পানি ও জনজীবন-দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সংহতি by ফারহাত জাহান

দক্ষিণ এশীয় সংহতির প্রচেষ্টা দীর্ঘদিনের। দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে সার্ক ১৯৮৫ সালে আঞ্চলিক সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বিচারে বলা যায়, দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলোর গ্রহণযোগ্য সুরাহা হয়নি। আমাদের সামনে আঞ্চলিক সংহতি হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দৃষ্টান্ত ছিল।


কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর অভাবে জর্জরিত দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সংহতির পদযাত্রায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দৃষ্টান্তকে শামিল করা যায়নি


নদীর প্রবহমান ধারা চেনে না সীমান্তরেখা। সে বহমান তার নিজের গতিতে। মানুষের সীমাবদ্ধতায় সে তার সীমানা স্বয়ং সীমান্তরেখা বরাবর সীমিত করেছে। একইভাবে সে শাসন করতে চায় জলের প্রবহমান ধারাকে। জলের প্রবহমান এ ধারাকে রাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে কেউ হন লাভবান, কেউবা ক্ষতিগ্রস্ত। তাই আজ মানুষের মঙ্গলের জন্য একটি মানবিক মঞ্চ জরুরি হয়ে পড়েছে। সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে দক্ষিণ এশীয় সংহতি নিয়ে আজ কিছু কথকতার অবতারণা।
পৃথিবীর ৪৫ ভাগ দরিদ্র মানুষের বসবাস এ অঞ্চলে, যারা লড়ছে ক্ষুুধা আর দারিদ্র্যের সঙ্গে। রাজনৈতিক বাস্তবতায় নানা ধরনের টেনশন রয়েছে এখানে। বলা হয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিংতা, দুর্নীতি, রাজনীতির সামরিকীকরণ, গণতন্ত্রের রাজতান্ত্রিকীকরণ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের কম-বেশি রাজনৈতিক বাস্তবতা। ন্যায্য পানি বণ্টন দক্ষিণ এশীয় সংহতির আলোচনায় বারবার স্থান পেয়েছে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকা অবস্থান করছে তিনটি দেশজুড়ে। তাহলো বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল এবং এ তিন অববাহিকায় রয়েছে একটি বিশাল সংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। একটি স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য এ অঞ্চলের মানুষ এই প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগাতে পারে। আর তাই পানিসম্পদের যথোপযুক্ত ব্যবস্থাপনা এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্বার উন্মোচন করতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতায় আন্তঃরাষ্ট্রিক পানি বণ্টন, পানি ব্যবস্থাপনা এবং সেচ-হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রকল্পগুলো উচ্চ ও নিম্ন অববাহিকার উভয় দেশগুলোতে পানি সমস্যা তৈরি করছে। গ্রীষ্মে খরা আর বর্ষায় বন্যাসহ ভয়াবহ দুর্যোগ তৈরি করছে, যা কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষি তথা কৃষি উৎপাদন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর বিরাট প্রভাব ফেলছে। একটি বিশাল ভূখণ্ডের কারণে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান, নেপাল ও বাংলাদেশের উচ্চ ও নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে সংযোগ রয়েছে। এ সম্পর্ককে স্বীকার করে দেশগুলো বেশকিছু দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও চুক্তির মাধ্যমে পানি বণ্টনের ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসতে চেয়েছে, যেমন ভারত-পাকিস্তান পানি চুক্তি (১৯৬০), ভারত-বাংলাদেশ পানি বণ্টন চুক্তি (১৯৯৬), নেপাল-ভারত মহাকালি চুক্তি (১৯৯৬)। অর্থাৎ এ চুক্তিগুলো সম্পাদনের বাস্তবতা এ কথা স্পষ্ট করে, পানি বণ্টন ইস্যুটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য জরুরি। যার সঙ্গে এসব অঞ্চলের কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনের যোগ রয়েছে। তবে এ চুক্তিগুলোর বাইরেও পানি ব্যবস্থাপনা, বণ্টন ও হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে দেশগুলোর আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে। পাকিস্তান সীমান্ত ঘেঁষে ১১টি হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রকল্পের পরিকল্পনা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে শিথিল করেছে। ফারাক্কা বাঁধ যা বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত; ১৯৭৫ সাল থেকে কাজ শুরু করেছে, যার ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবনজীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ দুটি চুক্তি সম্পাদন করলেও তা বাংলাদেশের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি।
অন্যদিকে বাংলাদেশের ৫৪টি প্রধান নদী ভারতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কৃষি ও কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু যৌথ নদী কমিশন ও গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি পানি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ সমাধান নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি। উপরন্তু বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের সীমান্ত ঘেঁষে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক সম্পর্ককে গম্ভীর ও চিন্তান্বিত করেছে। বাস্তবায়নাধীন টিপাইমুখ ড্যাম একই সতর্কবার্তা বহন করছে যে, এ বাঁধের বাস্তবায়ন বাংলাদেশের সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকার মৃত্যু ঘটাবে এবং এ অঞ্চলের প্রায় দু\'কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকাকে নাজুক করে তুলবে। তিস্তা ব্যারাজ একই রকমভাবে স্পর্শকাতর ইস্যু বাংলাদেশের জন্য। একইভাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে পানি বণ্টন নিয়ে ভারত-নেপালের মধ্যে নানা টেনশন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোশি চুক্তির (১৯৫৪) কথা বলা যায়, যা বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ ও বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের লক্ষ্যে নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু তা নিয়ে বহু বিতর্ক ও চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ রয়েছে একে অপরের বিরুদ্ধে। সুতরাং বাংলাদেশের মতো পানি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে নেপাল-ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধ রয়েছে কোশি প্রকল্প নিয়ে। পরিবেশ বিপযর্য়সহ তা ব্যাপকভাবে স্থানীয় মানুষকে স্থানচ্যুত করে উদ্বাস্তু বানিয়েছে।
