জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও জনদুর্ভোগ

গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনো বিকল্প নেই সরকার জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ ব্যাপারে চলতি মাসের শেষদিকে গণশুনানি হবে এবং জুলাই মাসের মাঝামাঝি ঘোষণা আসবে। ঘোষণা দেরিতে এলেও ১ জুলাই থেকে গ্যাস ও বিদ্যুতের বাড়তি দাম গুনতে হবে গ্রাহকদের। নিশ্চয়ই এ সংবাদ


পাইকারি ও খুচরা গ্রাহক তথা দেশের জনগণের জন্য সুখকর নয়। কর্তৃপক্ষ বলছে, জ্বালানি খাতে বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি কমাতেই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লোডশেডিং কমানোর কথা মাথায় রেখে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। তবে এ ভর্তুকি কেন দেওয়া হচ্ছে, কিভাবে দেওয়া হচ্ছে সে বিষয়টি আমাদের খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। এ মূল্যবৃদ্ধি সময়োপযোগী কি না তা-ও ভেবে দেখতে হবে। উল্লেখ্য, গত বছর সরকার চার দফা জ্বালানির দাম বাড়িয়েছিল।
আমরা জানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। একদিকে বাড়তি জ্বালানির মূল্য, অন্যদিকে রাতারাতি পণ্যমূল্য বেড়ে জনজীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ। পরিবহন খাতে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। দেশে এ খাতে অস্বাভাবিক পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়ার পাশাপাশি উচ্চ হারে মুদ্রাস্ফীতি অব্যাহত রয়েছে। সব মিলিয়ে এমনিতেই দেশের জনগণের ত্রাহি অবস্থা। এর মধ্যে আরেক দফা তেল-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি অনেকটা আগুনে তেল ঢালার মতো অবস্থা হবে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, সরকারের করণীয় কী? সে ক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হয়, সরকারের ব্যাপক ভর্তুকি দেওয়া কুইক রেন্টাল পদ্ধতির বিদ্যুৎ গ্রহণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে। বিদ্যুতের জন্য কুইক রেন্টাল ব্যবস্থায় সরকার জ্বালানি সরবরাহে অস্বাভাবিক পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে আসছে। এ ভর্তুকি অব্যাহত থাকলে সরকারের জন্য অর্থ সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া এ কুইক রেন্টাল দীর্ঘস্থায়ী হলে অর্থনীতির ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে সরকার জ্বালানির অভ্যন্তরীণ উৎসকে উপেক্ষা করে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে, যা মোটেই কাম্য নয়। অভ্যন্তরীণ জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সচল রাখা গেলে দেশে ব্যয়বহুল কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে না।
আমরা মনে করি, সরকারের জন্য এখন সময় এসেছে সব কিছুর আগে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ নিশ্চিত করা। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আবাসিক এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে না। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এ দুই ধরনের মূল্য নির্ধারণের কারণে ব্যবহার ও সরবরাহে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। আমাদের পরামর্শ হলো, সর্বপ্রথম অভ্যন্তরীণ জ্বালানি ও কয়লা উত্তোলন এবং এর ব্যবহারের মাধ্যমে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ ও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করা গেলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি কোনোটিরই মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না। উত্তোলনের পাশাপাশি গ্যাসের অপব্যবহার রোধ করাও জরুরি। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের যে অবৈধ সংযোগ রয়েছে এবং যে অপব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। গৃহস্থালির কাজে গ্যাসের অপব্যবহারও রুখতে হবে। তেলের গাড়িগুলোকে নতুন করে সিএনজিতে রূপান্তর একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ রাখা প্রয়োজন। এসব উদ্যোগ নিতে পারলে মূল্যবৃদ্ধির বাড়তি চাপ জনগণকে পোহাতে হবে না। এটা স্পষ্ট যে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দেওয়ার কারণেই সরকারকে জনগণের ওপর বাড়তি মূল্য চাপিয়ে দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ সরকার ধরেই নিয়েছে, ভর্তুকি কমানোর একমাত্র উপায় হলো জনগণের ওপর বাড়তি মূল্য চাপিয়ে দেওয়া। এটি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নয় বলে আমরা মনে করি। জ্বালানি আমদানি কমলে যেহেতু ভর্তুকির পরিমাণ অনেক কমবে, সেহেতু আমদানির বিকল্প দেশীয় উৎসের দিকে জোর দিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

No comments

Powered by Blogger.