দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক-হিলারির ভ্রমণের পর রবীন্দ্রনাথের পতিসর by মোহীত উল আলম

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণের পর দেশের মানুষ কিছুটা স্বস্তি ফেলছে যে হরতাল বোধহয় আর হবে না। বুধবার বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল ছিল। সেখান থেকেও হরতালের ঘোষণা না আসায় জাতি বিরামপূর্ণ নিঃশ্বাস নিতে পারছে। হিলারি তাগিদ দিয়েছেন দুই দল যেন আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করে নেয়।


যেকোনো বাংলাদেশির অপমানবোধ হতে পারে এ জন্য যে কেন আমাদের বিবদমান প্রধান দুটি দল তাদের রাজনৈতিক ঝগড়া নিজেরা মিটিয়ে ফেলতে পারে না। কেন বারবার বিদেশি কেউ এসে সে কথা বলবেন, যে কথা দেশবাসী নানাভাবে হাজারো কণ্ঠে দুই দলের দুই নেত্রীকে বলে আসছে। গাঁয়ের যোগী যেমন ভিখ পায় না, তেমনি দেশের বিজ্ঞ লোকদের উপদেশ বা পরামর্শ রাজনৈতিক শীর্ষস্থানীয় নেতারা নেন না। অবশ্য এ কথাও স্বীকার করতে হয় যে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন নিয়ে যখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি বিবদমান শিবিরে পরিণত হয়েছিল, দুই নেত্রী যখন একে অপরের মুখ দেখা পর্যন্ত বন্ধ করেছিলেন, তখন বিশ্বখ্যাত পর্বতারোহী প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী এডমন্ড হিলারি এসে যেমন দুই নেত্রীকে আলোচনার টেবিলে বসাতে পারেননি, তেমনি পারেননি কমনওয়েলথের তৎকালীন মহাসচিবও। এবারও যে হিলারির কথা দুই নেত্রী বা দুই দল মেনে নেবে, তা মনে হয় না। এরই মধ্যে সরকারি দলের যুগ্ম সচিব মাহবুব উল আলম হানিফ একটি সম্প্রচারকেন্দ্রে বলেছেন, হিলারির কথায় দেশ চলবে না। এর আগে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেছেন, হিলারির গ্রামীণ ব্যাংকবিষয়ক মন্তব্যটি রাবিশ বা বাজে মন্তব্য ছাড়া আর কিছু নয়। (হিলারির উচিত বাংলা শেখা, যাতে এসব মন্তব্যের তীব্রতা তিনি মূল ভাষায় বুঝতে পারেন।)
আমেরিকার প্রতি বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি মিশ্রিত হতে বাধ্য। ’৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আমেরিকার ভূমিকা ছিল একান্ত নেতিবাচক। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার চীনের মিত্র পাকিস্তানের সহায়তার ওপর নির্ভর করছিলেন। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তাঁরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে খাটো করে দেখতে চেয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে প্রতিক্রিয়াশীলগোষ্ঠী তৎকালীন আওয়ামী লীগের সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করলে তার পেছনে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের হাত ছিল এমন একটি কথা প্রামাণ্য করে সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ তাঁর বহুল পঠিত গ্রন্থ দ্য আনফিনিশড রেভল্যুশন লিখলেন। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী (পরে অর্থমন্ত্রী) তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতার পর ঘোষণা দেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সাহায্য ছাড়াই বাংলাদেশ চলতে পারবে। তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্ভবত সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিটা ঘটে যায়। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে মন্ত্রিত্ব হারান তাজউদ্দীন। তারপরও তাজউদ্দীনের এ আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণ প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। কারণ, হিলারির বহু দশক আগের পূর্বসূরি হেনরি কিসিঞ্জার তখন বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে বিশ্বলোকে শিশু বাংলাদেশকে ওই অবস্থায় ভিক্ষুক হিসেবে পরিচিত করতে চেয়েছিলেন।
