বিজ্ঞান শুধু পুরুষদের জায়গা নয় by খালেদা ইয়াসমিন ইতি

৮৭৯ সাল। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের জনক প্লাংক যখন মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি নিচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়টাতে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে জন্মগ্রহণ করেন চার কিংবদন্তি লিস মিটনার, অটোহ্যান, আলবার্ট আইনস্টাইন এবং ম্যাক্স ভন লু। এই চার বিজ্ঞানীই পদার্থবিজ্ঞানের সনাতন নিয়মের গণ্ডি পেরিয়ে নতুন নিয়মের ভিত্তি গড়ে তুলেছিলেন। উপরোক্ত চার প্রতিভাবান ব্যক্তিই ছিলেন পরস্পর ঘনিষ্ঠ বন্ধুু।


মিটনারের জন্ম ১৮৭৮ সালে, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে। ১৯০২ সালে মিটনার পদার্থবিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র এবং রসায়নবিদ্যার ওপর ক্রমাগতভাবে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯০৬ সালে মিটনার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। উল্লেখ্য, এ ডিগ্রি অর্জনে তিনিই ছিলেন দ্বিতীয় নারী, প্রথম নারী ছিলেন মাদাম কুরি। এরপর তার পরমাণুবিজ্ঞানী অটোহ্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। সময়টা ছিল ১৯০৭ সালের ২৮ নভেম্বর। তারা একসঙ্গে কাজ করেছেন ৩০ বছর। ১৯০৮ সালে মিটনার এবং হ্যান তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আবিষ্কার করেন তেজস্ক্রিয় উৎপাদক একটিনিয়াম সি। ১৯০৯ সালে মিটনার তার সহকর্মী হ্যানের সহায়তায় তাদের এ যৌথ কাজের বিবরণ লিখে পাঠান জার্মান ফিজিক্যাল সোসাইটিতে। এর ফলে তিনি এমিল ফিশার ইনস্টিটিউট থেকে তার কর্মক্ষেত্রে সব সুবিধা পাওয়ার অনুমতি পান। অথচ এমিল ফিশার ইনস্টিটিউটে প্রথমে তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি নারী হওয়ার অপরাধে, প্রতিভাবান গবেষকদের মনোযোগ ক্ষুণ্নম্ন হবে এই আশঙ্কায়। যেহেতু তিনি ছিলেন আকর্ষণীয়া। তারপরও প্লাংকের ব্যক্তিগত চেষ্টায় তিনি পরমাণু বিজ্ঞানী অটোহ্যানের কার্পেন্টারি শপে কাজের সুযোগ পান। তিনি তার কাজকর্ম, নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতা, শৃঙ্খলার মাধ্যমে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞান শুধু পুরুষদের জায়গা নয়, এখানে নারীরাও কাজ করে, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
১৯১২ সালে প্রথমে অটোহ্যান, পরে লিস মিটনার রসায়ন বিজ্ঞানের জন্য বার্লিনের কাইজার উইলহেম ইনস্টিটিউটের সদস্যপদ লাভের সুযোগ পান। পরবর্তী সময়ে এ প্রতিষ্ঠানের নাম হয়েছিল ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট। ১৯১৭ সালে হ্যান, মিটনারের সঙ্গে কাজের সময় তারা আরও একটি নতুন মৌল আবিষ্কারে সক্ষম হন। এ বিরল মৌলটির পারমাণবিক সংখ্যা ৯১, নাম দেন প্রোটেক্টিনিয়াম।
ভাবতে অবাক লাগে, এ মিটনারকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করতে ১৫ বছর সময় বেশি লেগেছিল। অথচ তার তিন বন্ধু ম্যাক্স ভন লু, অটোহ্যান, আলবার্ট আইনস্টাইন যারা একাডেমিক পড়াশোনার ক্ষেত্রে তার সমসাময়িক ছিলেন তারা মিটনারের ১৫ বছর আগেই সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। তার অপরাধ, তিনি ছিলেন নারী। কেননা, সেই সময় প্রুশিয়াতে এ ধরনের পরীক্ষায় নারীদের কখনও অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হতো না। অপর্যাপ্ত বিজ্ঞানসম্মত ডিগ্রির কারণে তার কিছুই করার ছিল না। তাই মিটনার তার যোগ্যতা প্রমাণের জন্য তেজস্ক্রিয়তার মূল অংশ বিটা রশ্মির বর্ণালীর ওপর একটি থিসিস জমা দেন। তাছাড়া 'লু' সুইজারল্যান্ডের শিক্ষা অনুষদে সুপারিশমূলক একটি পত্র লিখে পাঠান মিটনার, বিশ্বে এমন একজন নেতৃত্বস্থ্থানীয় গবেষক, অতএব তাকে, তার যথার্থ সম্মান খুবই জরুরি। বহু চেষ্টার পর তিনি ওই প্রাতিষ্ঠানিক অনুষদে নিজের স্থান অধিকার করেন। এখানে গবেষণার বিষয় ছিল 'মহাজাগতিক প্রক্রিয়ার (পড়ংসরপ ঢ়ৎড়পবংং) ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়ার তাৎপর্য।' অথচ একটি সংবাদপত্র ব্যঙ্গ করে তা প্রচার করল কসমেটিক প্রক্রিয়া শিরোনামে। তারা এ কাজটি সজ্ঞানে বা নিজের অজান্তে করে থাকুক না কেন; এ ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এ যেন পুরুষশাসিত সমাজের দীর্ঘ ধারাবাহিকতার ফল, যে ধারাবাহিকতা একজন সৃষ্টিশীল নারীর প্রতিভাকে এমন নির্মমভাবে পরিহাস করতে শিখিয়েছে।
১৯৩৬ সালের শেষে ম্যাক্স ভন লু প্রস্তাব করেন হ্যান ও মিটনারকে একই সঙ্গে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার জন্য। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো : অটোহ্যান, ফ্রিটজ স্ট্রাস ম্যানের সঙ্গে নিউক্লিয়ার বিভাজনের ওপর সম্মিলিত আবিষ্কারকে উপস্থাপন করা হয় হ্যানের একক কাজ হিসেবে; যে কারণে হ্যান একাই নোবেল পুরস্কার পান। আর দুঃখজনক হলো সেই পুরস্কার তিনি গ্রহণ করেছিলেন, ৩০ বছরের বিশ্বস্ত বন্ধুত্বের হাতকে কিছুটা হলেও কলঙ্কিত করেছিলেন। ১৯৬৮ সালের ২৮ জুলাই তার ৩০ বছরের কাজের সহযোগী হ্যানের মৃত্যুর ৪ মাস পর ২৭ অক্টোবর ইংল্যান্ডের ক্যাম্ব্রিজে গভীর রাতে মারা যান। এর কিছুদিন পর পালিত হয় তার ৯০তম জন্মবার্ষিকী। তার সম্মানে একটি মৌলিক পদার্থের নাম রাখা হয়, নামটি হলো মিটনিয়াম।
 

No comments

Powered by Blogger.