স্থানীয় সরকার কমিশনের প্রয়োজনীয়তা আছে কি?

ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন মুসা
অতীতে এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও এনজিও ব্যক্তিত্বের মুখে প্রায়ই 'স্থানীয় সরকার কমিশন' গঠনের পক্ষে বহু যুক্তি শোনা যেত। এই বিষয়ে এই সরকারের প্রথম তিন বছরে তেমন কোনো বক্তব্য শোনা যায়নি।


তবে সম্প্রতি একটি এনজিও আয়োজিত সেমিনারে নতুন করে একই বক্তব্য শোনা গেল। এ বিষয়ে তাদের যুক্তি হলো, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা অভিভাবকহীন, তাঁদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো নিজস্ব কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করছে। তাই তাঁদের রক্ষার জন্য 'স্থানীয় সরকার কমিশন' গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। সবাই জানেন, গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেসব যুক্তি মেনে নিয়ে 'স্থানীয় সরকার কমিশন' গঠন করে। পরে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে সে ব্যবস্থা বাতিল করে। বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে আবারও তাঁরা 'স্থানীয় সরকার কমিশন' গঠনের দাবিতে সভা-সেমিনার শুরু করেছেন। তাঁরা একই মুখে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কেন্দ্রীয় নেতাদের ভুলত্রুটি নিয়ে প্রায়ই সমালোচনা করেন এবং নেতাদের অযোগ্য, অদক্ষ প্রমাণের জন্য নানা ধরনের যুক্তি দিয়ে থাকেন। তাহলে কি তাঁরা একসময় জাতীয় পর্যায়ে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার জন্য 'কেন্দ্রীয় সরকার কমিশন' গঠনের দাবিও উত্থাপন করবেন?
দুই. ওই সেমিনারটি গত ৫ মে ঢাকায় সিরডাপ মিলনায়তনে 'স্থানীয় সরকারের অধীনে উন্নয়ন কার্যক্রমে অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ' শিরোনামে অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় সরকার বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা এই প্রতিষ্ঠানে না থাকা সত্ত্বেও সব বিষয়ে কথা বলার অভিপ্রায় থেকে সেমিনারটি আয়োজন করা হতে পারে। অথবা বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে 'স্থানীয় সরকার কমিশন' গঠনে যাঁরা উৎসাহ জুগিয়েছেন তাঁদেরও এ বিষয়টি নিয়ে মাঠে থাকার প্রয়াস হতে পারে। যা হোক, উল্লিখিত সেমিনারে সরকার ও বিরোধী দলের কয়েকজন এমপি, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব, বুদ্ধিজীবী, গবেষক, এনজিও কর্ণধার ছাড়াও স্থানীয় সরকারের কয়েকজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সেখানে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী বলেন, 'জাতীয় বাজেটের অতি নগণ্য অংশই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে খরচ হয়। ২০১০-১১ অর্থবছরে সব সিটি করপোরেশনের জন্য বরাদ্দ ছিল ১২০ কোটি টাকা, যা বার্ষিক বাজেটের মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ।' সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি বলেন, 'কাবিখা, টিআর- এগুলো অপচয় আর চুরি বাড়ায়।' বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, 'সংসদীয় এলাকায় করার মতো অনেক কাজ আছে। সংসদ সদস্যদের স্থানীয় সরকারে ভূমিকা রাখার ক্ষমতা না দিলে ক্ষতি নেই।' সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, তিনি ২৪২টি উপজেলা ও ৪৪০টি ইউনিয়ন ঘুরে দেখেছেন, যেখানে বিরোধীদলীয় প্রতিনিধি ক্ষমতায় সেখানে বরাদ্দ কম।
তিন. ওই সেমিনারে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে জাতীয় রাজনীতি ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে সমাজে পরিচিতরাও ছিলেন। তাঁদের মুখে স্থানীয় সরকার বিষয়ে গতানুগতিক কথা শুনে বোঝা যায়, এ দেশে গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার নিয়ে যে আন্দোলন চলছে তার সঙ্গে এসব সেমিনারের কোনো সম্পর্ক নেই। বলা প্রয়োজন, আধুনিক যুগের শাসন ও সরকার ভাবনা এসেছে স্থানীয় শাসন থেকে। সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ এবং জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজ ছাড়া