ফজলুর রহমানের আট কোম্পানি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা অভিযোগ-৩০০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি করতে নির্দেশ by মনজুর আহমেদ

বাংলাদেশ ব্যাংক একজন ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন আট কোম্পানির তিন শতাধিক কোটি টাকার ঋণ ১৫ মের মধ্যে ক্ষতি বা মন্দমান খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে নির্দেশ দিয়েছে। এই ব্যবসায়ী হলেন একসময়ের ব্যাংক খাতের আলোচিত খেলাপি নারায়ণগঞ্জের ফজলুর রহমান। রাষ্ট্র খাতের সোনালী ব্যাংকের দুই শাখাতে তাঁর তিন শতাধিক কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।


কোম্পানিগুলো হলো—ফজলুর রহমান অ্যান্ড কোং (প্রা.) লি, রহমান স্পিনিং মিলস, রহমান হোসিয়ারি ডায়িং অ্যান্ড ফিনিশিং, অলিম্পিয়া নিটিং, জেসি হোসিয়ারি, রহমান হোসিয়ারি অ্যান্ড গার্মেন্টস (রহমান গ্রুপ কম্বাইন্ড), রহমান হোসিয়ারি অ্যান্ড গার্মেন্টস এবং ফজলুর রহমান ইন্ডাস্ট্রিজ। প্রথম কোম্পানিটি সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নিচে অবস্থিত স্থানীয় কার্যালয় থেকে, আর বাকি সাত কোম্পানি ঋণ নিয়েছে সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখা থেকে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ থেকে গত মার্চ মাসের বিভিন্ন সময়ে বিশেষ পরিদর্শনকাজ চালিয়ে ফজলুর রহমানের এসব কোম্পানির ঋণে নজিরবিহীন অনিয়ম পেয়েছে। সেসব অনিয়ম তুলে ধরেই সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি পাঠিয়ে চার দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২ মে এই চিঠি দেওয়া হয়, যার অনুলিপি দেওয়া হয়েছে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে। এই কাজ সম্পন্ন করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৫ মে পর্যন্ত সময় দিয়েছে সোনালী ব্যাংককে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ফজলুর রহমানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহের বর্ণিত ঋণগুলো গুণগত মানে শ্রেণীকরণযোগ্য বিধায় সেগুলোকে ক্ষতিজনক মানে শ্রেণীকরণ (খেলাপি) এবং এর বিপরীতে যথাযথ প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) রাখতে হবে। নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংক আরও বলেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণগুলো আদায় না হওয়া পর্যন্ত এসব ঋণ নবায়ন বা পুনঃ তফসিল করা যাবে না। নতুনভাবেও ঋণ দেওয়াও যাবে না। ঋণ আদায়ে প্রয়োজনীয় মামলা করতে হবে এবং সময় সময় অগ্রগতি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হবে।
আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিপূর্বে জারি করা ঋণসংক্রান্ত বিভিন্ন সার্কুলারের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে এসব ঋণ যে নবায়ন বা পুনঃ তফসিল করা হয়েছে, তার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রভাবশালী এই ফজলুর রহমান একদা সোনালী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। তাঁর ঋণ পুনঃ তফসিল করতে বিগত সরকারগুলোর ডজন খানেক মন্ত্রী, সংসদীয় কমিটি ও সাংসদ একাধিকবার তৎপরতা চালিয়েছেন। তাঁদের জোর সুপারিশে রহমান গ্রুপের বিভিন্ন ঋণ বারবার পুনঃ তফসিল হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মূল ঋণ ৮৭ কোটি টাকা। আর সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ হিসাব করে তাঁকে বলেছে সুদসহ এই ঋণ ১৫৬ কোটি টাকা। পরিশোধের মেয়াদও দিয়েছে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। তিনি আরও বলেন, তাঁর ঋণগুলো খেলাপি করা হলে সবগুলো শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। ২০ হাজার কর্মসংস্থান নষ্ট হবে। বছরে ১০০ কোটি টাকার রপ্তানি-আয় থেকে দেশ বঞ্চিত হবে। শিল্পের যন্ত্রপাতি সব নষ্ট হয়ে যাবে। সবশেষে তিনি বলেন, ‘আমার কী হবে, আমার বাবার জমিদারি আছে। তা নিয়ে আমি ভালোই থাকব।’