উচ্চ অববাহিকার দেশ হিসেবে নেপালের সঙ্গে রয়েছে ভিন্নমাত্রার সম্পর্ক। ভারত-নেপালের মধ্যে সম্পাদিত অনেক চুক্তি ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ সারদা ড্যাম কনস্ট্রাকশন চুক্তি (১৯২৭), কোশি চুক্তি (১৯৫৪), গানডাক চুক্তি (১৯৫৯), টানাকপুর চুক্তি (১৯৯১), মহাকালি চুক্তির (১৯৯৬) কথা বলা যায়। উচ্চ নদীবিধৌত ৬০০০ নদীর দেশ নেপাল পানি ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ এশীয় বাস্তবতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মূলত পানি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা এমন একটি জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয়, যা ব্যাপকভাবে প্রভাব রাখে কৃষি উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ_ সর্বোপরি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর। সুতরাং সংঘবদ্ধভাবে এ বিষয়গুলো মোকাবেলা করা যেতে পারে। আরও করা যেতে পারে একটি নতুন বোঝাপড়া দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক পানি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনায়, যা ভারত-বাংলাদেশ, ভারত-পাকিস্তান, নেপাল-ভারত পানি বণ্টন ইস্যুকে নতুন দিকনির্দেশনা দেবে।
দক্ষিণ এশীয় সংহতির প্রচেষ্টা দীর্ঘদিনের। দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে সার্ক ১৯৮৫ সালে আঞ্চলিক সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বিচারে বলা যায়, দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলোর গ্রহণযোগ্য সুরাহা হয়নি। আমাদের সামনে আঞ্চলিক সংহতি হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দৃষ্টান্ত ছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর অভাবে জর্জরিত দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সংহতির পদযাত্রায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দৃষ্টান্তকে শামিল করা যায়নি। উল্লেখ্য, আঞ্চলিক সৌহার্দ্যের আরও উদাহরণ পৃথিবীতে রয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তৈরির পেছনে ইউরোপের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং নীতি নির্ধারণে অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বিরত ছিল; যা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাফল্যের অন্যতম কারণ। আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইউরোপের অন্যতম অর্থনৈতিকভাবে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর উদ্যোগে গঠিত হলেও ইউরোপের ক্ষুদ্রতম দেশগুলো এর সুফল ভোগ করছে তাদের অর্থনৈতিক সম্পদ সীমিত থাকা সত্ত্বেও। সার্কের অভিযাত্রায় আমরা এ দৃষ্টান্ত গ্রহণ করিনি। দক্ষিণ এশিয়ায় সার্ক সংহতি, সার্ক বাণিজ্য এমনকি যঁসধহ সড়নরষরঃু্থর ক্ষেত্রেও আমরা যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই রয়ে গেছি। বরং দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো কালান্তরে একপক্ষীয় চুক্তিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় ফারাক্কার পানি বণ্টন, পানি চুক্তি, ছিটমহল, বিনিয়োগ এসব আলোচনায় আসেনি।
এমনকি সম্প্রতি ট্রানজিট ইস্যু, টিপাইমুখ ড্যাম নিয়ে আমরা আঞ্চলিক আলোচনায় বসিনি। আমরা পূর্বের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ফলাফলগুলো খতিয়ে দেখিনি। সম্প্রতি ইমাজিন নিউ সাউথ এশিয়ার এজেন্ডা নিয়ে সুশীল সমাজ ও বেসরকারি উন্নয়ন উদ্যোক্তারা এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তা বেশি আলোর মুখ দেখতে পারেনি। সম্প্রতি একটি যৌথ সামষ্টিক উন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের একটি তরুণ দল নেপাল যাত্রা করেছিল, যার মধ্যে ছিলেন সমাজ উন্নয়নকর্মী, সাংবাদিক ও উদ্যমী তরুণ। উদ্দেশ্য ছিল সুশীল সমাজের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কিছু সংহতির সম্ভাবনাকে উস্কে দেওয়া। সে দলের একজন সৌভাগ্যবান সদস্য হিসেবে আমিও ছিলাম। অভিজ্ঞতা বলে, সাধারণের কণ্ঠস্বর আর রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর কখনও এক হয় না। তবে তার মেলবন্ধনের স্বপ্নের সম্ভাবনা নিয়ে নেপালের সিন্ধুপালচাক জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে আমরা গিয়েছিলাম কৃষি ও কৃষকের সংগ্রাম সরেজমিন দেখার জন্য। সংহতি ও একটি সমৃদ্ধ জীবনের আকুতি তাদের রয়েছে। সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নানা আলোচনায়ও আমরা আঞ্চলিক সংহতির প্রশ্নে উদ্বিগ্ন হই। অনুভব করি সামগ্রিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রশ্নে এর প্রয়োজনীয়তা। বস্তুত, সময়োচিত ও বস্তুনিষ্ঠ সমাধানের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। স্থানিক রাজনীতির ঊধর্ে্ব গিয়ে গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার ৪০ কোটি মানুষের সমৃদ্ধির সঙ্গে একাত্মতা ও সংহতির প্রশ্নে যৌথ নদী কমিশন, সার্কসহ সব আঞ্চলিক উদ্যোগের প্রশ্নে আরও উদ্যমী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সেই সঙ্গে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের। প্রয়োজন রয়েছে উদ্যোগগুলো প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের। বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার সুশীল সমাজ এ ক্ষেত্রে কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করতে পারে।

ফারহাত জাহান : গবেষক
farhat718@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.