয়, লোকশিল্পের নিদর্শন সংগ্রাহক হিসেবেও মোহাম্মদ সাইদুর অসাধারণ কাজ করে গেছেন। তিনি গ্রামের চারু, কারু, কুমার, কামার, তাঁতির তৈরি পণ্য সংগ্রহ করে নিজ গ্রাম বিন্নগাঁওয়ে একটি লোকশিল্প সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন। এ ছাড়া বাংলা একাডেমী লোকঐতিহ্য সংগ্রহশালা, সোনারগাঁ লোকশিল্প ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এবং জাতীয় জাদুঘরে তাঁর সংগৃহীত বহু নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমীতে এবং ১৯৮৯ সালে শিল্পকলা একাডেমীতে তাঁর সংগৃহীত নিদর্শন প্রদর্শিত হয়েছে। ১৯৮৮ সালে লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল আর্ট গ্যালারিতে তাঁর সংগৃহীত লোকশিল্প নিদর্শনের প্রদর্শনী হয়। তা ছাড়া তিনি এ দেশের লোকসংস্কৃতির গাইড হিসেবেও ছিলেন অদ্বিতীয়। তিনি দেশ-বিদেশের বহু গবেষক ও ছাত্রছাত্রীর গাইড হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর সহযোগিতা নিয়ে বহু গবেষক পিএইচডি ও এমফিল লাভ করেছেন। হাজারো সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করে মোহাম্মদ সাইদুর বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতিকে বিশ্বে তুলে ধরেছেন, বয়ে এনেছেন বিরল সম্মান। বিশ্ববিখ্যাত গবেষক হেনরি গ্লমি তাঁর বিন্নগাঁওয়ে সংগ্রহশালা উদ্বোধন করেন এবং তাঁর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এ দেশের গ্রামগঞ্জে কর্মরত বিভিন্ন পেশার অসংখ্য শিল্পী ও কারিগরের সঙ্গে তাঁর আ@ি@@@ক সম্পর্ক ছিল। তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমী থেকে অবসর গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যোগ দেন এবং আমৃত্যু সেখানে কর্মরত ছিলেন। মোহাম্মদ সাইদুর ছিলেন বড় মাপের মানুষ। তিনি এ দেশের লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর পাণ্ডিত্য বহন করতেন। তবে বাহ্যিকভাবে তিনি অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। নিভৃতচারী, নিরহংকারী ও প্রচারবিমুখ শিকড়সন্ধানী এই মহান সংগ্রাহকের আজ চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। দেশ-বিদেশের অগণিত গুণগ্রাহী আজ তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করবেন।
স্বপন কুমার দাস

No comments

Powered by Blogger.