ভারত মহাসাগর ও এই অঞ্চল

বেঙ্গালুরুতে ভারত মহাসাগরের ওপর অনুষ্ঠিত সেমিনারে নিবন্ধকার কর্তৃক পঠিত আলোচনার ভিত্তিতে লেখা। লেখক বি. রমন ভারত সরকারের সাবেক অতিরিক্ত কেবিনেট সেক্রেটারি এবং চেন্নাই সেন্টার ফর চায়না স্টাডির সহযোগী। শ্রীলঙ্কান গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর : মহসীন হাবিব


১. বঙ্গোপসাগরে ভারতের নিরাপত্তা তিনটি দিক দিয়ে হুমকির সম্মুখীন। প্রথমত, ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব এ অঞ্চলে দিন দিন ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এ অঞ্চলে ক্রমাগত চীনের উপস্থিতি। তৃতীয়ত, সোমালি জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণহীন তৎপরতা।
২. শ্রীলঙ্কা সরকারকে সফলভাবে এলটিটিইর বিরুদ্ধে অপারেশনে সহায়তা দেওয়ার পরও ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব শ্রীলঙ্কার মতো অন্য কোথাও খাটো হয়নি। আমরা না পেরেছি শ্রীলঙ্কার তামিলদের স্বার্থ রক্ষা করতে, না পেরেছি ভারতীয় তামিল জেলেদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনতে। তাদের বেঁচে থাকতে হয় শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনীর করুণার ওপর।
৩. শ্রীলঙ্কার তামিলদের দুঃসহ জীবনের ব্যাপারে আমরা বারবার একটি রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করেছি। এবং ভারতীয় তামিল জেলেদের ওপর নিষ্ঠুর ও পাশবিক আক্রমণের ব্যাপারে রাজাপাকসে সরকারের কোনো দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়নি। ভারতের স্বার্থের ব্যাপারে স্পর্শকাতর হওয়ার অভিনয় করলেও রাজাপাকসে কোনো পরিণতির তোয়াক্কা না করে বিষয়গুলোকে অবহেলা করে চলেছেন। তিনি ভয় পান না। কারণ তিনি মনে করেন, এ জন্য কোনো পরিণতি তাঁকে ভোগ করতে হবে না।
৪. শ্রীলঙ্কার ব্যাপারে আমাদের দ্বিধার পেছনে মূল কারণ হলো, ভারতের একার নৌশক্তি ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের স্বার্থ রক্ষায় যথেষ্ট নয়। ভারত মহাসাগরে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করার একটি রাজনৈতিক ইচ্ছা ও সাহস প্রয়োজন।
৫. শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যে নেতিবাচক সম্পর্ক চলছে, তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে মালদ্বীপ, মরিশাস ও সিসেলসের সঙ্গে। ভারতের স্বার্থ রক্ষায় যদি নেতারা আরো সচেতন না হন, তাহলে কয়েক মাসে না হলেও কয়েক বছরের মধ্যে এই দ্বীপদেশগুলোর সঙ্গে এ ধরনের নেতিবাচক সম্পর্ক সৃষ্টি হবে।
৬. চীন এবং মালদ্বীপের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও সৌভাগ্যবশত সেখানে ভারতীয় স্বার্থ ভালোভাবেই টিকে আছে। মালদ্বীপ সরকার নিরাপত্তার প্রশ্নে, বিশেষ করে বর্তমান সময়ের পাকিস্তানভিত্তিক জিহাদ-শক্তি এবং সোমালি জলদস্যুদের ব্যাপারে ভারতের দিকে চেয়ে আছে।
৭. একই রকম পরিস্থিতি বিদ্যমান সিসেলসের ব্যাপারেও। জলদস্যু মোকাবিলায় শক্তি সঞ্চয়ে চীনের সহায়তা প্রদানের প্রস্তাব সত্ত্বেও সিসেলসের সরকার ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারেই আগ্রহী।
৮. কিন্তু ২০০৯ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট হু জিন থাওয়ের সফরের পর থেকে মরিশাসকে নিয়ে উদ্বেগের কারণ সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর সফরের সময় চীন মরিশাসের বিমানবন্দর বিস্তৃত ও আধুনিক করার জন্য সর্বনিম্ন সুদে ২৬০ মিলিয়ন ডলার প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ২০০৮ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ১১.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বিনা সুদে আরো ৫.৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী নবীন চন্দ্র রামগুলাম উল্লেখ করেছেন, দুই দেশের মধ্যে মরিশাসের রাজধানীর সম্ভাব্য পরিবহন উন্নয়ন নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে।
৯. চীনা আইটি প্রতিষ্ঠান হু মরিশাসের রাজধানীর উত্তরে ইকোনমিক অ্যান্ড ট্রেড জোন গড়ে তোলার জন্য ৭৩০ মিলিয়ন ডলার তহবিল দিয়েছেন।
