দাঙ্গা দেশে দেশে

দাঙ্গাই মানুষের ভেতর থেকে খারাপটাই বের করে নিয়ে আসে। দাঙ্গা মানেই মৃত্যু, ধন-সম্পদের ক্ষতি, ধর্ষণ ও লুটতরাজ। আবার কেউ কেউ হয়তো বা বলতে পারেন দাঙ্গা মানে পরিবর্তন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দাঙ্গা ভীতির সঞ্চার করে। এই তো কিছুদিন আগের ইংল্যান্ডে দাঙ্গাও কম উত্তাপ ছড়ায়নি। এখানে এ রকম কিছু দাঙ্গার কথা উপস্থাপন করেছেনতারজিন ইসলাম এ্যানী


বোম্বে দাঙ্গা\১৯৯২ সালে বোম্বেতে ইন্ডিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ডিসেম্বরের ছয় তারিখে বাবরি মসজিদ পুড়িয়ে দেওয়া হলে শুরু হয় দাঙ্গা। বলা হয়, দাঙ্গাটি শুরু হয় দু'ভাবে। প্রথম ভাগে মুসলমানরা আক্রমণ করে হিন্দুরা তাদের মসজিদ পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে। আর দ্বিতীয় ভাগে হিন্দুরা আক্রমণ করে মুসলমানদের। সব মিলিয়ে ৯০০ মানুষ নিহত হয় সেই দাঙ্গায়। বাকি সব দাঙ্গার মতোই লুটতরাজ, অগি্নসংযোগ, লুণ্ঠন সংঘটিত হয়।
টালসা রেস দাঙ্গা
১৯২১ সালে আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ দাঙ্গা সংঘটিত হয়। যখন একটি সাদা মহিলা লিফট অপারেটর অভিযোগ করে যে, একজন কালো মানুষ তাকে যৌন হয়রানি করেছে_ এতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সেই লোকটি ওই স্থান থেকে পালিয়ে যায়, আর সবাই তাকে খুঁজতে শুরু করে। এ থেকে শুরু হয় দাঙ্গা। যার ফলে শত শত মানুষ মারা যায়। পরিস্থিতি এত খারাপ পর্যায়ে চলে যায় যে, সাদা আর কালো দুটি দলই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। সব মিলিয়ে ৩৫টি শহরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, দশ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে এবং ২১ মিলিয়ন ইউএস ডলারের ক্ষতি হয়।
গুজরাট দাঙ্গা
২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক মুসলিম ডাকাত একটি ট্রেন আক্রমণ করে পুড়িয়ে ফেলে। ফলে ৫৮ জন হিন্দু যাদের মধ্যে বেশিরভাগই মহিলা আর শিশু যারা অযোধ্যা থেকে ফিরছিল_ তারা মারা যায়। এর ফলে মুসলমানদের ওপর হামলা শুরু হয়। এরপর শুরু হয় ব্যাপক দাঙ্গা। এতে ৭৯০ জন মুসলিম আর ২৫৪ জন হিন্দু মারা যায় এবং ২২৩ জন মানুষ নিখোঁজ হয়। ৫২৩টি ধর্মীয় স্থান নষ্ট করা হয়; ২৯৮টি মন্দির, ২০৫টি মসজিদ, ১৭টি টেম্পল আর ৩টি চার্চ। মুসলমানদের ব্যবসা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৬১ হাজার মুসলমান আর ১০ হাজার হিন্দু তাদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়।
নাইরোবি দাঙ্গা
২০০৭ সালের ডিসেম্বরে রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে শুরু হয় মর্মান্তিক দাঙ্গা। যেটাকে বলা হয়, একটি বিশাল হুমকি পূর্ব আফ্রিকার স্থির গণতন্ত্রের প্রতি। নাইরোবি, কেনিয়ার বাসিন্দারা বিশ্বাস করে যে, মোয়াই কিবাকির পুনর্নির্বাচন ছিল একটা ছল মাত্র। আর এ থেকে শুরু হয় দাঙ্গা। নাইরোবি থেকে উপত্যকা পর্যন্ত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। জানুয়ারি ২৮ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ৮শ'রও বেশি মানুষ নিহত হয়। ৬০০ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। সবচেয়ে মর্মান্তিক পরিস্থিতি হয় যখন একটি চার্চে আগুন লাগিয়ে ৩৫ জন মানুষকে মেরে ফেলা হয়।
ব্রিক্সটন