এ কথা অনেকেই জানেন যে কিসিঞ্জার তাঁর একটি গ্রন্থে, সম্ভবত দ্য হোয়াইট হাউস ইয়ারস, বলেছিলেন যে বাংলাদেশের উদ্ভব তাঁর জন্য ব্যক্তিগত পরাজয়স্বরূপ ছিল। অবশ্য এর অর্থ এ নয় যে পরবর্তী দশকগুলোতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সম্পর্কের উন্নত হয়নি। হয়েছে, এবং ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশ দরিদ্রদের গণতন্ত্রের বদলে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের দিকে ঝুঁকলে (অর্থাৎ সবাই নয়, শুধু কেউ কেউ বড় লোক হবে সে রকম তন্ত্র) আর বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার অর্থনৈতিক সম্পর্কেরও উন্নতি হয়। ধারণা করি, তৈরি বস্ত্র ব্যবসায় বাংলাদেশ যে আজকে কয়েকটি শীর্ষ দেশের একটি, তার কারণ এর মূল খরিদদার আমেরিকা। এতেও চমকে ওঠার কিছু নেই। আমেরিকা জাপানে আণবিক বোমা ফেলে হিরোশিমা ও নাগাসাকি নগর দুটোকে ধ্বংস করে ফেললেও আজ আমেরিকা ও জাপান সর্বোচ্চ মিত্রতা রক্ষা করে চলছে। ‘চীনের সম্ভাব্য সম্প্রসারণবাদী আক্রমণ’ থেকে রক্ষা করার জন্য জাপানকে সতত পাহারা দিয়ে যাচ্ছে আমেরিকার রণতরীগুলো। খোদ জাপানেই কয়েক হাজার আমেরিকান সেনা সর্বদা অবস্থান করেন। আবার এর প্রতিদানস্বরূপ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ‘বাবা’ জর্জ বুশ যখন প্রথমবার ইরাক আক্রমণ করেন, নব্বইয়ের দশকে, তখন আমেরিকার তাগিদে আন্তর্জাতিক মিত্রবাহিনীর ইরাকে থাকার ব্যয়ভার বহন করেছিল জাপান। জাপানি সংস্থা জাইকার পক্ষে কর্মরত একজন জাপানি কর্মকর্তা আমাকে এক সড়কপথে যাত্রায় সঙ্গী হলে বলেছিলেন যে জাপানিরা সাধারণভাবে ওই ১৯৪৫ সালের আণবিক বোমা হামলাকে মনেও রাখে না বা এটা নিয়ে তাদের কোনো আচ্ছন্নতা নেই। বিশ্বলোকে এখন অর্থনীতি সবচেয়ে মৌল প্রশ্ন। এ জঙ্গম অর্থনৈতিক প্রবাহে বাংলাদেশ ক্রমেই একজন নিয়মিত অংশীদার হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কিসিঞ্জারের মুখেও একটু একটু ছাই পড়ছে।
এ প্রেক্ষাপটে হানিফের উক্তিটি কাঁচা দেশপ্রেমের প্রেক্ষাপটে সন্তোষজনক হলেও পরিণত রাজনৈতিক বিজ্ঞতার পরিচয় দেয় না। কারণ, বিশ্বরাজনীতিতে শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে ছোট দেশগুলো নিয়ে নানা পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়। সেখানে অর্থনৈতিক অনুদান বিরাট একটি ভূমিকা পালন করে। বৃহৎ শক্তিগুলো আগের মতো দেশ দখল করে ঔপনিবেশিকতা চালায় না, কিন্তু অর্থঋণ প্রদানের মধ্য দিয়ে দুর্বল দেশগুলোকে ঠিকই অর্থনীতির ফাঁসের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখে। এ ব্যাপারে এক নম্বর খেলোয়াড় হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর তার পক্ষ হয়ে ঋণ প্রদান, অনুদান, অনুমোদন এবং অর্থনৈতিক শৃঙ্ক্ষলা রক্ষা করার জন্য পুলিশি কাজটি করে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক অর্থঋণ সংস্থা। এ দুটি সংস্থা এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যেটা হোয়াইট হাউস থেকে স্বীকৃত বা অনুমোদিত হয়নি।
তবে হানিফের অপমানবোধের ভারটা জাতিগতভাবে আমরা বুঝি। কেন একজন শক্তিশালী দেশের মুরব্বি এসে আমাদের হেদায়েত করে যাবেন? এ মুরব্বির সঙ্গে এখন ইউরোপীয় গোষ্ঠীও গলা মিলিয়েছে। কিন্তু এ অপমান যাতে সইতে না হয়, সে জন্য আমাদের তো তৈরি হতে হবে। হিলারি তো একক কোনো ব্যক্তি নন, তিনি একটি শক্তির প্রতিভু। পুঁজিবাদী বিশ্বের।