বাকি সব কাজ করার ক্ষমতা স্থানীয় সরকার রাখে। স্থানীয়দের প্রয়োজনে স্থানীয় সরকারের সৃষ্টি হওয়ায় এটিকে টিকিয়ে রাখা ও পুষ্টিদান করার দায়িত্ব তো স্থানীয়দেরই। তবে জাতীয় সরকার অবশ্যই সহায়তামূলক ভূমিকায় থেকে অপেক্ষাকৃত রুগ্ণ ও আর্থিকভাবে দুর্বল ইউনিটগুলোকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা দেবে, সেটিই প্রত্যাশিত। যেমনিভাবে একান্নবর্তী পরিবারের অভিভাবক ও পরিবারের অন্য সদস্যরা পিছিয়ে থাকা সদস্যকে সহযোগিতা করে থাকেন। তবে পরিবারের কেউই কামনা করেন না, আর্থিকভাবে দুর্বল সদস্যটি সব সময় অন্যের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল থাকুক। একইভাবে বিভিন্ন ক্লাব ও সমিতির অফিসগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হতে দেখা যায়। প্রতিষ্ঠানটির অফিস খরচ, কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় খরচ প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত সদস্যদের চাঁদা বা অনুদানের অর্থে পরিশোধ করা হয়। বস্তুত এভাবে পরিচালিত যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের বেলায়ও একই উদাহরণ প্রযোজ্য। অথচ স্থানীয় ইউনিটগুলো একদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বেশি বেশি অর্থ বরাদ্দ ও সুবিধা দাবি করছে এবং অন্যদিকে স্বশাসনের দাবিও করছে। কিন্তু নিজেরা কিভাবে স্বাবলম্বী ও স্বাধীন থাকবে, তার উপায় নিয়ে কথা বলছে না।
চার. সেদিনের সেমিনারের খবর প্রকাশ করতে গিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকা শিরোনাম করেছে, 'স্থানীয় সরকারের অর্থায়নে স্বাধীন কমিশন গঠন জরুরি।' প্রকৃতপক্ষে সেই সেমিনারে উপস্থিত একজন সদস্য ছাড়া কেউই এ ধরনের কমিশন গঠনের কথা বলেননি। উদ্ধৃত পত্রিকাটি ছাড়া অন্য কোনো দৈনিক ওই শিরোনামে খবর প্রকাশ করেনি। তাই একে খণ্ডিত বক্তব্য দিয়ে সমগ্রকে গ্রাস করার চেষ্টার সঙ্গে তুলনা করা যায়। উল্লেখ্য, পত্রিকাটি প্রায় চার বছর আগে একটি এনজিও কর্ণধারের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। সেই সাক্ষাৎকারে এনজিও কর্ণধার স্যানিটেশন, ক্ষুদ্রঋণ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম তুলে ধরেন। তিনি স্থানীয় সরকার বিষয়ে কিছু না বললেও পত্রিকাটি শিরোনাম করে 'স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে'। পত্রিকাটি গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে অব্যবহৃত ও অকেজো ব্রিজ প্রসঙ্গে একটি অনুসন্ধানী খবর প্রকাশ করে। বলা হয়, 'প্রায় পৌনে তিন হাজার ব্রিজ কোনো কাজে আসছে না' এবং এর পেছনে স্থানীয় প্রতিনিধিদের খামখেয়ালিপনা রয়েছে বলে দাবি করা হয়। আমাদের পক্ষ থেকে একজন লেখক ওই পত্রিকার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে এ বিষয়ে মতবিনিময়কালে জানান যে ব্রিজগুলো এলজিইডি নির্মাণ করেছে। এলজিইডি তথা 'স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর'টি মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান। এটি কোনো অবস্থায়ই স্থানীয় সরকার নয় এবং স্থানীয় সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানও নয়। তা ছাড়া এ দেশে 'স্থানীয় সরকার' নামে পৃথক কোনো সরকারব্যবস্থাও নেই। প্রতিটি স্থানীয় ইউনিট কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাহী বিভাগের স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। ফলে এর প্রতিনিধিরা এমপি, সরকারি কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের অনুরোধে ব্রিজ নির্মাণের পক্ষে মতামত দিতে বাধ্য থাকেন। তার মানে এই নয় যে ব্রিজটি স্থানীয়দের প্রয়োজনে কিংবা স্থানীয়দের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নির্মাণ করা হয়েছে। এরপর অবশ্য পত্রিকাটি এ বিষয়ে আর কিছু লেখেনি, তবে আমাদের লেখকের মতটিও প্রকাশ করেনি।
