উৎসবের নাম কারাম by ইলিন আহমেদ

মোর এত টেরা সিঁথিকাপেরে সিন্দুরা_আজুক দিনা রাইলে গে নাতি,কারাম এক রাতি।...\আমার এমন টেরা সিঁথি। কপালে সিঁদুর। আজকের দিনটা যাও গো নাতি। কারামের এক রাত যে [আজ]_ এমনি গান, তার সঙ্গে বাদ্য আর নাচে মুখর হয়ে ওঠার দিন, কারাম। ওঁরাওদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ওঁরাওদের ধর্মীয় উৎসব হলেও এখন এ উৎসব বাংলাদেশে সমতলে বসবাসকারী আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের জন্য মিলনমেলার একটি উপলক্ষ হয়ে


উঠেছে। আর মুণ্ডা বা পাহানদের মধ্যে তো প্রায় একই নিয়মে এই কারাম বা ডাল-পূজা প্রচলিত। তাই কারাম এলেই জেগে ওঠে রাজশাহী, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের ওঁরাও পল্লী চাঁদের তিথি অনুসারে ভাদ্র বা আশ্বিন মাসের পূর্ণিমায় কারাম উৎসব হয়ে থাকে। ওঁরাও পল্লীর সবাই মিলে বারোয়ারি ঢংয়ে এ উৎসব করে থাকে। বাড়ির বাইরে খোলা জায়গায় প্রথমে একটা বেদি করা হয়। একজন অবিবাহিত যুবক পাতাসহ খেল-কদমের ডাল কেটে এনে সেই খানে পুঁতে দেয়। বিকেল থেকে শুরু হয়ে যায় কারামের এসব আয়োজন। পাড়ার নারী-পুরুষ, শিশু বেদিকে কেন্দ্র করে গোল হয়ে বসে যায়। সন্ধ্যার কিছু পর শুরু হয় পূজার মূল অয়োজন। রীতি অনুসারে পাড়ার প্রবীণ ব্যক্তিটি পুরোহিতের আসনে বসেন। তিনি অপারগ হলে অন্য কোনো প্রবীণজন পূজার পুরোহিতের কাজটি সম্পাদন করেন।
বাঁশের ডালায় ধুপ, সিঁদুর, খাগরাই, বাতাসা, শসা, কলা, রক্তহলা, ধানের পাতা, ধান, মাষকলাই, যব, নদীর বালি প্রভৃতি দিয়ে সাজানো হয় তিনটি নিবেদন পাত্র। এরপর তিনজনে তিনটি নিবেদন পাত্র নিয়ে এসে উৎসর্গ করেন কদমের ডাল পোঁতা বেদিতে। ওঁরাওদের সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধির জন্য এ উৎসর্গ। যারা উৎসর্গ করবেন তাদের উপবাস থাকতে হয়। তিনজন না পারলে দু'জন, তাও না পারলে একজনই উপবাস থেকে উৎসর্গের কাজটি চালিয়ে নিতে পারেন। ডালা উৎসর্গের সময় মেয়েরা সমস্বরে উলুধ্বনি দিয়ে ওঠে, বাজানো হয় বাদ্য। যারা পূজায় অংশ নেবে তারা বেদির কাছাকাছি গোল হয়ে বসে যায়। তাদের প্রত্যেকের হাতে প্রদীপ, রুটি, দূর্বাঘাস, আতপ চাল প্রভৃতি দিয়ে সাজানো একটি করে থালা। ছেলে-মেয়ে উভয়ই পূজায় অংশ নিতে পারে।
ডালা উৎসর্গের পর পুরোহিত 'ধর্ম-কর্ম'র গল্প শুরু করেন। গল্পের এক পর্যায়ে পুরোহিত সবাইকে ধর্মের গাছ ধরতে বললে সবাই উলুধ্বনি দিয়ে বেদিতে পোঁতা খেল-কদমের ডালটি ধরে। ছেড়ে দিতে বললে ডাল ছেড়ে আবার নিজ আসনে যেয়ে বসে। গল্পের আরেক পর্যায়ে পুরোহিত সবাইকে বসার পিঁড়ি উল্টে ধরতে বলেন। ডালা উৎসর্গকারীসহ সবাই পিঁড়ি উল্টে ধরেন। তখন পুরোহিত জানতে চান পিঁড়ি উল্টে কী পাওয়া গেল? কেউ বলে বেটা পেয়েছি, কেউ বলে বেটি পেয়েছি। গল্পের শেষ পর্যায়ে পুরোহিত ডালে ফুল, জল ছিটিয়ে দিতে বললে উপবাসীরা তা-ই করে। সবশেষে নিবেদন, ডালা থেকে অর্ঘ্য নিয়ে ডালের গোড়ায় নিবেদন করে পুরোহিত পূজা শেষ করেন।
পূজা শেষে বিতরণ করা হয় খাবার। রুটি-সবজি যাই থাক হাঁড়িয়া থাকতে হবে অবশ্যই। খাওয়ার পর্ব শেষ হতে না হতেই একদল বুড়ো ঢোল, মাদল, জুড়ি, করতাল নিয়ে বসে যান। শুরু হয় গান। গান আর বাদ্যের তালে নাচ। একদল ছেলে এবং একদল মেয়ে কখনও পাশাপাশি, কখনও মুখোমুখি গান গায় আর নাচে।
দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের গাঁথা সে গান। স্বপ্ন আর সুন্দর দিনের আকাঙ্ক্ষার সে গান। শরৎ-পূর্ণিমায় দুধ সাদা মেঘ উড়ে উড়ে যায়। বাতাসে কাঁপে সবুজ ধানের পাতা। দূরের গ্রামগুলো জবুথবু, জবুথবু। তখনও ওঁরাওপাড়ায় চলতে থাকে গান আর নাচ, নাচ আর গান_
শাশুর ঘরে নাই রাসে/রিঝ নাহিজ লাগে পরদেশী
পরদেশী ঘরে...
 

No comments

Powered by Blogger.