বাংলাদেশ শিল্পোন্নত দেশ নয়, কিন্তু সস্তা শ্রম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশ পুঁজি বিনিয়োগের একটি আদর্শ রাষ্ট্র। সে বাংলাদেশ ভালোভাবে না চললে যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিল্প ও ব্যবসায়ী মহলে উদ্বেগের কারণ সৃষ্টি হয় এবং আমাদের উদ্যমী ও বণিকগোষ্ঠীর ব্যবসারও দারুণ ক্ষতি হয়। এ জন্য হিলারিসহ অন্যদের বাংলাদেশকে চলমান দেখতে এত তৎপরতা। এরপর সমুদ্রবিজয়ের পর গভীর সমুদ্রপোত নির্মাণ করার সূচনালগ্নে আছে বাংলাদেশ। চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ এ কারণে বাংলাদেশের কৌশলী ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে সজাগ হয়েছে। বড় দেশগুলোর হাতে এ ধরনের সম্ভাবনাকে বিকশিত করার মেধা ও কলাকৌশল আছে, যা এখনো বাংলাদেশের আয়ত্তাধীন হয়নি। তাই এগুলো অর্জন হওয়ার আগে, এসব অর্থনৈতিক সম্ভাবনার উৎসগুলো আমরা হরতালসহ তামাদি রাজনীতির চর্চার মাধ্যমে নস্যাৎ করতে পারি না। রাজনীতিকদের বুঝতে হবে দেশে এখন আধুনিকমনস্ক, উন্নতিপ্রবণ একটি শক্তিশালী পেশাদার গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। শিল্পে, ব্যবসায়, কর্মক্ষেত্রে এবং শিক্ষায়। সে জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো এবং রাজনৈতিক মন্তব্যগুলো আবেগপ্রবণ তামাদি যুক্তিনির্ভর না হয়ে ভবিষ্যৎমুখী হওয়া উচিত। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এ আধুনিকতা জাতি দাবি করে।

২.
কয়েক দিন আগে পঁচিশে বৈশাখ ১৪১৯ রবীন্দ্রনাথের জয়ন্তী উপলক্ষে পতিসর গিয়েছিলাম। আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রাজশাহী বিভাগের কমিশনার কবি আসাদ মান্নান। অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক ফকরুল আলম ছিলেন আর দুজন আমন্ত্রিত অতিথি। বিকেলের সংগীতানুষ্ঠানে পতিসরের দেবেন্দ্র মঞ্চে কিশোরী শিল্পীপ্রীতি সাহা কয়েকটি গান পরিবেশন করে বুঝিয়ে দিলেন পতিসর, আত্রাই এবং নওগাঁর রবীন্দ্রসংগীত চর্চা খুব উচ্চমানের। নওগাঁর মেয়ে তামান্না জাতীয়ভাবে নামকরা নৃত্যশিল্পী। তিনিসহ তাঁর দল পরিবেশন করলেন বিদায়-অভিশাপ-এর নাট্যরূপ। আমরা অভিভূত, যেমন অভিভূত হয়েছিলাম এর কিছুক্ষণ আগে একটি কিশোরী দলের ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ গানটির অপূর্ব নৃত্যরূপ দেখে।
যেখানে আমাদের রবীন্দ্রনাথের জমিদারি ‘পতিসর’ ভ্রমণের সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ ভ্রমণের সংযোগ খুঁজে পাচ্ছি, সেটি যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ যে বজরায় করে নদীবিহার (পদ্মা নদী হয়ে, আত্রাই নদী হয়ে, নাগর নদী) করে কলকাতা থেকে পতিসর পৌঁছাতেন, সেটার একটি কাঠের তৈরি নকশা পতিসরের কুঠিবাড়ির জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। (বস্তুত, নওগাঁ জেলার প্রশাসন কৃতিত্বের দাবি করতে পারে এ জন্য যে জাদুঘরটি খুব সুসংরক্ষিত।) আর বজরার একটি প্রকৃত নোঙর জাদুঘরে রাখা আছে। লোহার তৈরি একটি বিশাল শিকল, যার মাথায় নদীতলে কামড়ে ধরার জন্য একটি ওজনদার আংটা।
চিন্তাটা হলো এ রকম: রবীন্দ্রনাথ যদি আজকের নাগরিক হতেন, তা হলে তিনি কলকাতা থেকে সড়কপথে পতিসর আসতেন। তাঁকে পদ্মা নদীর ওপর ফেরি পারপার করতে হতো। কিন্তু আজকে যদি পদ্মা সেতু হতো, তা হলে তিনি পদ্মা সেতু পার হয়ে নির্ঝঞ্ঝাট সড়কপথে চলে আসতে পারতেন পতিসর। অথচ পদ্মা সেতু আমাদের কল্পনায় আছে, বাস্তবে নেই। হবে হবে করেও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে (তথা হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে) ঘোরপ্যাঁচে পড়ে পদ্মা সেতুটি বোধহয় শেষ পর্যন্ত আর হলো না। কাজেই বোধোদয় কোন দিক দিয়ে হওয়া উচিত, এটা সবার কাছে পরিষ্কার।
 অধ্যাপক মোহীত উল আলম: সভাপতি, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.