পর্যটন-বাংলাদেশের রয়েছে অমিত সম্ভাবনা by জি এম কাদের

পর্যটন খাত বর্তমান বিশ্বে একটি অতি সম্ভাবনাময় এবং বিশাল অঙ্কের অর্থকরী শিল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মানুষ জন্মগতভাবে অনুসন্ধিৎসু বা কৌতূহলী। মানুষ অজানাকে জানতে চায়, অদেখাকে দেখতে চায়, নতুন কিছুকে উপলব্ধি করতে চায়। মানুষ আদিকাল থেকে সে উদ্দেশ্যে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছে।

সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কারিগরি ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে, পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে। গ্লোবাল ভিলেজ হিসেবে বিবেচিত পৃথিবীতে এখন অল্প সময়েই যাওয়া যায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে।
আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্যমুক্ত হচ্ছে বিশ্বের বিপুল জনগোষ্ঠী। ফলে এখন বিশ্বব্যাপী ভ্রমণপিপাসু মানুষ বা পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে। বিশ্বে পর্যটনশিল্প থেকে বর্তমানে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার অর্থের ব্যবসা হচ্ছে এবং এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে উচ্চহারে—২০০৯-১০ অর্থবছরে ৭ শতাংশ এবং পূর্ববর্তী প্রতিবছর প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ শতাংশ। সামনে প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হতে পারে।
সার্ক দেশগুলো সম্মিলিতভাবে এই ব্যবসার মাত্র ১ শতাংশের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যার প্রায় অর্ধেকের সঙ্গে এককভাবে সম্পৃক্ত। ১ শতাংশ হচ্ছে এক হাজার কোটি ডলার। বাংলাদেশ ২০১০ সালে পর্যটন খাতে আয় করেছে সাত কোটি ৮৩ লাখ ডলারের কাছাকাছি, অর্থাৎ ১০ কোটি ডলারেরও কম। এটা খুব সহজেই ১০০ কোটি ডলারে উন্নীত করা যায়। ১০ লাখ পর্যটক গড়ে এক হাজার ডলার খরচ করলে ১০০ কোটি ডলার আয় হবে। আমাদের মতো দেশে ১০ লাখ পর্যটকের আগমন সম্ভাবনাকে উচ্চাশা বলা যায় না।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য সুখবর হলো, পর্যটকেরা উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিড় জমাত, তারা এখন নতুন নতুন দেশের সন্ধানে উন্মুখ। তারা আগ্রহ দেখাচ্ছে সার্কভুক্ত দেশসহ আশপাশের অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত দেশগুলোতে। পর্যটনশিল্পের বিশালত্বের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পর্যটন খাতে অধিক বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে। আমাদের অঞ্চলের দিকে নতুন উৎসাহ সৃষ্টি হওয়ার কারণে এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ পর্যটন উন্নয়নে বিশেষ মনোযোগী হয়েছে।
সার্ক অন্তর্ভুক্ত নেপাল, শ্রীলঙ্কা ২০১১ সালকে পর্যটনবর্ষ ঘোষণা করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া ২০১১ সালকে পর্যটনবর্ষ ঘোষণা করেছে। মালদ্বীপ, ভুটান, ভারত পর্যটন উন্নয়নে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে। ইরান, তুরস্ক, কাজাখস্তান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের মরু-অধ্যুষিত আরব আমিরাত, কাতার, সৌদি আরবসহ আরও অনেক দেশ পর্যটন উন্নয়নে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। সেই অনুপাতে তারা আয়ও করছে।
বাংলাদেশ পর্যটন-প্রসিদ্ধ দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রগামী হবে—এই প্রত্যাশা সবার। পর্যটন খাতে সর্বস্তরের বিভিন্ন সরকারি মন্ত্রণালয়ের প্রয়াস সমন্বিত করার লক্ষ্যে আমরা সরকার গঠনের পর পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে প্রধান করে আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় কমিটি, মন্ত্রীকে প্রধান করে পর্যটনসংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি, অর্থমন্ত্রীকে প্রধান করে পর্যটনসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান করে জাতীয় পর্যটন কাউন্সিল গঠন করেছি।
