দুর্নীতিবাজদের নিয়ন্ত্রণে দেশের অর্থনীতি by ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম এমপি

হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারি, ডেসটিনির প্রতারণা, যুবক, ইউনিপেটু ও ঋণ জালিয়াতের কারণে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অনিয়ম, ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতি, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের পথে।
বর্তমান সরকার অর্থনীতিবান্ধব না হওয়ায় এবং সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণে রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, স্টক এক্সচেঞ্জ মূল্যসূচক, অর্থ পাচার, আমদানি-রপ্তানি, রাজস্ব আদায়, সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগ, মুদ্রা সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতিসহ সব সূচকই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে অর্থনীতি আজ সংকটাপন্ন।
সরকারের শীর্ষ মহলের আর্থিক স্বার্থের কারণেই যে হলমার্ক গ্রুপ রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিপুল অঙ্কের ঋণ পেয়েছে, তা সবারই জানা। সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের অনুমোদন নিয়েই হলমার্ক গ্রুপ নামের এক অখ্যাত কম্পানিকে বিপুল অঙ্কের অর্থ ঋণ দেওয়া হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীলরাও এ অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা আগে থেকেই জানতেন।
বস্তুত বর্তমান সরকারের সাড়ে চার বছরের শাসনামলে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক শুধু হলমার্ক গ্রুপকে নয়, আরো অনেক অখ্যাত প্রতিষ্ঠানকে কমিশন, ঘুষ ও জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়েছে।
এ কথা বলাই বাহুল্য, ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কমিশন ও ঘুষের বিনিময়ে এবং ব্যাংক পরিচালনা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিপুল অঙ্কের অর্থ এভাবে লুটপাট হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। এটাই সত্য কথা, ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্ব পরিচালনা পরিষদের। কাজেই যাবতীয় অনিয়ম, অব্যবস্থা, কমিশন, ঘুষ-দুর্নীতির সব দায়দায়িত্ব পরিচালনা পরিষদের ওপরই বর্তায়।
দেশের অর্থনীতি যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক সেই সময় অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জন্য দুই লাখ ৭২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছেন। দেশের ইতিহাসে এটা সবচেয়ে বড় বাজেট। আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে সবাইকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে এ বাজেটে।
রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে অর্থনীতি গিরিখাদের তীরবর্তী। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন সরকার বাজটের ঘাটতি মেটানোর জন্য বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকে, অতীতে তা কখনো ৫০ হাজার কোটি টাকার ঊধর্ে্ব যায়নি। বর্তমানে এ ঋণের পরিমাণ এক লাখ হাজার কোটি টাকার ওপরে। সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন থেকে ঋণ নিয়েছে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাজেট আলোচনায়ও অর্থনীতির করুণ অবস্থার কথা খোদ অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। তিনি এক আলোচনায় বলেছেন, এবারের বাজেটটি তাঁর কাছে খুবই কষ্টের ও অস্বস্তিকর। রাজনৈতিক সংকটকেই তিনি অস্বস্তির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সূত্র উদ্ধৃত করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিনিয়োগের অভাবে গত কয়েক বছরের তুলনায় জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার এ বছর কমে গেছে। বিবিএস বলছে, চলতি বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৬.০৩ শতাংশ; যা গত তিন অর্থবছরের চেয়ে কম। সরকার গত বছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭.২ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, যা অর্জিত হয়নি।
সরকারি পরিসংখ্যানে জিডিপির হার ৬.০৩ শতাংশ দেখানো হয়েছে, তাতেও কারসাজি হয়েছে বলে প্রশ্ন উঠেছে। বিবিএসের হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৮৮ শতাংশ। মূলত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখার বিবেচনায় এটা করা হয়েছে।
গত অর্থবছরে জিডিপির হার ৬.০৩ শতাংশ থাকলেও প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আশা করা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। দেশের ইতিহাসে এত বড় প্রবৃদ্ধি এর আগে কখনো অর্জিত হয়নি। আর বর্তমানে নানা কারণে অর্থনীতি চরম সংকটে রয়েছে। বিশেষ করে দেশে তারল্য সংকট। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ শূন্যের কোঠায়, তাই এই প্রবৃদ্ধি-লক্ষ্য অর্জন কিছুতেই সম্ভব হবে না।