স্থানীয় কার্যালয়: বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল সরেজমিনে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে গিয়ে দেখেছে, লিম ও এলটিআরের মালামালের সঠিক তথ্য ব্যাংকের কাগজপত্রে নেই। (লিম বা লোন ফর ইমপোর্টেড মার্চেন্ডাইজার হচ্ছে কোনো আমদানির বিপরীতে গ্রাহককে দেওয়া ঋণসুবিধা। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা গুদামে মালামাল থাকে এবং গ্রাহক আংশিক বা সম্পূর্ণ অংশ মালামাল ছাড় করতে ব্যাংকের সে পরিমাণ দায় পরিশোধ করে। আর এলটিআর বা লোন অ্যাগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট হচ্ছে আমদানির বিপরীতে আরেক ধরনের ঋণসুবিধা। এখানে বিশ্বাসের ভিত্তিতে গ্রাহককে মালামাল দিয়ে দেওয়া হয়।)
স্থানীয় কার্যালয়ের গ্রাহক ফজলুর রহমান অ্যান্ড কোং (প্রা.) বিদেশ থেকে ঋণপত্র খুলে মালামাল আমদানি করলেও গুদামে তা ছিল না, আবার ব্যাংকের দায়ও পরিশোধ হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যা প্রকারান্তরে তহবিল স্থানান্তরের নামান্তর।’ তার পরও বারবার এই ঋণগুলো পুনঃ তফসিল করে নিয়মিত দেখিয়ে চলেছে ব্যাংক। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধান অনুসারে পুনঃ তফসিলের জন্য কোনো এককালীন জমা বা ডাউন পেমেন্ট নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক মন্তব্য করেছে, ‘উক্ত ঋণগ্রহীতার ঋণ আদায়, পরিশোধে সদিচ্ছা ও সময়নিষ্ঠতা, প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট পরিশোধ ইত্যাদি কোনো বিষয়েই সন্তুষ্টির অবকাশ না থাকলেও সেগুলো বিবেচনায় না এনে এরূপ ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়েছে।’
লিম হিসাবের ঋণ একবার পুনঃ তফসিল করে সাতবার কিস্তি পরিশোধের সময়সূচি পরিবর্তন করা হয়েছে। আর এলটিআর হিসাবের ঋণ মেয়াদি ঋণে পরিণত করে মোট ছয়বার কিস্তি পরিশোধের সময় পরিবর্তন করা হয়েছে। আগে নির্ধারিত ছিল এই সময় ২০০৪ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত। তা বৃদ্ধি করা হয়েছে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
পরিদর্শক দল দেখেছে, শাখা কোনো সুপারিশ করেনি অর্থাৎ ঋণের প্রকৃত অবস্থা যাচাই করা হয়নি। কিন্তু প্রধান কার্যালয় থেকে সরাসরি পরিচালনা পর্ষদে ঋণ পুনঃ তফসিল ও নবায়ন প্রস্তাব গেছে এবং তা অনুমোদিত হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখা: বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ঋণসমূহ ২০০০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু পরিদর্শনকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধিরা এসব ঋণের বিপরীতে কোনো আদায়ের তথ্য পাননি। কোনো প্রকার আদায় বা ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ পুনঃ তফসিল বা নবায়ন করে নিয়মিত করা হয়েছে। প্রাথমিক কিস্তি পরিশোধের তারিখ ২০০৮ সাল থেকে বারবার পরিবর্তন করে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। আর পুরো ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
এলটিআর, লিম এবং টিওডি (একধরনের বাণিজ্যিক অর্থায়ন, যা এক মাসের কম সময়ের জন্য দেওয়া হয়) মেয়াদোত্তীর্ণ হলে এর ওপর যে সুদ হয়েছে, তা দীর্ঘ মেয়াদে সুদবিহীন ব্লক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। কিস্তিতে যা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু সেই কিস্তি পরিশোধের সময়ও বারবার বৃদ্ধি করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ‘যা প্রায়োগিক ব্যাংকিং রীতিবহির্ভূত এবং পেশাদারিত্বের পরিপন্থী। এ ধরনের চর্চা গ্রাহককে ঋণ পরিশোধে অনীহার মনোভাব সৃষ্টিতে প্ররোচিত করছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে।’
ফজলুর রহমানের ঋণ সম্পর্কেও সোনালী ব্যাংক সঠিক তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিকে দেয়নি। সিআইবিতে বকেয়া স্থিতির পরিমাণ ২২৯ কোটি ১৫ টাকা। কিন্তু সরেজমিনে একই তারিখে বকেয়া স্থিতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকেরা পেয়েছে ২৫৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকার কম তথ্য দেওয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.