মোবাইল যাপন by আহমাদ শামীম

নিশিতে কল কইরো আমার ফোনে রে বন্ধুয়া, নিশিতে কল কইরো আমার ফোনে!' একটি বেসরকারি মোবাইল ফোন সংস্থার বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছিল এই লাইন দুটি। একটি জনপ্রিয় বাংলা গানের সুর আর কথার অনুকরণে এ বিজ্ঞাপনটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল সে সময়। আমাদের বর্তমান দিনকাল মোবাইল ফোন ছাড়া চিন্তা করা এক প্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিশিতে যেমন ফোন করি, দিনের বেলাতেও কম করি না আমরা। প্রয়োজনে তো বটেই,


অপ্রয়োজনেও ফোন করার অভ্যাস আছে অনেকের। তারপরও প্রযুক্তির প্রসারে হাতে হাতে মোবাইল ফোন এখন আমাদের নিত্যসঙ্গী। কম দামে মোবাইল সেট এবং তার মধ্যেই একের মধ্যে হাজারো সুবিধা, এসব নিয়ে মোবাইলসেট সবারই আরাধ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
মোবাইলের প্রসার ও প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে আগামী দিনে হয়তো মানুষের মৌলিক চাহিদার সংজ্ঞাও পাল্টে যাবে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও মোবাইল! এই ছয়টি বিষয় যদি মৌলিক চাহিদার সীমারেখা হয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ আপনি মোবাইল হাতেই যদি অফিস, বাসা, বিনোদন এবং যোগাযোগের কাজ করতে পারেন, তবে ভাই কী দরকার আমার মোবাইল থেকে এত দূরে থাকার। মোবাইল বা যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি দিনের নয়, মানব সভ্যতার বয়স হিসাব করলে যন্ত্রের আবিষ্কার মনে হবে এই তো সেদিনের! এ কথা সত্য কলের চাকা যেদিন থেকে ঘুরতে লাগল, মানবসভ্যতা সেদিন থেকেই এগিয়ে গিয়েছে অনেক অনেক দূর।
মোবাইলের সঙ্গে নিত্য দিবসযাপন নিয়ে এই লেখা। কীভাবে মোবাইল মিশে আছে আমাদের জীবনের সঙ্গে। সকাল বেলা তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হবে তার জন্য প্রয়োজন মোবাইল। কারণ মোবাইলে আছে এলার্ম সুবিধা। সময় দেখতে হলে মোবাইলেই আছে ঘড়ির সুবিধা। ক্যালেন্ডার দরকার হলে সেটাও আছে। মন খারাপ হলে গান শুনে নিন মোবাইলেই। রাতের বেলা কারেন্ট চলে গেলে মোবাইলে টর্চলাইটের সুবিধাও পাবেন। ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ভিডিও গান দেখা, ক্যামেরায় ছবি তোলাসহ আরও অনেক অনেক সুবিধা। এত সুযোগ-সুবিধা আমরা পকেটে নিয়ে ঘুরছি, ভাবতেই ভালো লাগে!
এবার আসা যাক মোবাইলের মন্দ বিষয়গুলোতে। মোবাইল সেটের অল্প দাম এবং স্বল্প কলরেটের কারণে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ফোন আসে। নারীদের ক্ষেত্রে এই জ্বালাতনের মাত্রা অনেক বেশি। শখ করে কেউ দামি মোবাইল সেট কিনল কিন্তু ভয় আছে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ার। মোবাইলের এমন অসংখ্য সুবিধার পাশাপাশি রয়েছে অসুবিধাও। এসব বলেকয়ে হয়তো শেষ করা যাবে না। তবুও মোবাইলের প্রসার ও সুবিধা আমরা সবাই অল্পতেই পাচ্ছি।
