‘পেপার স্প্রে’র কারণেই অসুস্থ খালেদা’

গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় অসুস্থতায় ভুগছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া। ৫ই জানুয়ারি বিকালে কার্যালয়ের গেটে তার গাড়ি লক্ষ্য করে পুলিশের পেপার স্প্রে ছোড়ার পর থেকে তিনি এমন অসুস্থতায় ভুগছেন। সোমবার সন্ধ্যার পর থেকে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের নেতৃত্বে তিনজন চিকিৎসকের একটি মেডিকেল টিম তাকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। গতকাল দুপুর আড়াইটার সময় গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. সিরাজউদ্দিন আহমেদ। খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও তার চিকিৎসার খোঁজ-খবর নিয়ে বিকাল ৫টায় তিনি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে আসেন। এ সময় সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। ডা. সিরাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, খালেদা জিয়া অসুস্থ। তিনি এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন। পুরো বিশ্রামে রয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানত তিনি শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। গায়ে জ্বালা-পোড়া আছে। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। আমার সঙ্গে কথা বলার সময়ও কয়েকবার চোখ মুছেছেন তিনি। তার এ অসুস্থতার জন্য সম্পূর্ণভাবে পুলিশের ছোড়া পেপার স্প্রেই দায়ী। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাসপাতালে নেয়ার বিষয়টি আমি বলতে পারবো না। সে বিষয়টি উনার মেডিকেল টিমের ওপর নির্ভর করছে। উনারা যদি মনে করেন, তবে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা নেবেন খালেদা জিয়া। সোমবার অসুস্থ হয়ে পড়ার পর খালেদা জিয়াকে চিকিৎসা দেয়া চিকিৎসক টিমের একজন ছিলেন ইউনাইটেড হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোলজি বিভাগের কনসালটেন্ড ডা. ফাওয়াদ শুভ। তিনি মানবজমিনকে জানান, পেপার স্প্রের কারণে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সোমবার সন্ধ্যার পর শ্বাসকষ্টজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেদিন থেকে তার চোখ ও নাক দিয়ে পানি ঝরছে। সোমবার তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে আমরা গিয়ে তার শারীরিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছি। শ্বাসকষ্টের কারণে তাকে নেবুলাইজার দেয়া হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ মহিলা দল নেত্রী ফারজানা রহমান হোসনা জানান, সোমবার বিকালে তার গাড়ি লক্ষ্য করে পেপার স্প্রে ছুড়ে মারার পর থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মঙ্গলবার তিনি দুইদফা বমি করেছেন। সারাদিনই তার বমি বমি ভাব ছিল। ঘন ঘন কাশি হচ্ছে। এছাড়া জ্বালা-পোড়াসহ শারীরিক ব্যথায় ভুগছেন তিনি। এর আগে খালেদা জিয়ার শারীরিক পরিস্থিতি জানাতে মঙ্গলবার রাতে গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিং করেন তার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান। সেখানে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের অসুস্থতার বিষয়টি জানানোর পাশাপাশি শারীরিক সুস্থতা কামনা করে দেশবাসীর কাছে দোয়া চান। পুলিশের পেপার স্প্রে ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, শহীদ মিনারে শিক্ষকদের ওপর এই পেপার স্প্রে করা হয়েছিল। কয়েকজন আহতসহ একজন শিক্ষক পেপার স্প্রের যন্ত্রণায় নিহতও হয়েছিলেন। এর প্রেক্ষিতে এই স্প্রে ব্যবহার না করার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশও আছে। হাইকোর্টের এ নির্দেশ অমান্য করে সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও দেশের বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসনকে লক্ষ্য করে পেপার স্প্রে করা হয়েছে।
অবরুদ্ধ খালেদার পঞ্চম দিন