পাঁচ. এখন পত্রিকাটি স্থানীয় সরকারের জন্য অর্থায়নে একটি 'কমিশন' গঠনের পক্ষে কথা বলছে। তাদের মতে, কমিশন স্থানীয় সরকারকে সঠিক পরামর্শ দেবে ও অভিভাবকের ভূমিকা পালন করবে। প্রশ্ন এসে যায়, যদি কমিশন স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হয়, তাহলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাজ কী হবে? স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরো যেসব কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেমন এনআইএলজি কিংবা এ-জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে কমিশনের সঙ্গে যুক্ত হবে? গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুজন আমলা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের সমন্বয়ে 'স্থানীয় সরকার কমিশন' গঠন করা হয়। সে সময় কমিশনের জনৈক সদস্য বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অনুযোগের সুরে বলতেন, সবেমাত্র একটি অবয়ব পাওয়া গেছে; এখনো পূর্ণাঙ্গ বডিতে রূপান্তরিত হয়নি; পূর্ণাঙ্গ শারীরিক যোগ্যতা অর্জনের পর এই কমিশন স্থানীয় সরকারের জন্য অনেক কিছুই করবে। তবে কমিশনটি পূর্ণাঙ্গ শারীরিক অবয়ব পাওয়ার আগেই গাড়ি ক্রয়, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, অফিস সজ্জিতকরণ, ঘনঘন বিদেশ সফর, প্রাসাদতুল্য বাড়ির বরাদ্দ প্রাপ্তি, আরাম-আয়েশ ইত্যাদি নিয়ে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বলা যায়, ওই কমিশন স্থানীয় সরকারের স্বার্থে কোনো কাজই করেনি কিংবা করার চেষ্টাও করেনি।
ছয়. এর বিপরীতে আমরা স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিডিএলজি 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা' নামক একটি প্রস্তাবনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পেইন করে আসছি। এই রূপরেখায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দুই ধরনের সরকারব্যবস্থা থাকতে পারে, তা হলো কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা আর স্থানীয় সরকারব্যবস্থা। কেন্দ্রীয় সরকার মূলত জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। আর স্থানীয় সরকার অবশ্যই স্থানীয় কাজগুলো বাস্তবায়ন করবে। সে জন্য স্থানীয় সরকারের একটি সমন্বিত স্তর বিন্যাস গ্রহণ করে তাতে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট (বিভাগ অথবা জেলা) এবং সর্বনিম্ন ইউনিট (গ্রামীণ এলাকায় ইউনিয়ন ও নগর এলাকায় নগর) নির্ধারণ করে কোন ইউনিটের কী কাজ ও ক্ষমতা থাকবে, তা নির্দিষ্ট করতে হবে। ইউনিয়নের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি বলে এর সংখ্যা যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলতে হবে। পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত 'নগরীয় বাংলাদেশ' ও খাদ্যনিরাপত্তার অন্যতম বাহন 'নগরীয় কৃষি'র ধারণা বাস্তবায়নের প্রথম ধাপে ৩১৫টি নগর সরকার গঠন করতে হবে। স্থানীয় সরকারের মধ্যবর্তী ইউনিট যেমন 'উপজেলা'র প্রয়োজন কতটুকু রয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। তা ছাড়া স্থানীয় উন্নয়নে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও তাদের সামনে স্থানীয় সরকারের কাজ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্টকরণ ও ক্ষমতার পৃথককরণের স্বার্থে স্থানীয় সরকারে তিনটি বিভাগ, তথা স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় সংসদ ও স্থানীয় আদালত স্থাপন করতে হবে। 'এমপো' তথা '১০০/১০০ প্রতিনিধিত্ব' নীতি অনুযায়ী স্থানীয় সরকারে নর-নারীর গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন সুনিশ্চিত থাকবে। ওই ব্যবস্থার সঙ্গে স্থানীয় নির্বাচনিক বোর্ড ও স্থানীয় ন্যায়পাল থাকবে। জনগণ দুই ধরনের সরকারের জন্য দুই খাতে কর প্রদান করবে। কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার নিয়ে ওই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে দুই সরকারের কক্ষপথ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে এবং জনগণের কাছে জবাবদিহিতা আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। উভয় সরকারে গণতান্ত্রিক আইনকানুন, রীতিনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয় প্রাতিষ্ঠানিকতা পেতে থাকবে।

লেখকবৃন্দ : স্থানীয় সরকারবিষয়ক বিশ্লেষক
janipop1995@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.