ব্রিক্সটনের দাঙ্গা লন্ডনের সবচেয়ে খারাপ দাঙ্গার মধ্যে একটি। ১৯৮১ সালের ১০ এপ্রিল পুলিশ এক নিগ্রো ছেলেকে প্রশ্ন করার জন্য আসে। তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল ছুরি চালানোর জন্য। পুলিশ যখন আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করছিল তখন জনতা বাধা দেয়। পুলিশকে আক্রমণ করা হয়। এই ঘটনার পর পুলিশ বেশি করে টহল দেওয়া শুরু করে। ঠিক তার পরের দিনই যেটাকে বলা হয় 'রক্তাক্ত শনিবার'। জনতা পুলিশের গাড়িতে ইটপাটকেল মারতে শুরু করে, যার পরিণতিতে ২৮০ জন আহত হয়, আর তার মধ্যে ৪৫ জন ছিল পুলিশ। এ ছাড়া একশরও বেশি যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
১৯৬৭ সালের ইউএসএ দাঙ্গা
১৯৬৭ সালের দাঙ্গা শুরু হয় যখন পুলিশের একটি দল টুয়েলভ স্ট্রিট আর ক্লেরমাউন্ড এভিনিউয়ের মাঝামাঝিতে অবস্থিত একটি নিগ্রো ক্লাবে তল্লাশি চালায়। তারা আশা করছিল, কিছু পৃষ্ঠপোষক খুঁজে পাবে; কিন্তু দেখা গেল যে সেখানে ভিয়েতনাম থেকে ফিরে আসা দু'জন সৈনিকের উপলক্ষে পার্টি হচ্ছে। পুলিশ সবাইকে অ্যারেস্ট করেলে শুরু হয় দাঙ্গা। পাঁচ দিন লুটতরাজ, হত্যা আর অগি্নসংযোগ স্থায়ী হয়। পরিস্থিতি এত খারাপ পর্যায়ে চলে যায় যে জাতীয় গার্ড আর বিমান বাহিনী নিয়োগ করা হয়। যখন দাঙ্গা শেষ হয় তখন ৪৩ জনেরও বেশি মানুষ নিহত ও ১১৮৯ জন আহত হয়।
আর্জেন্টিনা দাঙ্গা
২০০১ সালের ডিসেম্বরে আর্জেন্টিনাতে জনঅসন্তোষ শুরু হয় আর এটি পরে পরিণত হয় দাঙ্গায়। প্রেসিডেন্ট ফেমান্দো দে লা রুয়াকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় দীর্ঘ তিন বছরের অর্থনৈতিক মন্দার জন্য। মধ্যবিত্ত শ্রেণী সিদ্ধান্ত নেয়, তারা অনেক সহ্য করেছে_ আর এ থেকেই ডিসেম্বরের ১৯ ও ২০ তারিখে শুরু হয় দাঙ্গা। সেই দাঙ্গায় ২৬ জন নিহত হয়। এই দাঙ্গায় অগণিত লুটতরাজের ঘটনা ঘটে।
লসঅ্যাঞ্জেলেস দাঙ্গা
১৯৯২ সালের ২৯ এপ্রিল একজন সাদা পুলিশ অফিসার একজন নিগ্রো মোটোরিস্টকে গ্রেফতার করে ভিডিও টেপ জালিয়াতির জন্য। এই কারণে হাজার হাজার জনতা ছয় দিন ধরে দাঙ্গা চালিয়ে যায়। প্রচুর লুটতরাজ ও হত্যা সংঘটিত হয়। ৫৩ জন নিহত হয়। আর ২ হাজার মানুষ এতে আহত হয়। প্রায় ৮০০ মিলিয়ন থেকে ১ বিলিয়ন ইউএস ডলার পরিমাণ ক্ষতি হয়। প্রায় ৩৬০০ স্থানে আগুন জ্বালানো হয়; এতে ১১০০ বাড়িঘর পুড়ে যায়।
শিকাগো দাঙ্গা
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ওপর আততায়ী হামলার পর জনগণের মধ্যে অশান্তি শুরু হয়। ১৯৬৮ সালের ৫ এপ্রিল শিকাগোর পশ্চিম অঞ্চলে শুরু হয় মারামারি, আর ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে ওয়েস্ট ম্যাডিসন স্ট্রিট পর্যন্ত। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রুজভেল্ট এলাকা, লুটতরাজ আর হত্যা শুরু হয়। মেয়র ডালি বন্দুক আর দাহ্য বস্তুর বিক্রি বন্ধ করে দেন। প্রায় দশ হাজার পুলিশ আর পাঁচ হাজার সৈন্য পরিস্থিতি সামাল দেয়। শেষ পর্যন্ত ১১ জন নিহত হয় আর ১২৫টিরও বেশি স্থান আগুনে জ্বলতে থাকে।

ইংল্যান্ড দাঙ্গা
২০১১ সালের ৪ আগস্ট ইংল্যান্ডে মেট্রোপলিটন পুলিশের গুলিতে নিহত হয় মার্ক ডাগান। দাঙ্গা শুরু হয় উত্তর লন্ডনের টটেনহামে। পরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পরে লন্ডনের আরও অনেক স্টেট আর ইংল্যান্ডের কিছু অঞ্চলে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি হয় বার্মিংহাম, ব্রিস্টল আর ম্যানচেস্টারে। ইংল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম দিকেও ছড়িয়ে পড়ে দাঙ্গা। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরও অনেক ছোট ছোট শহর। লন্ডনব্যাপী শুরু হয় লুটতরাজ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করা। এতে পাঁচজন নিহত ও ১৬ জন আহত হয়। প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ডের সম্পত্তি নষ্ট হয়; আর স্থানীয় অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
 

No comments

Powered by Blogger.