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এ বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মোটেই অনুকূল নয়। বাজেটে যে অভিলাষ ও আকাঙ্ক্ষা রয়েছে তা পূরণ করতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা শুধু আবশ্যক নয়, অপরিহার্যও বটে। রাজনৈতিক সংকট নিরসনের মাধ্যমে রাজনীতিকে স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানমূলক করার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাত এখন কার্যত সীমিত হয়ে পড়েছে। ঐতিহ্যবাহী পাট, চা, চামড়াশিল্পের প্রতি যথাযথ নজর না দেওয়ায় তা আজ ধ্বংসের পথে। যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন প্রধানত তৈরি পোশাক ও জনশক্তি রপ্তানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। তাই এ দুটি খাতের অর্জন বহাল রাখার জন্যই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে অবস্থিত মিশনের সাফল্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক অসন্তোষের কারণে কিছুদিন আগে জাপানি বিনিয়োগকারীরা, সম্প্রতি অন্য কিছু দেশের বিনিয়োগকারীও বাংলাদেশে এসে ফিরে গেছেন। এ ছাড়া পোশাকশিল্প নিয়ে সৃষ্ট নানা জটিলতার খবরও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারের একচোখা বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও একগুঁয়েমির কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে চলেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে সভা-সমাবেশ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিভিন্ন মামলায় জ্ঞাত-অজ্ঞাত লাখ লাখ নাগরিককে আসামি করার ফলে দেশের অধিকাংশ লোকই গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছে। বিরোধী মহলের মিডিয়া বন্ধসহ নানা হয়রানি অব্যাহত রয়েছে। খোদ রাজধানীতে রাজপথে রাতে বিশেষ পুলিশের পোশাক পরিহিতদের সিরিজ ডাকাতির লোমহর্ষক বিবরণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এসব থেকে বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ কতটা অসহায়ভাবে দিন যাপন করছে। বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার, জামিন আবার গ্রেপ্তারের যে নাটকীয়তা চলছে, তা রীতিমতো হাস্যকর।
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টে মন্তব্য করা হয়েছে, সাভারের ভবনধসের ঘটনায় অন্ধকারে নিপতিত হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। নিউ ইয়র্ক টাইমসের মন্তব্য, বাংলাদেশের কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করেছে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো। মার্কিন গণমাধ্যম হাফিংটন পোস্টের দুই দিনের প্রধান শিরোনাম ছিল সাভারের ভবনধসের ঘটনা। অনলাইন সংস্করণে বাংলাদেশ সংক্রান্ত ১৪টি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এ সংবাদমাধ্যমটি। ওয়াশিংটন পোস্ট বাংলাদেশের অর্থনীতির হালহকিকত সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, সাভারে ভবন ধসে পড়ার আগে থেকেই বাংলাদেশের ১৯ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক শিল্প চাপের মধ্যে ছিল। এর কারণ ছিল রাজনীতিতে সরকার ও বিরোধী দলের মুখোমুখি অবস্থান। রাজনৈতিক সহিংসতায় বাংলাদেশ কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এ অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশ ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্ডার হারিয়েছে। বিদ্যমান ৫০ কোটি ডলারের অর্ডার ভারতে চলে যাচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ওয়ালমার্টসহ বাংলাদেশের বড় ক্রেতারা মুখ ফেরাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিদেশি প্রচারমাধ্যমগুলো। তাদের মতে, এ শিল্পের ৩৬ লাখ শ্রমিকের স্বার্থে ক্রেতারা হয়তো রাতারাতি বাংলাদেশকে ছুড়ে ফেলবে না, তবে ইমেজ সংকট পোশাকশিল্পকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী তখনই আসবে, যখন দেশীয় বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসবেন। কিন্তু অব্যাহত গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের সঙ্গে চলমান রাজনৈতিক সংকট নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এতে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নিচ্ছেন। পাশাপাশি বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে এসে আস্থার সংকটে ফিরে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলে কোনো দেশেই বিদেশি বিনিয়োগকারী আসে না। চলমান এ সংকট দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে গভীর সংকটের মুখে ফেলেছে। চলমান এ সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে বসার কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তত্ত্বাবধয়াক সরকার পদ্ধতির অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা না আসা পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অসহিষ্ণু, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধজনিত কারণে যা ঘটছে, তার খবর আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়ছে। সংগত কারণেই গণতান্ত্রিক বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অর্থনীতি ও রাজনীতি পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া আধুনিক যুগে আমাদের মতো উন্নয়নগামী দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন অসম্ভব। অনেক দিন থেকেই নানাভাবে এটা বলা হচ্ছে যে প্রবৃদ্ধিগত অর্জনের প্রয়োজনেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে নজর দেওয়া জরুরি। কার্যত সংশ্লিষ্টরা সতর্ক না হওয়ায় অর্থনীতি এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব মহল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে সরকারকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিলেও কার্যত তাতে কোনো ফলোদয় হচ্ছে না। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকেই যাচ্ছে। রাজনৈতিক অবস্থার ক্রমাবনতি হলে অর্থনীতিতে বন্ধ্যত্ব দেখা দিতে পারে। সে বিবেচনায় ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। আমদানিনির্ভর দেশে রপ্তানি আয় বাড়ানো সম্ভব না হলে সাধারণ ব্যয় মেটানো কঠিন হয়ে দেখা দিতে পারে।
লেখক : সংসদ সদস্য ও চেয়ারম্যান, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি

No comments

Powered by Blogger.