মোবাইল আমাদের এগিয়ে দিয়েছে, যোগাযোগেও করেছে অনেক সুবিধা। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, মোবাইলের কারণে আমরা হারিয়েছি নিজস্ব কিছু কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। একটা সময়ে দূরবর্তী মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। মোবাইলের আধিপত্যে হারিয়ে যাচ্ছে মমতামাখা, আবেগের কালো অক্ষরে লেখা চিঠির প্রচলন, ছোট একটি এসএমএসের মাধ্যমে চিঠির অভাব কতটা মেটে বলা মুশকিল। রানার নামের সেই চিঠিবাহক যেমন হারিয়ে গেছে, স্থান পেয়েছে জাদুঘরে, এমন একদিন হয়তো আসবে যখন চিঠি, ডাকঘর, ডাকবাক্স, ডাকটিকিট এসব ব্যাপার ইতিহাসের অংশ হবে। স্থান পাবে জাদুঘরে।
মোবাইলের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে হতে পারে অনেক তর্ক-বিতর্ক। তবুও মোবাইলের মাধ্যমে আমরা সহজেই অনেক কাজ করি। যার একটা হলো মিথ্যা বলা! কারণ মোবাইলের অপর প্রান্তে যে ব্যক্তি আছে সে আপনাকে দেখতে পাচ্ছে না ফলে সুযোগ এবার যা খুশি তা বলার। কেউ মগবাজার থাকলে নিমিষেই বলে দেয়- 'আমি তো মহাখালী আছি। জরুরি কাজে ব্যস্ত'। যে লোকটি ফোন দিয়েছেন, তিনি যদি একজন পাওনাদার হন তাহলে তো কথাই নেই। মহাখালী না বলে কেউ কেউ হয়তো বলবে- 'আমি ভাই ঢাকার বাইরে'। বাসায় থাকলে অফিসে, অফিসে থাকলে বাসায়_ এভাবে আরও অনেক মিথ্যা কথা বলে আমরা পালিয়ে বেড়াই।
মোবাইলে সংঘটিত অপরাধও বেড়েছে অনেক। মোবাইলে হুমকি দেওয়া, চাঁদা চাওয়া, মেয়েদের ফোন করে উত্ত্যক্ত করাসহ অনেক অপরাধমূলক ঘটনা ও কাজ। এসব ছাপিয়ে আমরা সবাই মোবাইল জ্বরে ভুগছি। আগামীতে হয়তো মোবাইলেরও আকর্ষণ থাকবে না। এর জায়গা দখল করবে অন্য কিছু; কিন্তু মানুষ যেহেতু বর্তমানের বাসিন্দা তাই মোবাইল এখন সবার প্রয়োজন। নিত্যপ্রয়োজনীয় এই অদ্ভুত যন্ত্রের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মোবাইল প্রযুক্তি প্রথম ব্যবহার করা হয়। পরে বিভিন্ন হাত ঘুরে বিভিন্ন ঘটনার জন্ম দিয়ে ড. মার্টিন কুপার এ প্রযুক্তির সফল ব্যবহার ঘটান। ১৯৭৩ সালে তিনি প্রথম সফলভাবে ফোন কল করতে সক্ষম হন। এ কারণেই তাকে মোবাইল ফোনের উদ্ভাবকের মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে।
মোবাইলে শব্দটির সহজ বাংলা অর্থ 'স্থানান্তরযোগ্য'। সুবিধাজনক আকার ও সহজে বয়ে নিয়ে বেড়ানো যায় বলেই এই নাম; কিন্তু আমাদের এখানে মোবাইল শব্দটি একেবারেই নির্দিষ্ট হয়ে গেছে কথা বলার যন্ত্র নামক এই বিশেষ বস্তুতে। তাই মোবাইল কোর্ট, মোবাইল টয়লেটসহ আরও যেসব বয়ে নিয়ে বেড়ানোর ব্যাপার আছে সব কিছুকেই অদ্ভুত মনে হয়েছিল প্রথম প্রথম।
অসংখ্য এলোমেলো কথার ভিড়ে আমরা হারিয়ে যাই প্রতিদিন। কাছের মানুষটির কণ্ঠস্বর যখন কানে আসে সব ধরনের ক্লান্তি আর চিন্তা দূর হয়ে যায়। মোবাইল আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে এ কথা এক অর্থে যেমন সত্য, তেমনি দূরত্বও বাড়িয়েছে। তবুও বলতে হয় মুদ্রার যেমন দু'পিঠ। মোবাইলেরও আছে সুবিধা-অসুবিধা। মোবাইল সৃষ্ট সমস্যাগুলোতো আমাদেরই তৈরি। তাই সমস্যাগুলোকে নিজেরাই দূরে সরিয়ে রেখে মোবাইলের উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তার প্রতি নজর দেওয়া আমাদের সবারই চাওয়া হতে দোষ কী?
নিশিতে কল না করি, প্রয়োজনে কল করে কাছের মানুষটির আরও নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা আজ থেকেই শুরু করলে ক্ষতি নেই। বরং লাভ আছে অনেক।
 

No comments

Powered by Blogger.