এদিকে গুলশানের নিজ রাজনৈতিক কার্যালয়ে পাঁচ দিন ধরে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গত ৩রা জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টায় ওই কার্যালয়ে ঢোকার পর আর বের হতে পারেননি। ৫ই জানুয়ারি সমাবেশকে ঘিরে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গতকালও গুলশান কার্যালয়ের সামনে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় ছিল। কার্যালয়ের সামনের রাস্তার দক্ষিণপাশে একটি জলকামান ও উত্তর পাশে একটি পুলিশ ভ্যান আড়াআড়িভাবে রাখা ছিল। ৫ই জানুয়ারি দুপুরে কার্যালয়ের প্রধান ফটকের বাইরে থেকে পুলিশের দেয়া তালা এখনও ঝুলছে। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে অবরুদ্ধ খালেদা জিয়াকে দেখতে তার কার্যালয়ে আসেন সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ। বেলা আড়াইটার দিকে কার্যালয় থেকে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দেশের একজন প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন- এই খবর শুনে তাকে দেখতে এসেছিলাম। তিনি খুবই অসুস্থ। চিকিৎসাধীন আছেন। তার পক্ষে কথা বলা অত্যন্ত কষ্টকর। তবে তার মনোবল আগে যেমন ছিল এখনও সেরকমই আছে। তিনি মানসিকভাবে অত্যন্ত শক্ত আছেন। এরপর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে গুলশান কার্যালয়ে আসেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব)-এর সভাপতি আ ফ ম ইউসুফ হায়দারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। তবে পুলিশ ৬ জনকে প্রবেশের অনুমতি দেয়। বেলা সোয়া ২টার দিকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বের হন তারা। এসময় সাংবাদিকদের আফম ইউসুফ হায়দার বলেন, খালেদা জিয়া অসুস্থ। তিনি খুব বেশি কথা বলতে পারছেন না। তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। আমরা সকালে ইউট্যাবের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের মাত্র ছয়জনকে কার্যালয়ে প্রবেশের অনুমতি দেয় পুলিশ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ নয়। তাহলে আমাদের প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যদের দেখা করতে দেয়া হলো না কেন?’ তিনি বলেন, খালেদা জিয়া অবিলম্বে নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার অক্ষুণ্ন রাখারও আহ্বান জানান তিনি। খালেদা জিয়া মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ইউসুফ হায়দার বলেন, তিনি ভেঙে পড়েননি। শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেও তিনি মানসিকভাবে শক্ত আছেন। প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হলেন- অধ্যাপক ড. খলিলুর রহমান, অধ্যাপক ড. আজিজ, অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম  চৌধুরী, ড. মো. খোরশেদ আলম খান ও ড. তাহমিনা আখতার টপি। বেলা আড়াইটার দিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিতে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সিরাজউদ্দিন আহমেদ। বিকাল ৫টার দিকে কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অবহিত করেন।  এদিকে কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ পাঁচদিন ধরে নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া নিয়মিত বাসার খাবারই খাচ্ছেন। প্রতিদিন সকালের নাস্তা নিজের বাসা থেকে এলেও দুপুর ও রাতের খাবার আসছে জ্যেষ্ঠ ছেলে তারেক রহমানের শ্বশুরবাড়ি থেকে। ছোট ভাই শামীম এস্কান্দারের স্ত্রী কানিজ ফাতিমা প্রতিদিনই একবার এসে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে যাচ্ছেন। তিনিও খাবার নিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া গতকাল সন্ধ্যায় ছোট বোন সেলিমা ইসলাম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যান। এদিকে ভাত ও মুরগির মাংস পাঠিয়েছেন তারেকের স্ত্রী জোবাইদা রহমানের বড়  বোন শাহীনা খান বিন্দু জামান। কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় নিজের  চেম্বারে অনেকটা শুয়ে-বসে সময় কাটছে তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর। একটি সোফার ওপর কুশনে মাথা রেখে আধ শোয়া হয়ে বিশ্রাম, কখনও একটু হাঁটাহাঁটি, মাঝেমধ্যে দলের ভাইস  চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান ও অন্যান্য নেত্রীদের সঙ্গে গল্প-গুজব করে সময় কাটাচ্ছেন। নিজের চেম্বারের পাশে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বৈঠক কক্ষে পাতা খাটে ঘুমিয়ে রাত কাটাচ্ছেন তিনি। এদিকে ৩রা জানুয়ারি রাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে অবরুদ্ধ হয়ে পড়া কয়েকজন মহিলা নেত্রী কার্যালয় থেকে বাসায় চলে গেছেন। তারা হলেন- সাবেক এমপি আসিফা আশরাফি পাপিয়া, রাশেদা বেগম হীরা,  রেহেনা আক্তার রানু, নিলোফার চৌধুরী মনি, বিলকিস ইসলাম, মহিলা দলের সভানেত্রী নূরে আরা সাফা, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য খালেদা ইয়াসমিন, মহানগর মহিলা দলের সভানেত্রী সুলতানা আহম্মেদ, সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমীন।

No comments

Powered by Blogger.