১০. ৫২১ একর জমিতে এই বাণিজ্য অঞ্চলটি চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। চীনের ভাষ্য অনুযায়ী, এটা হলো 'আউটগোয়িং পলিসি' এবং আফ্রিকা স্ট্র্যাটেজি। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে নির্মাণকাজ ও বাণিজ্য প্রকল্পের জন্য মরিশাসকে চীন প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে।
১১. যে করপোরেট সিটি চীন তৈরি করছে, তা ভারতের সহায়তায় তৈরি এবেন সাইবার সিটির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে। সেখানে চীনের আইটি কম্পানি হুয়াই কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে।
১২. লন্ডনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল। যার শিরোনাম ছিল, 'চায়না মেইকস ফোরে ইন্টু মরিশাস'। সেখানে বলা হয়েছিল, চীনের রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ভারতকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আফ্রিকায় কর্মকাণ্ডের জন্য বেইজিং ভারত মহাসাগরে ৭০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ইকোনমিক জোন গড়ে তুলছে।
১৩. শ্রীলঙ্কায় যেমন অব্যাহতভাবে ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব কমেছে, তেমনি এখন আমরা মরিশাসেও একই রকম কমতে দেখছি। অথচ দেশটিতে ভারতের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব থাকার কথা। এখানে ভারতের সাংস্কৃতিক প্রভাব রয়েছে, কিন্তু অর্থনৈতিক প্রভাব চীনের বেশি। এভাবে চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি হলে কি রাজনৈতিক প্রভাবও সৃষ্টি হবে না?
১৪. আমরা স্বীকার করি আর না-ই করি, ভারত মহাসাগরে ভারতের প্রভাব দিন দিন খাটো হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের উপকূলে চীনের প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। মরিশাসে অর্থনৈতিক সিটি এবং এয়ারপোর্ট, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ, কলম্বো বন্দরের আধুনিকায়ন ও বিস্তার, শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন অঞ্চলে রেলওয়ে নির্মাণ ও মেরামত এবং মিয়ানমারের কিউকপিয়ুতে নতুন বন্দর নির্মাণের কাজ চলছে। কিউকপিয়ু থেকে ইউনান পর্যন্ত গ্যাস ও তেল পাইপলাইন সংযোগ করা হচ্ছে, যাতে পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকা থেকে আসা ট্যাংকার সরাসরি ইউনান পর্যন্ত পেঁৗছে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরকে আধুনিক করার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের আলোচনা চলছে। আলোচনা চলছে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে রেল সংযোগের। চীন হলো মিয়ানমারে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশ। প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারে পেঁৗছে গেছে এই বিনিয়োগ।
১৫. ভারত মহাসাগর অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে চীনের কিছু সুবিধা আছে, যা ভারতের নেই। চীনের আছে বিশাল অঙ্কের ক্যাশ রিজার্ভ এবং অবকাঠামো নির্মাণের দক্ষতা।
১৬. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমানতালে না গেলে সর্বোচ্চ নৌবাহিনীও কোনো কাজে আসবে না। জলে বেইজিংয়ের উত্তরোত্তর উপস্থিতি ভারতীয় রাজনীতির জন্য আরো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে।
১৭. বর্তমান চীনের এই অঞ্চলে বড় স্বার্থ হলো, এখানে তার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা। অর্থনৈতিক শক্তি যখন একটি অঞ্চলে শক্তিশালী হয়, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই রাজনৈতিক প্রভাবও শক্তিশালী হয়। হ্যাঁ, চীন একটি শক্তিশালী সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের সঙ্গে। এই একই সম্পর্ক বাংলাদেশের সঙ্গেও গড়ে উঠছে বলে যে কেউ মনে করতে পারে। এই সম্পর্কগুলোর মধ্যে কি এ অঞ্চলে সেনা উপস্থিতি তৈরি করার সুচিন্তিত কোনো কৌশল রয়েছে? অবশ্য এমন সন্দেহের এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.