জন্মদিন-তাঁর পথে চলতে চাই by মালেকা বেগম

‘১৯১১ সালের ২০ জুন আমার জন্মদিন। বাংলা আষাঢ় মাস। সেকালের জমিদার বাড়িতে পুণ্যাহ বলে একটি পর্ব অনুষ্ঠিত হত। আনন্দ-কলরবে আমার জন্মক্ষণটি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল বলে শুনেছি।...’ সুফিয়া কামাল লিখেছেন তাঁর একালে আমাদের কাল স্মৃতিগ্রন্থে (১৯৮৮)।


আমরা যখন থেকে তাঁর সঙ্গে হেঁটেছি রাজপথে, তাঁর নেতৃত্বে অনুসরণ করে চলেছি নারীর মানবাধিকার অর্জনের সংগ্রামসংকুল পথ, তখন থেকে পালন করেছি তাঁর জন্মদিন। আনন্দ-কলরবে বাংলাদেশের সব স্তরের নারী-পুরুষ-শিশু পালন করে চলেছে তাঁর জন্মদিন। এ বছর তাঁর ১০১তম জন্মদিনে যখন তাঁকে হারানোর বেদনায় আমরা দুঃখ-ভারাক্রান্ত, সে সময়েও আনন্দে আপ্লুত হচ্ছি এই ভেবে যে, ভাগ্যিস তিনি জন্মেছিলেন এই দেশে।
এ বছর তাঁর জন্মদিনের কয়েক দিন আগে পালিত হলো ‘বাবা দিবস’। সুফিয়া কামালের দুঃখময় স্মৃতি বাবাকে কখনো না দেখার বেদনায় সিক্ত ছিল। সাত মাস বয়সের অবোধ শিশুকালে তাঁর বাবা সৈয়দ আবদুল বারী নিখোঁজ হয়ে যান। মায়ের কোলে বড় হতে হতে এক দিন অন্য শিশুদের দেখলেন বাবার আদরে সিক্ত হতে। প্রশ্ন করলেন বেদনায় নীল হয়ে, ‘আমার আব্বা আসে না কেন আম্মা?’ মা সৈয়দা সাবেরা খাতুন, ‘নির্বাসিতা হাজেরার মতো মহীয়সী...মা বানবিদ্ধা কপোতীর মতো লুটিয়ে’ পড়লেন। কবি সুফিয়া কামালের ‘মনের বয়স যেন বেড়ে গিয়েছিল’। তিনি ব্যক্তিগত আলাপে বহুবার তাঁর শৈশবের এই বেদনার কথা আমাকে বলেছেন, সে সঙ্গে আর্তনাদ করেছেন রিক্তা মায়ের বেদনার কথা মনে করে। তাঁর সারা জীবনের কর্মযজ্ঞের মধ্যে গণমানুষের মনের সংস্পর্শে যাওয়ার বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করেছি আমরা। তিনি বলেছেন, বাবার অনুপস্থিতি, বাবার স্নেহবঞ্চিত হূদয়ের ব্যথা, রিক্তা মায়ের আর্তি উপলব্ধির ব্যথাই তাঁকে মানুষের হূদয়ের মনের সংস্পর্শে যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছে।
জন্মশততম উত্তরণের উৎসবে বাংলাদেশের জনগণ পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রোকেয়া, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, প্রীতিলতাও সুফিয়া কামালকে। এঁদের সঙ্গে আরও শত শত মনীষীর নাম যুক্ত রয়েছে। আমরা ধন্য তাঁদের কর্মযজ্ঞে, তাঁদের মননশীল সংস্কৃতির পরম্পরায় যুক্ত হতে পেরে। সুফিয়া কামালের কাব্যসাধনায়, বহুবিধ আন্দোলনের কর্মযজ্ঞে তাঁদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা, প্রেরণাও উৎসাহের বিষয়ে কবি বলেছেন বারবার নানা অনুষ্ঠানে, লেখায়। তিনি একাধারে সাহিত্যসাধনায়, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক গণজাগরণে-আন্দোলনে, নারীর মানবাধিকার অর্জনের সংগ্রামে, অব্যাহতভাবে ১৯২৫ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত যুক্ত থেকে নেতৃত্ব দিয়ে, পরিচালনা করেছেন।
সুফিয়া কামালের কবিতা আমাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়েছিল সেই ১৯৫৪ সালে। নারী শিক্ষামন্দির স্কুলের গভর্নিং বডির কর্মকর্তা হিসেবে তিনি স্কুলে যেতেন, তাঁর ছেলে সাজেদ কামাল আমার সহপাঠী ছিল সেই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময়। বালিকা বয়সের সেই স্মৃতি থেকে ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে নানা সূত্রে, নানা কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকা, ৪৫ বছরের স্মৃতি খণ্ড খণ্ডভাবে এবং অবিশ্রান্তভাবে ১৯৬৭ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত ব্যাপৃত স্মৃতি যেন স্বর্ণখনিস্বরূপ।