প্রতিটি জেলায়, জেলা প্রশাসকের অফিসে একটি পর্যটন সেল গঠন করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, ওই সেল এলাকার পর্যটন আকর্ষণসমূহ চিহ্নিত করবে, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করবে, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ ও সার্বিক পরিচালনার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। পর্যটকদের গাইড, সেবা, যানবাহন ও নিরাপত্তার বিষয়ে এই সেল সহায়তা দেবে। জেলা পরিষদের তহবিল থেকে এ বাবদ ব্যয় নির্বাহ করা হবে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় চাহিদা অনুযায়ী জেলা পরিষদকে এ-সংক্রান্ত অর্থ জোগান দেবে। জাতীয় বাজেটে এর জন্য বরাদ্দের বিষয়টি থাকবে।
কক্সবাজার ও কুয়াকাটার জন্য ব্যাপক এলাকা জরিপ করে দুটি ভিন্ন মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কক্সবাজারের উন্নয়নে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে কক্সবাজার ডেভেলপমেন্ট অথরিটি কর্মপ্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যৎ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে পর্যটন সুবিধাদি গড়ে উঠবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন কিছু কিছু পর্যটন-সুবিধা বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজনানুযায়ী ক্রমান্বয়ে নির্মাণ ও পরিচালনা করে যাচ্ছে। সুন্দরবনকে ঘিরে পর্যটন বিকাশের লক্ষ্যে সাতক্ষীরা জেলার মুন্সীগঞ্জে একটি মোটেল তৈরি এবং মংলায় অবস্থিত পর্যটন মোটেলটির ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই একটি বাস্তবসম্মত ও সুবিন্যস্ত পর্যটন নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে। পর্যটন আকর্ষণ সংরক্ষণের জন্য ইতিমধ্যে আইনি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। বিদেশিদের বিশেষ ধরনের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে বিশেষ পর্যটন অঞ্চল আইন করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে সংরক্ষিত এলাকা তৈরি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
আমরা ২০১১ সালকে পর্যটনবর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছি। ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে বর্তমানে দেশকে ব্র্যান্ডিং করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন আমাদের দেখার বিষয় হলো, পর্যটন অগ্রগতি উন্নয়নের বাধাগুলো কী? এ বিষয়ে করণীয় কী? পর্যটন-সফল দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে যে শিক্ষণীয় বিষয় লক্ষ্য করা যায় তা হলো, পর্যটন শুধু কোনো একজন মন্ত্রীর বা একক কোনো মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। এর সঙ্গে সরকারের সব মন্ত্রণালয়ের সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ সম্পূর্ণ সরকারকে সমন্বিতভাবে পর্যটন বিকাশের কাজে সম্পৃক্ত হতে হবে। উল্লেখ্য, সরকারের একক প্রচেষ্টাও যথেষ্ট নয়। সরকারের সঙ্গে পর্যটন-সংশ্লিষ্ট সব মহল, ব্যবসায়ী, সমাজের সর্বস্তরের লোকজন এমনকি বিরোধী দলের সহযোগিতাও আবশ্যক। আর সবারই পর্যটন সম্পর্কে সংবেদনশীল হওয়া জরুরি। সত্যিকার অর্থে পর্যটনকে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এটিকে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করার কোনো বিকল্প নেই। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভুটান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, ভারত প্রভৃতি দেশ এভাবেই বিষয়টিকে গ্রহণ করছে।
সরকারপ্রধানের সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা, তত্ত্বাবধান এবং জাতীয়ভাবে পর্যটনকে অগ্রাধিকার তালিকায় বিবেচনা করাই হলো পর্যটনের সম্ভাবনাকে বিভামণ্ডিত করার পূর্ব শর্ত। যেসব দেশ পর্যটনে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি সাধন করেছে বা করছে, সেগুলোর সরকারপ্রধান এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকে এবং জাতীয়ভাবে গুরুত্ব দিয়ে এর উন্নয়ন সাধন করা হয়।