কাগজ-কলম নিয়ে তাঁর কথা লিখে রাখার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলাম ১৯৮৭ থেকে। সে বছর তাঁর জন্মদিনের আগে আগে ১৫ জুন বসেছিলাম তাঁর কাছে। শুনছিলাম আর লিখছিলাম তাঁর কথা। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে ও পরিচালনায় আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলামের সদস্য হয়ে কাজ শুরু করলেন নারীদের সংগঠিত করতে। বর্ধমানে মনিকুন্তলা সেনের সঙ্গে মহিলা সমিতির কাজ করলেন ১৯৪২-৪৩ সালে। ঢাকায় এলেন ১৯৪৭-এর নভেম্বরে। এর মধ্যে শিক্ষকতা করছিলেন কলকাতা করপোরেশনের স্কুলে। ঢাকায় যোগ দিলেন বেতার অনুষ্ঠানের কাজে। লীলা নাগ বললেন ওয়ারী মহিলা সমিতির কাজে যুক্ত হতে। কত প্রচারণা তখন শুনেছেন, লীলা নাগের সঙ্গে কাজ করছেন, তিনি নিশ্চয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ‘পাক-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি’র সভানেত্রী হলেন ১৯৬৫ সালে। তখনো প্রচার চলল, তিনি মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট হয়েছেন। জীবনভর তাঁকে শুনতে হয়েছে: তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থক, কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক, তিনি ধর্ম মানেন না, তিনি মেয়েদের স্বাধীনতার পথে টেনে নিয়ে তাদের উচ্ছন্নে যাওয়ার পথ তৈরি করছেন। তাঁর আদর্শে যাঁরা বলীয়ান হয়েছে তাঁরা জানেন, তিনি দল-মতনির্বিশেষে সব শুভ উদ্যোগের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন।
সুফিয়া কামাল হয়ে উঠলেন তরুণীদের খালাম্মা, বয়স্কদের আপা। অনেকের মাও মামণি। তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী। মোক্ষম একটি কথা বলে চুপ করে অন্যদের মতামত গ্রহণ করার ও পরমতসহিষ্ণুতার অনন্য ভূমিকা তিনি পালন করেছেন জীবনভর। আপত্তি থাকলেও বা অপছন্দ হলেও অসন্তুষ্টি কখনো জানাতেন না। কারও খারাপ ব্যবহারে নিজেকে অপমানিত মনে করতেন না। অসীম ঔদার্যে তিনি উপেক্ষা করতেন অপছন্দের কাজ ও আচরণ। তাঁর শিক্ষায় ও ঔদার্যে সে সময় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভিত্তিমূল এমনভাবে গড়ে উঠেছিল যে সবার মতামত গ্রহণের, অংশগ্রহণের, কাজ করার গণতান্ত্রিক নারীমঞ্চ হিসেবে সংগঠনটি সবার প্রিয় হয়ে উঠল।
ছোট ছোট পরামর্শও নির্দেশ দিতেন খালাম্মা। সেগুলোই মহীয়ান হয়ে উঠত নারীসমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণে। আজকের কাজ কালকের জন্য তুলে না রাখা, যে কথা ও কাজ নারীর মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করে তেমন কথা না বলা এবং তেমন কাজ না করার জন্য ছিল তাঁর অনুরোধ, নির্দেশ। নারী আন্দোলনের প্রতিশ্রুতিশীল সংগঠন মহিলা পরিষদের সদস্যদের আদর্শস্থানীয় হতে হবে—এটা ছিল তাঁর আকাঙ্ক্ষা ও পরামর্শ।
তাঁর অপূর্ব অচিন্তনীয় স্মৃতিশক্তি দেখে সব সময় মুগ্ধ হয়েছি। কাউকে তিনি একবার দেখলে ও কারও সঙ্গে যোগাযোগ হলে মনের অন্তস্থলে তাকে স্থায়ীভাবে স্থান দিতেন। দুঃখ আমাদের, একজন মাতৃসম, নেতৃত্বস্থানীয় পথপ্রদর্শককে আমরা হারিয়েছি।
তাঁর জন্মদিনে আমরা গভীর আনন্দে ও শোকে একাকার হয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর সম্পর্কে বলেছেন: ‘সুফিয়া কামালরা চিরদিন থাকেন না, তাঁরা প্রতিদিন জন্মও নেন না। তাঁদের স্মৃতি থাকে, কর্ম থাকে, প্রেরণা থাকে। না থাকলে আমরা বাঁচব কী করে, না থাকলে আমরা মানুষ হব কেমন করে? থাকুন বা না থাকুন, তাঁকে দেখতে পাই। তাঁকে শুনতে পাই। তাঁর কাছে যেতে চাই, তাঁর পথে চলতে চাই।’
আমাদের সবারই এই আকাঙ্ক্ষা, এই শপথ তাঁর জন্মদিনে।
মালেকা বেগম: নারীনেত্রী। শিক্ষক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.