পর্যটনশিল্পে আমরা এখনো পর্যটন-সফল দেশের স্তরে পৌঁছাতে পারিনি। এর প্রধান কারণ, পর্যটন বিকাশে সম্ভাবনা ও সুফল সম্পর্কে জাতীয়ভাবে আমাদের আস্থার অভাব। একটি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে আমাদের ধারণা, প্রাথমিকভাবে জনগণের সামনে কিছু বাস্তব অগ্রগতি উপস্থাপন করা জরুরি।
আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলি, প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়বস্তু, স্থাপত্যশৈলী এবং নিজস্ব সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ও আদিবাসী সংস্কৃতির বৈচিত্র্য, বিভিন্ন উৎসব ও দিবস পালনের আকর্ষণ অদম্য। তা ছাড়া এ দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হলো কষ্টসহিষ্ণু, হাস্যোজ্জ্বল, পরিশ্রমী, অতিথিপরায়ণ বিভিন্ন কাজে দক্ষ মানুষ।
পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা সরকারি, বিশেষ করে বেসরকারি পর্যায়ে যথেষ্ট গড়ে উঠেছে। এই খাতে মোটামুটি সেবা দেওয়ার মতো জনশক্তি কাজ করে যাচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, এখন যদি বিশ্বের পর্যটকদের কাছে আমাদের দূতাবাসের সহযোগিতায় পর্যটনসংক্রান্ত পুস্তিকা, বিভিন্ন প্রচারসামগ্রী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলার মাধ্যমে আমাদের ভাবমূর্তি তুলে ধরা যায়; ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচার এবং বিদেশি বুদ্ধিজীবী ও ট্যুর অপারেটরদের উদ্দেশ্যে দেশে ফেমিলিয়ারাইজেশন ট্যুর যদি কার্যকর করা যায়, তাহলে প্রচুর পর্যটক বাংলাদেশে আসতে শুরু করবে। নতুন চাহিদা সৃষ্টি হলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন এবং নতুন নতুন সুবিধা সৃষ্টি করবেন।
তবে বিদেশি পর্যটকদের দেশে আগমন অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয় জটিল, সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল ভিসা গ্রহণের বাধ্যবাধকতার কারণে। সে জন্য সার্কভুক্ত সব দেশের মধ্যে একতরফা অন এরাইভাল ভিসা প্রথা চালু করা প্রয়োজন। তা ছাড়া আশপাশের অন্যান্য দেশ এবং যেসব দেশ থেকে পর্যটক আসার সম্ভাবনা আছে, সেসব ক্ষেত্রেও যত দূর সম্ভব অন এরাইভাল ভিসা প্রথা চালু করা বা সহজে ভিসা পাওয়ার ব্যবস্থা করা আবশ্যক।
পর্যটনসংশ্লিষ্ট কার্যাবলি, বিশেষ করে ব্যাপকভাবে প্রচারণারকাজে বাজেটে সুস্পষ্ট বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে অন্তত ২৫০ কোটি টাকার বাজেট প্রাক্কলন করা হয়েছে। ১০ লাখ পর্যটকের আগমন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে ১০০ কোটি ডলারের ব্যবসা সম্ভব হবে। এই হিসাবে আয়ের তুলনায় বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই কম। আমাদের প্রতিবেশী অনেক দেশ এর চেয়ে বহু গুণ বেশি প্রচারণা খাতে খরচ করছে।
তা ছাড়া কর রেয়াত খাতসমূহের তালিকায় গত অর্থবছর পর্যটনকে রাখা হয়েছিল, যা এবার প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখনো পর্যটন খাত যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। এ বছর পর্যটন খাতকে কর রেয়াতের তালিকায় রাখা প্রয়োজন।
পর্যটন বিকাশে সহায়ক কর্মকাণ্ড অনেক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে সম্পাদিত হয়। পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় যৌথ পর্যটনসহায়ক প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলে পর্যটনবিষয়ক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা প্রচুর। বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে এর বিকাশ সহজতর হয়েছে। কর্মসংস্থানের সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনে পর্যটনশিল্প বিরাট অবদান রাখতে পারে। নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে এই আস্থা সৃষ্টিই এখন বাংলাদেশে এই শিল্পের বিকাশে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
জি এম কাদের: মন্ত্রী, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।

No comments

Powered by Blogger.